প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ছয়টিকে ‘মুখ্য মিত্রশক্তি’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। এদের মধ্যে চারটি রাষ্ট্র (ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জাপান) ১৯১৪ সালের আগস্ট থেকেই (অর্থাৎ, বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পরপরই) যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অপর দুইটি রাষ্ট্র (ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) প্রথমে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে এবং বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে যুদ্ধে যোগদান করে।
ইতালি
‘ইতালি রাজ্য’ (ইতালীয়: Regno d’Italia) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র ছিল। মুখ্য মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইতালি ছিল সামরিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে দুর্বল রাষ্ট্র। অবশ্য তা সত্ত্বেও ইতালির একটি বৃহৎ সেনাবাহিনী ছিল এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে আফ্রিকা ও চীনে তাদের বেশ কয়েকটি উপনিবেশ ছিল। ইতালির প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই উপনিবেশগুলোও স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মহাযুদ্ধের সময় ইতালি তার উপনিবেশগুলোর সম্পদকে যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করে এবং ইতালীয় উপনিবেশগুলো থেকে আগত লক্ষ লক্ষ সৈন্য কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
বলকান, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় ইতালীয় প্রভাব বৃদ্ধি ও সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা এবং অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সঙ্গে ইতালির ভূখণ্ড সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির অংশগ্রহণের মূল কারণ। অবশ্য এগুলো ছাড়াও এই যুদ্ধে ইতালির অংশগ্রহণের আরো বিভিন্ন কারণ ছিল, কিন্তু এই কারণগুলোই ছিল প্রণিধানযোগ্য। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালি ‘ত্রিশক্তি জোট’ (১৮৮২) সম্পাদনের মাধ্যমে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই মৈত্রী ছিল আত্মরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়। অর্থাৎ, মৈত্রীতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনোটি বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হলেই কেবল বাকি রাষ্ট্রগুলো আক্রান্ত রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে বাধ্য ছিল।
ইতালি অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির কিছু ভূখণ্ড দখল করতে আগ্রহী ছিল এবং এজন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর ইতালি তাদের আনুষ্ঠানিক মিত্র জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির পক্ষ অবলম্বন না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। ইতালীয়দের বক্তব্য ছিল, ত্রিশক্তি জোট কেবল আত্মরক্ষামূলক এবং অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সার্বিয়ার ওপর আক্রমণ চালিয়ে একটি আক্রমণাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। তদুপরি, যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ইতালির মতামত নেয়া হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে এই কারণগুলো দেখিয়ে ইতালি প্রাথমিকভাবে এই মহাযুদ্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।
কিন্তু ইতালীয় সরকার গোপনে মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তি উভয়ের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে এবং কোন পক্ষে যোগদান করলে ইতালি বেশি লাভবান হবে, সেটি হিসেব করতে থাকে। অবশেষে ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ইতালি মিত্রশক্তিতে যোগদানকে বেশি লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে। ইতালি ১৯১৫ সালের ২৩ মে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে, ২১ আগস্ট ওসমানীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, ১৯ অক্টোবর বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে এবং ১৯১৬ সালের ২৮ আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই মহাযুদ্ধ চলাকালে ইতালি প্রধানত ইতালীয় রণাঙ্গনে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কিন্তু এর পাশাপাশি তারা ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে মিত্রশক্তি রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং ইতালি এই আক্রমণেও অংশগ্রহণ করে।
ইতালীয় রণাঙ্গনে প্রাথমিকভাবে ইতালীয় সৈন্যরা অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয়দের বিরুদ্ধে তেমন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি এবং ১৯১৭ সালে জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় যৌথ বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর তারা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। অবশ্য পরবর্তীতে ইতালীয়রা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং ১৯১৮ সালে নাগাদ অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর নাগাদ কেন্দ্রীয় শক্তি মিত্রশক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করলে এই মহাযুদ্ধের অবসান ঘটে।
ইতালি ও ইতালির উপনিবেশগুলো থেকে আগত প্রায় ৫৬,১৫,০০০ সৈন্য এই মহাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৬,৫১,০১০ জন নিহত এবং ৯,৫৩,৮৮৬ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইতালি অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে ব্রেনার গিরিপথ পর্যন্ত টাইরল অঞ্চল (দক্ষিণ টাইরল ও ত্রেন্তিনো–সহ), করিন্থীয় উপত্যকা এবং অস্ট্রিয়ান লিটোরাল (ইস্ত্রিয়া উপদ্বীপ, গোরিজিয়া ও গ্রাদিস্কা এবং ত্রিয়েস্ত) লাভ করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালি কর্তৃক ওসমানীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকৃত লিবিয়া ও দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ স্থায়ীভাবে ইতালির অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু মিত্রশক্তির অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র ইতালিকে আফ্রিকায় অবস্থিত জার্মান উপনিবেশগুলোর অংশবিশেষ প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল, সেটি পূরণ করেনি এবং এজন্য ইতালীয়দের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। অবশ্য পরবর্তীতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে ইতালিকে আফ্রিকায় বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড প্রদান করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’ (ইংরেজি: United States of America) কার্যত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি এবং তাদের শিল্প ও সামরিক সামর্থ্য ছিল বিপুল। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তিতে যোগদান কার্যত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ল্যাটিন আমেরিকা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি উপনিবেশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই উপনিবেশগুলোও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ পরিচালনার জন্য উপনিবেশগুলোর সম্পদ ব্যবহার করে এবং উপনিবেশগুলো থেকে আগত হাজার হাজার সৈন্য কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
বিশ্বব্যাপী মার্কিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করার আকাঙ্ক্ষা এবং জার্মানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের প্রধান কারণ। এর বাইরে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের আরো নানাবিধ কারণ ছিল, কিন্তু এই কারণগুলোই এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিল না এবং বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর তারা প্রাথমিকভাবে এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি ছিল মিত্রশক্তির প্রতি।
১৯১৫ সালের মে মাসে একটি জার্মান সাবমেরিন ব্রিটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ ‘আরএমএস লুসিটানিয়া’কে ডুবিয়ে দেয় এবং এর ফলে জাহাজে থাকা বহুসংখ্যক মার্কিন নাগরিকের সলিলসমাধি ঘটে। এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যবর্তী সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকে। ১৯১৭ সালে জার্মান সাবমেরিনগুলো মিত্রশক্তির বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যরত সকল জাহাজ ডুবিয়ে দিতে শুরু করে এবং এর ফলে বহু মার্কিন বাণিজ্য জাহাজের সলিলসমাধি ঘটে। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির পক্ষে যোগদান করতে পারে, এই আশঙ্কায় জার্মানি মেক্সিকোর সঙ্গে গোপনে একটি আঁতাত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালায় এবং ১৮৪৬–৪৮ সালের মার্কিন–মেক্সিকান যুদ্ধে মেক্সিকো কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ চালাতে মেক্সিকোকে প্ররোচিত করে। এসবের প্রতিক্রিয়ায় ১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ইতালীয় রণাঙ্গনে ইতালি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে তাদেরকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ১৯১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ওসমানীয় রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি মিত্রশক্তিতে যোগদান করেনি। এর পরিবর্তে তারা মিত্রশক্তির ‘সহযোগী শক্তি’ (Associated Power) হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, অবশ্য ইতালীয় রণাঙ্গনে এবং বিশ্বের মহাসাগরগুলোতেও তারা কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ১৯১৭ সালে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা প্রদানের পর মিত্রশক্তি রাশিয়ায় যে আক্রমণ পরিচালনা করে, সেটিতেও যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯১৬ সাল নাগাদ মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তির মধ্যেকার যুদ্ধ কার্যত অচলাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং ১৯১৭ সাল নাগাদ রাশিয়া ও ইতালির বিপর্যয়ের ফলে এটি প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, কেন্দ্রীয় শক্তি যুদ্ধে বিজয়ী হতে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মিত্রশক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের (এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পদের) যোগদান ক্ষমতার ভারসাম্যকে মিত্রশক্তির অনুকূলে নিয়ে আসে। ১৯১৮ সাল নাগাদ জার্মানি আর পশ্চিম রণাঙ্গনে তাদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে পারছিল না, অন্যদিকে প্রতিদিন গড়ে ১০,০০০ মার্কিন সৈন্য পশ্চিম রণাঙ্গনে এসে পৌঁছাচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে সেখানে কেন্দ্রীয় শক্তির চূড়ান্ত আক্রমণাভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর নাগাদ কেন্দ্রীয় শক্তি পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশগুলো থেকে আগত প্রায় ৪৭,৪৪,০০০ সৈন্য এই মহাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। এদের মধ্যে ১,১৬,৭০৮ জন নিহত এবং ২,০৫,৬৯০ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিগুলোতে স্বাক্ষর করেনি। যুক্তরাষ্ট্র পৃথকভাবে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে।
সার্বিয়া
‘সার্বিয়া রাজ্য’ (সার্বীয়: Краљевина Србија) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির একটি ‘সহযোগী মিত্র’ (Associated Ally) ছিল। সেসময় সার্বিয়া ছিল বলকান অঞ্চলে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং তারা নিজেদের নেতৃত্বে বলকান অঞ্চলে একটি ‘দক্ষিণ স্লাভিক’ রাষ্ট্র গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিল। উল্লেখ্য, সার্ব, ক্রোট, বসনিয়াক, মন্টিনিগ্রিন, মেসিডোনীয়, স্লোভেন ও বুলগেরীয় জাতি দক্ষিণ স্লাভিক মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত।
১৮৭৭–৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধের ফলে সার্বিয়া ওসমানীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু ভূখণ্ডগত বিরোধের কারণে প্রতিবেশী দক্ষিণ স্লাভিক রাষ্ট্র বুলগেরিয়ার সঙ্গে তাদের তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তদুপরি, সার্বিয়া এই অঞ্চলে বৃহত্তর স্লাভ জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছিল এবং সার্বিয়ার বৃহৎ প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি আশঙ্কা করছিল যে, এর ফলে তাদের অধীনস্থ স্লাভ–অধ্যুষিত ভূমিগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে পড়ে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির অখণ্ডতাকে হুমকির সম্মুখীন করতে পারে। তদুপরি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও জার্মানি নিজেরাও বলকান অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী ছিল। ১৯০৮ সালে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি আনুষ্ঠানিকভাবে স্লাভ–অধ্যুষিত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দখল করে নেয় এবং সার্বিয়া এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, কারণ সার্বিয়া নিজেই অঞ্চলটি অধিকার করতে আগ্রহী ছিল।
এরপর বলকান অঞ্চলে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সম্প্রসারণ রোধ করার উদ্দেশ্যে রুশ সমর্থনে সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, বুলগেরিয়া ও গ্রিস মিলে ‘বলকান লীগ’ গঠন করে এবং প্রথম বলকান যুদ্ধে এই জোট ওসমানীয় রাষ্ট্রকে পরাজিত করে ওসমানীয় রাষ্ট্রের সিংহভাগ ইউরোপীয় ভূখণ্ড দখল করে নেয়। কিন্তু অধিকৃত ভূখণ্ডের ভাগাভাগি নিয়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং অচিরেই সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও গ্রিস (এবং পরবর্তীতে রুমানিয়া ও ওসমানীয় রাষ্ট্র) দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধে বুলগেরিয়াকে পরাজিত করে তাদের অধিকৃত ভূখণ্ড অধিকার করে নেয়। বলকান যুদ্ধদ্বয়ের ফলে সার্বিয়ার ভূখণ্ড রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সার্বিয়ার ক্রমবর্ধমান শক্তি ধ্বংস করার জন্য সচেষ্ট হয়। ১৯১৪ সালের ২৮ জুনে সংঘটিত অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় যুবরাজের হত্যাকাণ্ডকে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এই হত্যাকাণ্ডকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, যার মধ্য দিয়ে আরম্ভ হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
পরবর্তীতে সার্বিয়া তাদের মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে ১৯১৪ সালের ৬ আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে এবং ২ ডিসেম্বর ওসমানীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সার্বিয়া দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয়। ১৯১৫ সালের ১৪ অক্টোবর বুলগেরিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এরপর জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার সম্মিলিত সৈন্যদল সার্বিয়া আক্রমণ করে রাষ্ট্রটি দখল করে নেয়। সার্বীয় সেনাবাহিনী গ্রিসে পশ্চাৎপসরণ করে এবং সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। অবশেষে ১৯১৮ সালে মিত্রশক্তির সহায়তায় তারা সার্বিয়া পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
মোট ৭,০৭,৩৪৩ জন সার্বীয় সৈন্য এই মহাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়। এদের মধ্যে প্রায় ২,৭৫,০০০ জন নিহত এবং ১,৩৩,১৪৮ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে সার্বিয়া অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে দালমাসিয়া, কার্নিয়োলা, নিম্ন স্তিরিয়া, করিন্থীয় মেজা উপত্যকা ও জেজেরস্কো অঞ্চল, হাঙ্গেরির কাছ থেকে ক্রোয়েশিয়া–স্লাভোনিয়া ও অন্যান্য স্লাভ–অধ্যুষিত অঞ্চল এবং বুলগেরিয়ার কাছ থেকে ২,৫৬৭ বর্গ কি.মি. ভূখণ্ড লাভ করে।
মন্টিনিগ্রো
‘মন্টিনিগ্রো রাজ্য’ (সার্বীয়: Краљевина Црна Горa) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির একটি ‘সহযোগী রাষ্ট্র’ ছিল। সেসময় মন্টিনিগ্রো ছিল বলকান অঞ্চলে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী সার্বিয়ার সঙ্গে তাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। সার্বিয়ার মতো মন্টিনিগ্রোতেও বৃহত্তর স্লাভ জাতীয়তাবাদ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিল এবং মন্টিনিগ্রোর জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর একত্রীকরণের পক্ষে ছিল। মন্টিনিগ্রো প্রথম ও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধে সার্বিয়ার পক্ষে ছিল এবং যথাক্রমে ওসমানীয় রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
নিজস্ব ভূখণ্ডের পরিমাণ বৃদ্ধি ও আদ্রিয়াতিক সাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং সার্বিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে মন্টিনিগ্রোর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল মন্টিনিগ্রোর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রধান কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর মন্টিনিগ্রো প্রাথমিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু মন্টিনিগ্রোর জনমত ছিল সম্পূর্ণভাবে সার্বিয়া ও রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের পক্ষপাতী। ফলে যথাক্রমে সার্বিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য মন্টিনিগ্রো ১৯১৪ সালের ৫ আগস্ট অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে এবং ৮ আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ওসমানীয় রাষ্ট্র কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণ এবং বুলগেরিয়া কর্তৃক সার্বিয়া আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে মন্টিনিগ্রো ১৯১৪ সালের ২ ডিসেম্বর ওসমানীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং ১৯১৫ সালের ১৫ অক্টোবর বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এই যুদ্ধ চলাকালে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো যৌথভাবে সার্বিয়ার ওপর অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির আক্রমণ প্রতিহত করে, কিন্তু ১৯১৫ সালে জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়া সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালিয়ে সার্বিয়া দখল করে নেয়। এরপর মন্টিনিগ্রো সার্বিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি মন্টিনিগ্রোর ওপর আক্রমণ চালায় এবং ১৯১৬ সালের জানুয়ারিতে তাদেরকে পরাজিত করে মন্টিনিগ্রো দখল করে নেয়। এরপর মন্টিনিগ্রো অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। অবশেষে ১৯১৮ সালে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি মিত্রশক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং মন্টিনিগ্রো মুক্ত হয়।
প্রায় ৫০,০০০ মন্টিনিগ্রিন সৈন্য এই মহাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে প্রায় ৩,০০০ জন নিহত এবং প্রায় ১০,০০০ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পরপরই মন্টিনিগ্রো সার্বিয়ার সঙ্গে একত্রিত হয় এবং নবগঠিত যুগোস্লাভিয়ায় যোগদান করে।