জেন্টেলম্যান থিফ বা বার্গলার হতে গেলে কী লাগে? ঐতিহাসিকভাবে এই বিশেষণের মালিক আর্সেন লুপাঁ, ফরাসি ঔপন্যাসিক মরিস লেব্লঁ সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র। মরিস সৃষ্ট কালজয়ী এই চরিত্রই নেটফ্লিক্সের ‘লুপাঁ’ নামক সিরিজ এবং এর কেন্দ্রীয় চরিত্র আসান দিওপ (ওমার সাই)-এর মূল অনুপ্রেরণা। এমনকি সিরিজে একপর্যায়ে এই চরিত্রকে নিয়ে লেখা একটি গানও শোনা গেছে৷
এখন পাঠকের মনে হতে পারে, ‘জেন্টলম্যান’ আর ‘বার্গলার’; এই দুটি কি পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় নয়? কিন্তু আসান দিওপের ক্ষণিকের বাঁকা হাসি আর কর্মকাণ্ড তাদেরকে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।
‘লুপাঁ’র প্রারম্ভিক পাঁচ পর্ব, যেগুলোকে একত্রে প্রথম ভাগ নাম দেওয়া হয়েছে, নেটফ্লিক্সে সম্প্রচারিত হয় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রথম ভাগ ইতোমধ্যেই দেখেছেন ৭০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ, যা একে দিয়েছে নেটফ্লিক্সে ইংরেজি ভাষার নয়; এমন সিরিজগুলোর ভেতর সবচেয়ে বেশিবার দেখা সিরিজের মর্যাদা।
দুনিয়ার অন্যতম সেরা শহর প্যারিসের প্রেক্ষাপটে ক্যারিশম্যাটিক স্টার আর স্টেজ ইল্যুশন ভিজ্যুয়ালের অনবদ্য সংমিশ্রণে দর্শককে বুঁদ করেছে লুপাঁ। এদিক থেকে বিবিসি’র লন্ডনের প্রেক্ষাপটে স্থাপিত টিভি সিরিজ শার্লকের সাথে তুলনা করা যায় একে। তবে মূল গল্পের অনায়াস এবং চটকদার আধুনিকীকরণের দিক থেকে এটি ছাড়িয়ে গেছে শার্লককেও। বিষয়বস্তু আর পরিচালনার দিক থেকে আরেক ব্রিটিশ সিরিজ লুথারের সাথেও মিল রয়েছে লুপাঁর।
মরিসের পূজনীয় সৃষ্টির টপ হ্যাট আর এক চোখের চশমার (মনোকল) পরিবর্তে আমাদের আধুনিক লুপাঁ পরে ফ্ল্যাট ক্যাপ আর এয়ার জর্ডান। এসব পরিধান করে ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির অতিকায় দেহাবয়ব নিয়ে সে মিশে যায় প্যারিসের জনস্রোতে। এসব হালকা চালের ভেতরেই শোরানার জর্জ কে আর ফ্রাঁসোয়া উজান ঢুকিয়ে দিয়েছেন নানা সামাজিক ইস্যু এবং থিম।
আসান দিওপের বাবার নাম বাবাকার দিওপ (ফার্গাস আসান্ডে)। তিনি ছিলেন একজন চটপটে এবং নিয়মানুবর্তী সেনেগালীয় অভিবাসী। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি শোফার বা ড্রাইভারের কাজ করতেন। তার নিয়োগকর্তা ছিলেন ধনী এবং লোভী, প্যারিসের উঁচু সমাজের বাসিন্দা হুবের পেলেগ্রিনি (এর্বে পিয়ের)। সুখেই দিন কাটছিল আসান আর তার বাবার, কোনোকিছুর অভাব ছিল না। পেলেগ্রিনি পরিবারের সাথেও তাদের সম্পর্ক ছিল ভাল।
কিন্তু তাদের সুখের দিনের সমাপ্তি ঘটে যখন হুবের পেলেগ্রিনি অমূল্য অলঙ্কার চুরির দায়ে দিওপ সিনিয়রকে পুলিশে সোপর্দ করেন। আসলে বাবাকার চুরি করেননি, বরং সবই ছিল পেলেগ্রিনির বীমা জালিয়াতির অংশ, যার মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নেন বিশাল অংকের অর্থ। একটা সময় এই জালিয়াতির ফলেই প্রাণ হারান বাবাকার। এতিম আসানের জীবনে নেমে আসে দুঃখ-দৈন্যের কালো মেঘ। ছোটবেলা থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত আসান তার বাবার সাথে হওয়া অবিচারের বদলা নেবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। তবে না, মেলোড্রামাটিক কিছু হবে না এখানে। এক্ষেত্রে সে যাকে অনুসরণ করে সবকিছুর পরিকল্পনা করে, সে আর্সেন লুপাঁ ছাড়া আর কেউ নয়, যাকে নিয়ে লেখা মরিসের গল্পের বইয়ের সাথে তার বাবাই তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স একসময় নিজেদের উপনিবেশগুলো থেকে প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। কর্তৃপক্ষকে এসব পাপের প্রায়শ্চিত্ত করাতে আসান নানা সম্পদ নিজের অধিকারে নিয়ে আসে এবং তা বিভিন্ন মাধ্যমে সমাজে বন্টন করে দেয়। এদিক থেকে আধুনিক লুপাঁর মাঝে রবিনহুডের ছায়া পরিলক্ষিত হয়। গল্পের সংসক্তি ধরে রাখতে শোরানাররা কিছু জিনিস সরাসরি দেখাননি। এগুলো দর্শককে অনুধাবন করে নিতে হবে।
যা-ই হোক, পেলেগ্রিনির বিরুদ্ধে বদলা নিতে একের পর এক অভিনব বুদ্ধি আঁটে আসান। কিছু সময় তার এসব বুদ্ধি কাজে লাগে, আবার কখনো কখনো লাগে না। কিন্তু সে কখনোই সহিংসতার পথে পা বাড়ায় না। নিজের ব্যক্তিগত মোহনীয়তা আর সুপরিকল্পনার উপরই নির্ভর করে সে। পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে পেলেগ্রিনির শক্তি এবং সর্বব্যাপী প্রভাব। সংগ্রামের পথে তার পাশে এসেও দাঁড়ায় কেউ কেউ। ছোটবেলার বন্ধু বেনিয়ামিন ফেরেল (আঁতোয়া গোউ) এমনই একজন। পেলেগ্রিনিকে তার প্রাপ্য সাজা দেয়ার প্রচেষ্টা করতে করতে আর নিত্যনতুন পরিকল্পনা সাজাতে সাজাতে প্রথমভাগের সমাপ্তি ঘটে ক্লিফহ্যাঙ্গারের মাধ্যমে। যেখানে আমরা দেখি, তার ছেলে রাওল (ইতান সিমন) অপহৃত হয়ে গেছে নিজের জন্মদিনে। সেদিন তারা পরিবারের সবাই মিলে একটি আর্সেন লুপাঁ বিষয়ক উৎসবে গিয়েছিল।
আসান দিওপ চরিত্রের বুদ্ধিমত্তা, অভিপ্রায়, ইচ্ছা ইত্যাদির প্রকাশে সিরিজটি বারবার গিয়েছে ফ্ল্যাশব্যাকে। ফলে সে যে ধরনের আচরণ করে, তা কেন করে- তা বুঝতে অসুবিধা হয় না দর্শকের। ফ্ল্যাশব্যাকে আমরা তার বাবার সাথে কাটানো সুখের মুহূর্ত, বাবার মৃত্যুর পরের দুঃখের দিন, সবই দেখি। লুপাঁ আরো দেখায়, শ্বেতাঙ্গ ছেলে-বুড়োরা তার সাথে কেমন আচরণ করে। ফলে তার লক্ষ্য আর অভিপ্রায় আরো যুক্তিযুক্ত হয়। এই ধরনের ফ্ল্যাশব্যাক উভয় সিজনেই দেখা গেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক কোনো পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে পূর্বের কোনো পরিস্থিতিকে। ফ্ল্যাশব্যাকে তার বন্ধুদের সাথে মধুর দিন কাটাতেও দেখা যায় আসানকে।
দ্বিতীয় ভাগ, অর্থাৎ ৬ষ্ঠ এপিসোড শুরু হয় আগের ঘটনার সূত্র ধরেই। এবার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। কেননা, পেলেগ্রিনির সবচেয়ে কুখ্যাত পাণ্ডাদের একজন তুলে নিয়ে গেছে রাওলকে। এই পাণ্ডা দেখতেও ভীতিকর। সে তার ছেলেকে নিয়ে আটকে রেখেছে একটি পরিত্যক্ত গ্রাম্য অট্টালিকায়। আসান কি পারে তার ছেলেকে বাঁচাতে?
আবার সে নিজেও হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়, কাছের মানুষদের জীবনও সংকটাপন্ন হয় তার কারণে। প্রথম সিজন থেকে আমরা জানি, পরিস্থিতি যত ঘোলাটে হোক, দেয়ালে পিঠ থেকে গেলেও আমাদের আধুনিক লুপাঁ ফিরে আসে স্বমহিমায়। এবার কি সে পারবে? পারলে… কীভাবে?
বর্ণবাদ আমরা এই সিজনেও দেখব। শ্বেতাঙ্গরা সব কালো লোককে একরকম মনে করে, দ্বিতীয়বার তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তারা কালোদের কেমন ভাবে, তা সবচেয়ে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে নরম্যান্ডির ঐ পানশালায়। তবে এসব ব্যাপারকে আসান নিজের পক্ষে ব্যবহার করে। এভাবে সে শত্রুর চেয়ে এগিয়ে থাকে বহুগুণে। এই অংশে তার সাথে একজন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী মিত্রের দেখা মিলবে, যে নিজেও আর্সেন লুপাঁর ভক্ত, তবে কাজকর্ম দিওপের মতো নয়। এই চরিত্রটিও মূল আর্সেন লুপাঁর সাথে সম্পর্কিত।
বারবার যে চার্ম বা ক্যারিশমার ব্যাপার বলছি, তা নিশ্চয়ই পাঠকের চোখ এড়াচ্ছে না। এগুলোর এত ব্যবহারের কারণ আপনার বুঝতে পারবেন সিরিজটি দেখতে বসলে। সাম্প্রতিক ফরাসি সিনেমাগুলো দেখলে ওমার সাইয়ের ব্যাপারে জানা থাকার কথা। আসান দিওপ চরিত্রটি যেন এই সুপারস্টারের জন্যই সৃষ্ট। চলনে-বলনে, কথাবার্তায় তিনি যেন আধুনিক লুপাঁরই প্রতিচ্ছবি। তাকে এই চরিত্রে দেখলে মনে হবে, এর চেয়ে ‘কুল’ কোনো অপরাধীর কোথাও অস্তিত্ব নেই। জেন্টেলম্যান বার্গলারের আত্মবিশ্বাস ঠিকরে বের হয় তার চাহনিতে। নিজের ব্যাপারে সে এতটাই আত্মবিশ্বাসী, যে কখনো আগ্নেয়াস্ত্র সাথে রাখে না। পিস্তল উদ্যত করে রাখা প্রতিপক্ষকে কেবল কথার জালে ফাঁসিয়ে বের হয়ে যায়।
আর ওমার সাইয়ের এই ‘কুলনেস’কে আরো কয়েক কাঠি উপরে তুলে ধরেছে। দু’ভাগের ১০টি এপিসোড জুড়েই রয়েছে অসাধারণ সব গান আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। তা গল্পের উত্তেজনাকে আরো প্রগাঢ় করে, দর্শকের মনোযোগকে আকর্ষণ করে রাখে পুরো সময় জুড়ে। এর ফলে এমনিতে অনবদ্য চেইস বা হেইস্ট সিকোয়েন্সগুলো আরো মোহনীয় হয়, হৃদপিণ্ডের গতিকে করে দেয় দ্রুত।
দ্বিতীয় অংশের সমাপ্তি ঘটে অনেকটা প্রশমিত পরিবেশে। আসান তার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় (এটা অবশ্য কোনো স্পয়লার দেওয়া হচ্ছে না)। তার পরিবার ও তার সংগ্রামের ব্যাপারে বুঝতে পারি। তার ছেলে তো তাকে নায়কের মতোই মনে করে। বলে, সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। এ অংশে সে একজন শিক্ষানবিশেরও সন্ধান পায়, যে স্বভাবে তার মতো এবং লুপাঁর বিশাল ভক্ত।
অনবদ্য গল্প আর চিত্রায়ণ ছাড়াও থ্রিলার জনরার প্রচলিত কাঠামোর ভেতরে লুপাঁ সুচারুভাবে তুলে এনেছে বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ, নিষ্পেষণ ইত্যাদি গম্ভীর বিষয়। সাথে তুলে ধরেছে সমাজে বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি গ্রহণযোগ্য চিত্র। এত কিছু করতে গিয়ে দর্শককে সাসপেন্সে আচ্ছন্ন করে ফেলার কথাও ভোলেনি এই সিরিজ, বরং সেটা করেছে অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে। তাই যদি কেবল সাসপেন্সে বু্ঁদ হতে চান, তাহলেও দেখতে বসে যেতে পারেন ১০ এপিসোডের এই সিরিজ। অতিমারির সময়ে নিজেকে প্রফুল্ল রাখাটাই মুখ্য। ওমার সাই বলেছেন, তৃতীয় ভাগও আসবে।