বৃত্রের জন্মের পরে তার পিতা ত্বষ্টা তাকে ইন্দ্র ও দেবতাদের প্রতি প্রতিশোধের ব্যাপারে সচেতন করেন এবং শিবের আরাধনা করে অমরত্ব লাভের নির্দেশ দেন। বৃত্র কঠিন তপস্যা শুরু করে। ভক্তের ডাকে মহাদেব না এসে পারেন না। বৃত্র শিবের কাছে বর চায় – কোনো দেব, দানব, যক্ষ, মানব তথা কোনোপ্রকার প্রচলিত অস্ত্রে যেন তার বধ না হয়। মহাদেব ‘তথাস্তু’ বলে বিদায় হন। বৃত্রের হাসির রোলে আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার উপক্রম হয়। ইন্দ্রের সভা কেঁপে ওঠে। বৃত্র পরিণত হয় বৃত্রাসুরে। পিতার অপমান ও ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে স্বর্গ আক্রমণ করে সে।
কোনো দেবতার কোনো অস্ত্র তার একটি চুলও বাঁকা করতে পারে না। বৃত্রাসুর ইয়া বড় এক হাঁ করে ইন্দ্রকে গিলে ফেললে দেবতারা তার উপর ‘জৃম্ভকাস্ত্র’ প্রয়োগ করে। এটি এমন অস্ত্র, যেটির প্রভাবে হাই ওঠে এবং শরীর শিথিল হয়ে আসে। রাক্ষস হাই তোলার সাথে সাথে ইন্দ্র রাক্ষসের মুখের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসেন। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও বৃত্রাসুর স্বর্গ দখল করে সকল দেবতাকে স্বর্গ থেকে বের করে দেয়।
দেবতারা জোট বেঁধে বৈকুণ্ঠধামে গেলে বিষ্ণু তাদের শিবের কাছে যেতে বলেন। শিব সকলের কথা শুনে গম্ভীর গলায় বলেন,
“বৃত্রকে তো কোনো অস্ত্রই ঘায়েল করতে পারবে না। ওকে মারতে হবে নতুন এক অস্ত্রে। ঠিক অস্ত্র না, আবার যাতে অসুরকে বধ করতে পারে এমন তেজীয়ান কিছু।”
মহাদেব তাদের নৈমিষারণ্যে ঋষি দধীচির আশ্রমে যেতে বলেন। জায়গাটির নাম নৈমিষারণ্য; কারণ, একবার সেখানকার বনে প্রচুর অসুরের উৎপাত হলে ভগবান বিষ্ণু নিমেষের মধ্যে সব অসুর বিতাড়িত করেছিলেন। দধীচির পিতা এবং অথর্ববেদের রচয়িতা ঋষি অথর্বন সেখানে আশ্রম গড়ে তোলেন। দধীচি দধি বা দই থেকে শারীরিক পুষ্টির চাহিদা মেটাতেন বলে তার নাম দধীচি। দধীচির হাড় মহাদেবের বরেই মহাশক্তিশালী দিব্য বজ্রে পরিণত হয়েছিল। একবার দক্ষের কন্যা সতী দধীচি ঋষির আশ্রমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখনও শিবের সাথে তার বিয়ে হয়নি। তখন সপ্তর্্ষির অন্যতম ঋষি অঙ্গিরার পুত্র, সদাবিশ দধীচির সাথে দেখা করতে আসলে তারকাসুরের পাঠানো রাক্ষস তার ওপর ভর করে সতীর অনিষ্ট করতে উদ্যত হলে দধীচি তাকে বাধা দেন। তারকাসুর সতীকে মারতে চাইত কারণ তাকে মহাদেব বর দিয়েছিলেন যে, একমাত্র শিবের পুুুুুুুত্রের হাতেই তার বিনাশ হবে এবং সতীর সাথে শিবের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। শিব-সতীর বিয়ে হয়ে যাতে তারা সন্তান লাভ করতে না পারে তাই জন্য সতীকে মারতেে চাইছিল তারকাসুর। রাক্ষসের সাথে হাতাহাতিতে দধীচির হাড় ভেঙে যায়। তখন শিবভক্ত দধীচি শিবকে ডাকলে মহাদেব এসে দধীচিকে উদ্ধার করে বজ্রহাড়ের বর দেন।
দধীচির হাড়ের বজ্রে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে আরো কয়েকটি কাহিনী চালু আছে। একবার দেবতারা অসুরদের সাথে ভয়ংকর লড়াই শেষে জয়লাভ করলেও বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে সবাই। ভারি ভারি অস্ত্রগুলো স্বর্গে বয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি না থাকার দরুন সবাই নিকটতম নিরাপদ স্থান ঋষি দধীচির আশ্রমে তার তত্ত্বাবধায়নে অস্ত্রগুলো জমা রাখেন। অনেকদিন দেবতারা তাদের অস্ত্রের কোনো খোঁজ-খবর নেন না। অসুরেরা আশ্রমে চুরির উৎপাত শুরু করলে তাদের হাত থেকে সেগুলো বাঁচাতে দধীচি সবগুলো অস্ত্র তার দিব্যজলে গুলে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলেন। সেসব অস্ত্রের তেজেই নাকি তার হাড়গুলো বজ্রে পরিণত হয়।
সে যা-ই হোক, বৃত্র থেকে রক্ষা পেতে দেবতারা বিব্রতভাবে দধীচির আশ্রমে প্রবেশ করেন। তারা ইতস্তত করা শুরু করেন মুনির সামনে। লাজ ভেঙে দেবরাজ ইন্দ্র বলতে গেলে দধীচি ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“আমি যোগবলে সব জানতে পেরেছি। জানি, তোমরা কেন এসেছ। এ নশ্বর দেহ দান করে যদি দেবলোকের কোনো উপকার হয় তবে নিশ্চয়ই আমি তা করব।”
দেবতারা তার কথা শুনে আঁতকে ওঠেন। চারদিকে ধন্য ধন্য রব ওঠে। দধীচি তপোবলে দেহ ত্যাগ করলে ইন্দ্র দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে ডেকে তার দেহ থেকে হাড় বের করে দিব্যাস্ত্র বানিয়ে দিতে বললে বিশ্বকর্মা বলেন,
“মহামুনি দধীচির দেহ চিরে হাড় বের করা আমার কম্ম নয়। কেউ হাড় বের করে দিলে আমি অস্ত্র বানিয়ে দিতে পারি।”
তখন গোদলকে ডাকা হয়। গরুরা এসে গুঁতিয়ে মুনির দেহ থেকে হাড় বের করে দিলে বিশ্বকর্মা তা থেকে বজ্রাস্ত্র নির্মাণ করেন। আকাশের বজ্রের মতো সেই অস্ত্র। যার উপর নিক্ষেপ করা হবে, সাথে সাথে সে ছাই হয়ে যাবে। ইন্দ্র সে অস্ত্র নিয়ে ঐরাবতে চড়ে স্বর্গ পুনরুদ্ধারে যান। এবার অসুর বাহিনী পরাজিত হয়। বৃত্রাসুর বধ হয়। ইন্দ্র বৃত্রের বধ করেন। পরাজিত অসুরেরা সমুদ্রের তলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।
পুরাণে দধীচিকে নিয়ে আরো কয়েকটি কাহিনী প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার হচ্ছে দধীচির মস্তকচূর্ণ হওয়ার ঘটনা। দেবতাদের চিকিৎসক হলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়। এরা দুই যমজ ভাই। সূর্যদেবের সন্তান। দেবতা হলেও তারা ইন্দ্র, বরুণ এদের চেয়ে নিম্নস্তরীয়। অশ্বিনীকুমারদের একবার ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করার ইচ্ছা হলো। এ বিদ্যা ত্রিভুবনে তখন একমাত্র দধীচি মুনির কাছেই ছিল। তারা দধীচির কাছে আসার পর জানতে পারলেন, তিনি তপস্যায় লীন। তারা তপস্যায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তপস্যা শেষ হলে দধীচিকে তাদের মনোবাঞ্ছাটি বলার পরে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “এখনো সময় হয়নি। কিছুদিন পরে এসো”। তারা চলে গেলেন। এদিকে ত্রিভুবনে ঘটনাটি রটে গেল। দেবরাজ ইন্দ্র ঘটনাটি শুনে খুব চটে গেলেন। তিনি দধীচির কাছে এসে বললেন,
“যদি আপনি অশ্বিনীকুমারদের ব্রহ্মবিদ্যা দান করেন, তবে আমি অভিশাপ দিচ্ছি বিদ্যা দান করার সাথে সাথে আপনার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে”।
মুনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। কয়দিন বাদে অশ্বিনীকুমারেরা তার আশ্রমে হাজির। তাদের কাছে মুনি সব ঘটনা খুলে বললেন। একটু ভেবে তারা জবাব দিলেন,
“এ কোনো সমস্যাই নয়, মুনিবর। এর প্রতিকার আমাদের কাছে আছে। আমরা আপনার মাথা কেটে সেখানে একটি ঘোড়ার মাথা লাগিয়ে দেবো। তারপর ঘোড়ার মুখ দিয়ে আপনি ব্রহ্মবিদ্যা দান করবেন। ঘোড়ার মাথা চূর্ণ হয়ে গেলে আমরা সাথে সাথে আপনার নিজের মাথা ধড়ে লাগিয়ে দেব।”
কথাটি মুনির মনঃপুত হলো। সে অনুযায়ীই কাজ করলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়। ঘোড়ার মাথা চূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে মুনির মাথা মুনির ধড়ে লাগিয়ে দিয়ে তারা মুনিকে প্রণাম করে, আশীর্বাদ নিয়ে নৈমিষারণ্য ত্যাগ করল।
বৃত্রবধ করে জয়ী হলেও এক জায়গায় পরাজিত হন ইন্দ্র। বৃত্রকে বধ করার সাথে সাথে ব্রহ্মহত্যা এক ভয়ানক রূপ ধারণ করে এসে ইন্দ্রকে ঘিরে ফেলে। ইন্দ্র পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। ব্রহ্মহত্যাও তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। কোথাও শান্তি নেই। শেষে ইন্দ্র গিয়ে এক বিরাট সরোবরের ভেতর একটি পদ্মের মৃণাল অর্থাৎ, ডাটার ভেতর সুতো হয়ে লুকিয়ে রইলেন। পৃথিবীর হিসাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ বছর এবং স্বর্গের হিসাবে প্রায় এক হাজার বছর এভাবে লুকিয়ে রইলেন। ব্রহ্মহত্যাও সরোবরপাড়ে ইন্দ্রের অপেক্ষায় বসে রইল।
এতদিন দেবরাজকে না দেখতে পেয়ে সবাই বিচলিত হয়ে গেল। বিনা দেবরাজ স্বর্গসভা কীভাবে চলবে? তাই দেবতারা সবাই মিলে পৃথিবীর এক শক্তিমান রাজা নহুষকে গিয়ে ধরল, যাতে তিনি ইন্দ্র ফিরে না আসা পর্যন্ত ইন্দ্র হয়ে স্বর্গের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। নহুষ এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। সব দেবতারা অভিষেক করে নহুষকে দেবরাজের আসনে বসানোর কিছুদিনের ভেতর তার মতিভ্রম ঘটল। তিনি ইন্দ্রের পত্নী শচীকে বিয়ে করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। শচী পড়লেন মহাবিপদে।
শচী গিয়ে দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে আশ্রয় চাইলেন। বৃহস্পতি তাকে আশ্রয় দিলেন, তবে নহুষের ব্যাপারে সতর্কও করলেন। বুদ্ধিমতী শচী নহুষকে ছলনার দ্বারা বাগে আনার চেষ্টা করলেন। প্রথম নহুষের কাছে কিছুদিন সময় চাইলেন। নহুষ হাসিমুখে সময় দিলেন। তারপর শচী সব দেবতাকে নিয়ে ইন্দ্রকে খুঁজতে বের হলেন। সন্ধ্যাদেবীর আরতি করলেন। সন্ধ্যাদেবী প্রসন্ন হয়ে তাকে ইন্দ্রের কাছে পৌঁছে দিলেন।
ইন্দ্রের দুর্দশা দেখার পর সবাই একসাথে বসে ঠিক করলেন যে, কোনো পবিত্র নদীর জলে ইন্দ্রকে স্নান করালে ব্রহ্মহত্যা তার পিছু ছাড়বে। প্রথমে গৌতমী নদীতে স্নান করানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও মহর্ষি গৌতমের অনিচ্ছার কারণে তা হলো না। পরে ইন্দ্রকে নর্মদাতে স্নান করানো হয়। নর্মদাফেরত ইন্দ্রর গৌতমীতে স্নান করার পক্ষে আর কোনো বাধা থাকে না। গৌতমীতে স্নান শেষে ব্রহ্মদেব এসে তার কমণ্ডুলুর জল দিয়েও ইন্দ্রকে শুদ্ধ করেন। এভাবে ব্রহ্মহত্যা থেকে নিস্তার মেলে ইন্দ্রের।
এদিকে স্বর্গে নহুষ হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেন। শচী ফিরে এসে নহুষকে তার ঘরে আসার অনুমতি দেন, তবে সাথে একটি শর্তও জুড়ে দেয়। শর্তটি হচ্ছে, কোনো চাকা বা জন্তুটানা গাড়িতে নয়; নহুষকে আসতে হবে মুনিটানা গাড়িতে। অর্থাৎ, নহুষের পালকি টানবেন মুনি- ঋষিরা। সেভাবেই একটি পালকি প্রস্তুত করা হলো। নহুষ পালকিতে চড়ে শচীর কথা ভাবতে ভাবতে মনের আনন্দে পুলকিত হচ্ছেন।
অগোচরেই হঠাৎ তার পা দিয়ে লাগল অগস্ত্য মুনির মাথায়। এ অগস্ত্যই ‘অগস্ত্য যাত্রা’র অগস্ত্য। মুনিবর ক্ষেপে গিয়ে নহুষকে “সর্প হও” বলে অভিশাপ দেন। নহুষ তৎক্ষণাৎ একটি বিশালাকার সাপে পরিণত হয়ে হিমালয়ের পাশে পতিত হয়। যাবার আগে মুনির কাছে ক্ষমাভিক্ষা করলে মুনির মনে দয়া হয় এবং তিনি শাপ থেকে মুক্তির পথ বাতলে দেন। মুনি বলেন, “দ্বাপর যুগের শেষে এবং কলি যুগের প্রারম্ভে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের সংস্পর্শে এলে তোমার শাপমোচন হবে”। পরে, যুধিষ্ঠিরের সংস্পর্শে এসে নহুষের শাপমুক্তি হয়েছিল।
নহুষের পতন হলে দেবতারা আবার ইন্দ্রকে দেবরাজ পদে অভিষিক্ত করে। সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে দেবলোক। কিন্তু কিছুকাল পরে ইন্দ্রের আবার মতিভ্রম ঘটে, যার দরুন দেবতারা আবার বিপদের মুখে পতিত হয়। সে বিপদ থেকে বাঁচতে দেবতারা অসুরদের সাহায্য নিয়ে অমৃতের খোঁজে অমৃতমন্থন করেছিলেন। সেই গল্প থাকছে পরের পর্বে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।