সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্য নয়, তবে সিনেমার প্রথম দিকেরই একটা দৃশ্যের কথা বলা যাক। কারণ সিনেমার প্রকৃতি এবং চরিত্রদের পরবর্তীর অবস্থা বুঝতে এই দৃশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাড়িতে যেতে যেতে এক পুলিশ অফিসার পাশের জনকে বলছে, কিছুক্ষণ আগে থানায় বয়ান নেওয়া সেই অভিযুক্তকে মেরে ফেলতে হবে। ওই ছেলের প্রেমিকা এক মন্ত্রীর আত্মীয়। নিচু জাতের ছেলে। তাই মিনিস্টারের নির্দেশে খুনটা তাদের করতে হবে। এরপরই সে একটা কথা বলে ওঠে,
“একজন ভাড়াটে গুণ্ডারও ক্ষমতা থাকে খুন করবে কি করবে না, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার, আমাদের তাও নেই।”
পুলিশ অফিসারের এই কথাটাই ক্ষমতাধর মহলের নির্দেশে তাদের নোংরা কাজকারবারের দিকটা এবং সেটার হতাশাজনক অবস্থা ব্যক্ত করে। তো মন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছালে ওই পুলিশ অফিসার কেরোসিনের বোতলটা একটা জানালার উপরে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এবং রিপোর্টে লেখা হয়, ওই প্রেমিক ছেলেটাই আগের দিন রাতে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে তাদের সবাইকে মারার চেষ্টা করেছে। ব্যস, দাখিল হয়ে গেল একটা মিথ্যা অভিযোগ। ফেরার পথে দুই পুলিশের নীরবতাই তাদের অসহায়ত্বের জানান দেয়। ঘটনাটা সিনেমার বাকি ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিদ্রূপাত্মক দিক হিসেবে কাজ করে। কারণ পরে এরকমই এক সাজানো ঘটনা আর রাজনৈতিক ইস্যুর মারপ্যাঁচে তিন পুলিশ অফিসারকেই যে পড়তে হয়।
সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যে দুটো পক্ষকে কাবাডি খেলতে দেখা যায়। খেলার বিরতি, ভেতরকার নানান উত্তেজনা, হৈচৈ মিলিয়ে বেশ দীর্ঘ একটি দৃশ্য। মূলত দুই পুলিশ অফিসারের মাঝে সিপিও প্রবীণের চরিত্রটাকে ভিত দিতেই এই দৃশ্যের অবতারণা। কিন্তু সেটা কার্যকরী কিছু হয়নি। বরং বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে। এ দৃশ্য ছাড়াই চরিত্রটি সম্বন্ধে দর্শক ধারণা পেত। এ.এস.আই. মনিয়ানের চরিত্রটার মানবিক দিক সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার দৃশ্যটা আবার সিনেমায় কার্যকরী হয়েই কাজ করেছে। মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। নাচে, গানে পারদর্শী করে তুলতে চায় মেয়েকে। সেটা নিয়ে অন্যের সামনে আবার গর্ববোধ করতে সংকোচ বোধ করে না। প্রবীণকে ঘরে এনে মেয়েকে কাছে ডেকে গান গাইতে বলা, তার নাচের মুদ্রা মোবাইলে দেখানোতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মূলত একটা দুর্ঘটনায় মারা পড়া রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যুটাকে রাজনৈতিক হত্যায় রূপ দিয়ে তিন পুলিশকে শিকার বানানোর মধ্য দিয়েই গল্প এগিয়ে যায়। ঘটনাটা সিপিও সুনিতাকে ঘিরে শুরু। রাজনৈতিক নেতার ছায়াতলে থাকা, তার এক বখাটে কাজিন তার পরিবারকে থাকার জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর। সুনিতা পুলিশে থাকার পরো রাজনৈতিক ক্ষমতার সামনে সে ধরাশায়ী। পুলিশ স্টেশনে এসেও তাই সে উদ্ধত হবার দুঃসাহস দেখায়। এবং তাকে ঢোকানো হয় সেলের ভেতরে। আর সেখান থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে নাটকীয় দ্বন্দ্ব আর ক্রোধের শুরু। সিপিও প্রবীণের অসাবধানতায়, সুনিতার ষণ্ডামার্কা কাজিনের মোবাইল মেঝেতে পড়ে যায়। সে প্রবীণকে বলে, মোবাইলটা মেঝে থেকে তুলে দিতে। স্বাভাবিকভাবেই সেটা লাগে প্রবীণের অহমে। এর জের ধরেই তাদের হাতাহাতি।
মনিয়ান ওই ছোকরাকে ভরে জেলে। থানার বাইরে তার সঙ্গীসাথিরা একটা গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পিস্তল বের করে মনিয়ান। ফোনে সেটা ভিডিও রেকর্ড করে একজন। নেতার চাপে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও স্নায়ুযুদ্ধ বরং আরো অভিঘাতী হয়ে ওঠে। সে রাতের ঘটনা। এক বিয়েতে গিয়েছিল পুলিশ তিনজন। মদ্যপ থাকায় তাদের গাড়ি চালানোর দায়ভার মনিয়ান তার শ্যালককে দিয়েছিল। কিন্তু মদ্যপ না হয়েও দুর্ঘটনা শ্যালকই ঘটাল। একটা মোটরসাইকেলের সাথে সংঘর্ষ। অকুস্থলেই মারা গেল আরোহী। ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে গেল প্রবীণ, মনিয়ান আর সুনিতা। মৃত যুবক সকালের ওই গুণ্ডা দলেরই একজন। নিজেদের ক্যারিয়ার, কেস এবং বাকি সবকিছু চিন্তা করে মনিয়ান লাশটাকে পাশেই কোথাও ফেলে ছুট লাগাতে চাইল। কিন্তু তার আগেই এসে পড়ল ওই দলের আরেকটা গাড়ি।
ঘটনা সাজাতে মনিয়ান ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয় লাশকে হাসপাতালে নিতে। হত্যার দায়টাকে দুর্ঘটনায় রূপান্তর যদি করা যায়, এই আশায়। কিন্তু ডাক্তার বলেই দিল, হাসপাতালে আনার আগেই ওই লোক মারা গেছে। সুনিতার ওই কাজিন মুহূর্তেই ঘটনার মোড় বদলে দিল, পুলিশ তাদের উপর শোধ নিতে এই কাজটা করেছে। এভাবেই দুর্ঘটনায় মৃত্যুটা এবার হয়ে গেল রাজনৈতিক বিষয়। প্রাণ বাঁচাতে তিন পুলিশ পালিয়ে গেল। নির্বাচন সন্নিকটে। সেই মন্ত্রীটি নিজের গদিতে কোনো কাঁটা না রাখতে তাদের তিনজনকে তীরের লক্ষ্যে রাখলো। এবং সাথে ‘নায়াট্টু’ ড্রামা থেকে সরাসরি সারভাইভ্যালের জনরার ভিড়ে ছুটতে শুরু করল।
মালায়ালাম সিনেমা ‘নায়াট্টু’, মূলে একটি ড্রামা সিনেমা। কিন্তু গোটা সফরে আরো বেশকিছু জনরাকেই স্পর্শ করে গেছে। এতে সাসপেন্স আছে, থ্রিলারের কড়চা আছে, কখনো পুলিশি প্রক্রিয়াভিত্তিক সিনেমা হয়ে উঠেছে, আবার সমাপ্তিতে গিয়ে সমাজবাস্তবতার তিক্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। তা বলে খুব কুণ্ডলিত কিছু হয়ে জট পাকিয়েছে, সে ধারণার সুযোগ নেই। সূক্ষ্মতা, স্পষ্টতা দুই ধরেই রেখে ধীরে ধীরে প্রতিটি স্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে সিনেমা। প্রথম অঙ্কের অর্ধেক দেখে তো মনে হয়, এটি একটি চরিত্রনির্ভর কাজ হতে যাচ্ছে। কিন্তু তেমনটা নয়। গল্প, চরিত্র- দুটোতেই সমান মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
গল্পে বক্তব্যের প্রচুর জায়গা ছিল। এবং চিত্রনাট্যের, সেই বক্তব্যগুলো যথাযথ ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে উপস্থাপনের দায় ছিল, যা নৈপুণ্যের সাথেই শাহী কবির তার লেখনীতে আনতে পেরেছেন। নিজে পুলিশে থাকায়, পুলিশি তদন্তের চিত্রটাকে খুবই ডিটেলে আর বাস্তবিকভাবে লিখেছেন তিনি। তার চিত্রনাট্য কখনোই একপাক্ষিক অবস্থান নেয়নি। দলিত ইস্যুটাই দেখা যাক। সিনেমার দুই সিপিওই দলিত। তাদের বঞ্চিত হওয়ার জায়গাটা যেমন এসেছে, তেমনি সুনিতার ওই কাজিনের চরিত্রটি দিয়েই এটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চিত্রটাও এসেছে।
‘নায়াট্টু’ নৈতিক দ্বন্দ্বের জায়গাটাকে যেমন উপস্থাপন করেছে, তেমনি বৃহৎ শক্তির কাছে যে-কেউই যে অসহায়, সেই চিত্রটাও তুলে এনেছে বাস্তবিক আয়রনির ব্যবহার করে। পুলিশ উপরমহলের নির্দেশে নানান অপরাধকেই চাপা দেয়, নিরপরাধ কাউকে অপরাধী বানায়। লেখার একদম শুরুতেই যে কথাটা উল্লেখ করেছিলাম। আবার ফাঁপরে পড়লে, সেই উপরমহলেরই আরেক নির্দেশে পুলিশকেই সাধারণ জনতার মতো প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে হয়। এখানেই বাস্তবিক আয়রনি। আর এই বাস্তবতাটা অকপটেই তুলে আনে সিনেমাটি।
প্রথমে পুলিশের চরিত্রটাকে একটা ধূসর জায়গায় দেখায়। তাদের তিনজনের নৈতিকতার দ্বন্দ্বটাকে সামনে আনে। পরে ভাগদৌড়ের মধ্য দিয়ে তাদেরকে আরো মানবিক আর সাধারণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাদের প্রতি সহমর্মিতা জাগানো হয়। পোশাকটা ছাড়লে তারাও যে সাধারণ মানুষ, ক্ষমতার কাছে তারাও যে বলির পাঁঠা হতে পারে যেকোন সময়ই; তা-ই বলে যায় এ সিনেমা। শুধু কেরালা নয়, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চালচিত্র আর সমাজ বাস্তবতাকেই উপস্থাপন করে ‘নায়াট্টু’।
সিনেমার বক্তব্যের জায়গাগুলো সকলের অভিনয়ে স্পষ্টতা এবং ওজন পেয়েছে। নানান পরিস্থিতির মুখে চরিত্রগুলোকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং তারা পরিস্থিতিটা বুঝে পরিমিত অভিনয়ই দিয়েছেন। এ.এস.আই. মনিয়ান চরিত্রে জোজু জর্জের আধিপত্য স্বভাবতই চোখে পড়বে। বাকি দু’জনের চাইতে সে বয়সে সিনিয়র হবার পাশাপাশি পুলিশের র্যাংকিংয়েও সিনিয়র। এই জায়গাটা যে সে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে, তা তার শারীরিক উপস্থিতি এবং বাচিক অভিনয়; দুই ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়।
তবে সেজন্য বাকি দু’টি চরিত্র তার ছায়ায় পড়ে যায়নি। তাদের চরিত্রের যেমন আলাদা মাত্রা আছে, তেমনি কুঞ্চাকো বোবান নিমিষা সাজায়ানের অভিনয়ও যথেষ্ট স্তরীভূত। নিমিষার চরিত্রটা নীরব থাকে বেশিরভাগ সময়ে। তার বাকি দুই সহকর্মী পুরুষ। তাই অজান্তেই তাদের দৈহিকভাবে বলিয়ান উপস্থিতির সামনে সে নিজেকে কুঁকড়ে রাখে সে, যে গতিটা সাধারণভাবেই ভারতীয় সিনেমায় চোখে পড়ে।
এবং সে জায়গাতেই কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন আনে ‘নায়াট্টু’। যেমন ধরা যায়, বোবানের স্যানিটারি প্যাড কিনে আনার সেই দৃশ্যটা। সুনিতা চরিত্রটি মুখ ফুটে কিছু বলে না। কিন্তু তার নীরবতা এবং আগে থেকে আরো কুঁকড়ে থাকা দেখে বোবান আঁচ করতে পেরেছে সহকর্মীর ঋতুস্রাবের বিষয়। তাই সে প্যাড কিনে এনে নীরবেই তাকে দেয়। সংলাপ ছাড়াই ছোট এই দৃশ্যটি ভারতীয় সিনেমায় জেন্ডার ডায়নামিকের আগের চিত্রকে পাল্টে দেয়। এমন ছোট ছোট জায়গাগুলো চিত্রনাট্যটাকে আরো বহুমাত্রিক করেছে, সিনেমাকে করেছে আরো শক্তিশালী।
সিনেমায় সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন সাইজু খালিদ। ‘২২ ফিমেল কোট্টায়াম’, ‘মাহেশিন্তে প্রাথিকারাম’, ‘ই.মা.ইয়াউ’, ‘কুম্বালাঙ্গী নাইটস’ সিনেমাগুলোর সিনেমাটোগ্রাফার তিনিই ছিলেন। এই কাজগুলো পাশাপাশি রেখে দেখলে দেখা যাবে, গোটা ল্যান্ডস্কেপ তুলে ধরায় তার দক্ষতা আছে। ওয়াইড শটে প্রকৃতিকে যেমন ধরেন, তেমনি বাকি আবহের সাথে তার সাবজেক্টের গুরুত্বটাও জানেন তিনি। ব্লকিংটাও চমৎকার বোঝেন। এক্সপোজিশন কতটুকু করলে ঠিকঠাক টোনটা ভিজ্যুয়ালে পাওয়া যাবে, সেটা ঠিকঠাক ধরতে পারেন। ‘নায়াট্টু’তে তিনি প্রারম্ভিক দৃশ্যের ল্যান্ডস্কেপের পরে ক্যামেরাকে মিডিয়াম ক্লোজে রেখেছেন বেশিরভাগ।
দ্বিতীয় অঙ্কে চরিত্রগুলো পালিয়ে যখন কেরালার ইদুক্কি জেলার মুন্নারে আসে, তখনই তিনি তার ওয়াইড শট প্রীতিটা ভালোরকম প্রকাশ করেছেন। মুন্নারকে ‘দক্ষিণ ভারতের কাশ্মীর’ বলা হয়। এবং কেন বলা হয়, সেটার যে কেউই, সাইজু খালিদের ভিজ্যুয়াল দেখে আঁচ করতে পারবে। প্রকৃতির সৌন্দর্য আর সিনেমার চলমান উত্তেজনা; এইযে দুটো বৈপরীত্য, দুটোকে তিনি একদম পাশাপাশি রেখেই উপস্থাপন করেছেন তার ক্যামেরায়। আবহসঙ্গীতও ভিন্ন এবং সঙ্গতিপূর্ণ। পরিচালক মার্টিন প্রাক্কাত, তার আগের সিনেমা ‘চার্লি’, যেটা এ অঞ্চলে বহুল চর্চিত, সেটা থেকেও পরিচালক হিসেবে আরো পরিণত কাজ উপহার দিয়েছেন এখানে। চিত্রনাট্যের যথার্থ ভিজ্যুয়াল রূপই সৃষ্টি করেছেন, সম্পাদনার কাজেও সংহত হয়েছেন আরো।
‘নায়াট্টু’ চাইলেই আরো নিগূঢ় হতে পারত। উপাদান ছিল। কিন্তু হয়তো সর্বোপরি আবেদনের জায়গা থেকেই, অপেক্ষাকৃত কম নিগূঢ় রাস্তায় হেঁটেছে। কিছু স্থূল সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু আবার সূক্ষ্মতার প্রশংসাও করতে হয়, যা ভালোভাবেই তুলে আনা হয়েছে সিনেমায়। রাজনৈতিক আর সামাজিক চিত্রের যে হতাশাবাদী রূপকে ‘নায়াট্টু’ ধরতে নেমেছে, তাতে স্থির ছিল শেষ অব্দি। ক্ষমতার কাছে অসহায়ত্বের চিত্রটার অমোঘ রূপ দিয়েই ইতি টেনেছে। গা থেকে বাস্তবতা ঝেড়ে ‘ফ্যান্টাসি এন্ডিং’য়ে ভেড়েনি। কেননা, বাস্তবতা ওমনই। নির্দয় এবং পরিহাসকারী।