ভারতের প্রবীণতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, একইসাথে কংগ্রেস ভারতীয় উপমহাদেশেরও প্রাচীনতম দল। দেড়শো বছরের পরিক্রমায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদী আদর্শ ধারণ করে ভারতকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনই তাদের হাত ধরেই ভারত গড়ে উঠেছে সেক্যুলার এক দেশ হিসেবে। ফ্রান্স আর তুরস্কের মতো হার্ড-সেক্যুলার না হলেও, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘরানার সফট-সেক্যুলারিজম চর্চা করেছে স্বাধীনতার পর থেকেই। স্বাধীনতার পর থেকে সতেরটি সাধারণ নির্বাচনে সাতবারই মেজরিটি পেয়েছে কংগ্রেস, আরো তিনবার নেতৃত্ব দিয়েছে কোয়ালিশন সরকারে। সব মিলিয়ে, ভারতকে স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৫৪ বছর শাসন করেছে কংগ্রেস।
ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দল গত এক দশকে প্রবল সংকটের মুখে পড়েছে, প্রশ্ন উঠেছে অস্তিত্ব নিয়েই। মনমোহন সিংয়ের দশ বছরের শাসন শেষে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৬২টি আসন কমে মাত্র ৪৪ টি আসন পায় কংগ্রেস, পায় মোট ভোটের মাত্র ১৯ শতাংশ। ভোটের মাঠে কংগ্রেসের অবস্থা বদলায়নি ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনেও। নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি পায় ৩০৩টি আসন, জোট হিসেবে এনডিএ পায় মোট ৩৫৩টি আসন। অন্যদিকে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ পায় ৯১টি আসন, এককভাবে কংগ্রেস পায় মাত্র ৫২টি আসন।
ভোটের মাঠ আসলে সামগ্রিক রাজনীতির চিত্রও বলে দেয়। গত এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহের জুটির কাছে প্রায় অসহায় হয়ে পড়েছে ভারতীয় কংগ্রেস, রাজনীতির ময়দানে একের পর এক কৌশলে পরাস্ত হচ্ছে তারা। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে মুনশিয়ানা দেখিয়েছে বিজেপি, ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি ব্যবহার করেছে বিশাল সমর্থক শ্রেণি। কংগ্রেস থেকে একের পর এক আইনপ্রণেতা চলে গেছেন বিজেপিতে, পরিবর্তন ঘটেছে সমর্থক শ্রেণির পছন্দেও। এর সাক্ষ্য দেয় ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন, বিজেপি একাই পায় ৩৭ শতাংশ ভোট, যা কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের প্রায় দ্বিগুণ।
কংগ্রেসকে রাজনীতির ময়দানে ফিরিয়ে আনার বহু চেষ্টা গত এক দশকে রাহুল গান্ধী করেছেন, করেছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। কিন্তু, রাজনীতির মাঠে কংগ্রেস কেবলই আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে, মাত্র দুটি অঙ্গরাজ্যে তাদের সরকার আছে। এমতাবস্থায় আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কংগ্রেসকে জনমানুষের সাথে যুক্ত করতে রাহুল গান্ধী শুরু করেছেন ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’।
কেন ভারত জোড়ো যাত্রা?
এই যাত্রায় রাহুল গান্ধীর সঙ্গী হয়েছেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, প্রায় দু’শো জনের এই দল পাড়ি দেবে ৩,৫৭০ কিলোমিটার রাস্তা। তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে এই যাত্রা শুরু হয়ে শেষ হবে শ্রীনগরে গিয়ে। যাত্রাপথে রাহুল গান্ধী ও তার সফরসঙ্গীরা পাড়ি দেবেন ১২টি অঙ্গরাষ্ট্র, এবং ২টি কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত অঞ্চল। সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া এই যাত্রা ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছে কর্ণাটকে। পাঁচ মাসব্যাপী এই যাত্রা রাহুল গান্ধী অনেকগুলো কারণেই শুরু করেছেন।
প্রথমত, রাহুল গান্ধী জনতার একজন হয়ে উঠতে চাচ্ছেন, জনমানুষের নেতা হয়ে উঠতে চাচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদির চাওয়ালা ইমেজের বিপরীতে রাহুল গান্ধী ছিলেন অনেকটাই নিষ্প্রভ, বিজেপি নেতারা তাকে মজা করে বলতেন ‘পাপ্পু’। কংগ্রেসের জনসমর্থন বাড়াতে তাই জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে চাচ্ছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, মোদি খোলামেলাভাবেই অনেকবার বলেছেন যে তিনি কংগ্রেসমুক্ত ভারত চান। ভারতকে কংগ্রেসমুক্ত করতে গিয়ে মোদি কংগ্রেসের আইনপ্রণেতাদের ভাগিয়ে নিচ্ছেন, অনড় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলছেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ করে ব্যবহার করছেন দলের স্বার্থে।
রাহুল গান্ধীর এই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ তাই পরিচিতি পাচ্ছে কংগ্রেস রক্ষার অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে।
তৃতীয়ত, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরুর পূর্বে রাহুল গান্ধী তার বাবার স্মৃতিস্মারকে যান শ্রদ্ধা জানাতে। সেখানে তিনি বলেন, “ঘৃণা আর বিভাজনের রাজনীতির কারণে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। আমি একই কারণে দেশকে হারাতে চাই না।” কার্যত, রাহুল গান্ধীর এই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ঘৃণা আর বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বহুত্ববাদেরও লড়াই।