(পর্ব ১০ এর পর থেকে)
“এই [পারমাণবিক] অস্ত্রগুলোকে নিষিদ্ধ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা আমাদের দায়িত্ব!” (মার্কিন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে গিওর্গি ঝুকভ, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫)
১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিন–পরবর্তী সরকার মার্শাল গিওর্গি ঝুকভকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করে। ইতিপূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঝুকভ এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং পুনরায় এই পদ লাভ করার মধ্য দিয়ে তিনি আগের মর্যাদা ফিরে পান। ঝুকভের পদটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নতুন সরকারের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নে তার বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না এবং সোভিয়েত রাজনীতিতেও তার কোনো বড় ধরনের উপস্থিতি ছিল না।
তৎস্কোয়ে পারমাণবিক মহড়া: ঝুকভের এক অতি বিপজ্জনক দায়িত্ব
অবশ্য উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঝুকভের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল পারমাণবিক যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ১৯৪৯ সালের আগস্টে সোভিয়েতরা প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ১৯৫৩ সালের আগস্টে তারা প্রথমবারের মতো হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। কিন্তু এসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ছিল মাত্র ৫০টি পারমাণবিক বোমা, অন্যদিকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল ১,০০০টিরও বেশি পারমাণবিক বোমা। এর ফলে প্রতিরক্ষার জন্য কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর নির্ভর করা সোভিয়েতদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর ফলে সোভিয়েত প্রতিরক্ষা নীতি পারমাণবিক অস্ত্রের পাশাপাশি প্রচলিত সশস্ত্রবাহিনীরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
১৯৫৩ সালের শরৎকালে সোভিয়েতরা পশ্চিম ইউক্রেনের কার্পেথীয় সামরিক জেলায় একটি মহড়ার আয়োজন করে, যেটিতে সৈন্যদের ওপর কৃত্রিম পারমাণবিক আক্রমণ চালানো হয়। এই মহড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ ও পরিচালনায় ঝুকভ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এরপর সোভিয়েতরা সত্যিকার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি মহড়া করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সৈন্যদের সন্নিকটে একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো এবং সৈন্যদের ওপর এর প্রভাব পরীক্ষা করা। ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ উরালের তৎস্কোয়েতে ঝুকভের তত্ত্বাবধানে এই মহড়ার প্রস্তুতি আরম্ভ হয়।
পরিকল্পিত বিস্ফোরণের আগে স্থানীয় জনসাধারণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয় অথবা তেজষ্ক্রিয়তা থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি দেয়া হয়। সৈন্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, নিরাপত্তামূলক পোশাক সরবরাহ করা হয় এবং বিশেষভাবে নির্মিত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে মোতায়েন করা হয়। ঝুকভ নিয়মিতভাবে মহড়ার স্থান পরিদর্শন করতেন। ১৪ সেপ্টেম্বর উক্ত মহড়া আরম্ভ হয় এবং ঝুকভ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিকোলাই বুলগানিন ও সোভিয়েত হাই কমান্ডের অন্য সদস্যরা ১০ মাইল দূরে থেকে মহড়াটি পর্যবেক্ষণ করেন।
মহড়া শুরুর পর ভূমি থেকে ১,০০০ ফুট উচ্চতায় একটি মধ্যম আকৃতির পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। মহড়ায় অংশগ্রহণকারী ৪৫,০০০ সৈন্য বিস্ফোরণস্থল থেকে মাত্র ৩–৪ মাইল দূরে অবস্থান করছিল এবং বিস্ফোরণের পরপরই তারা পরিকল্পনা মোতাবেক বিস্ফোরণ অঞ্চলে অগ্রসর হয়। বিস্ফোরণের শক ওয়েভ এত তীব্র ছিল যে এর ফলে ঝুকভ ও হাই কমান্ডের সদস্যদের টুপি উড়ে গিয়েছিল! সামগ্রিকভাবে, মহড়াকে অত্যন্ত সফল হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ১৯৫৫ সালে গৃহীত ফিল্ড রেগুলেশন্সে এটি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই সময়ে ঝুকভের পরামর্শে পারমাণবিক অস্ত্রের দায়িত্ব বোমা নির্মাণ সংক্রান্ত শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্রবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঝুকভ: পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের প্রচেষ্টা এবং জেনেভা সামিট
১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে নিকিতা ক্রুশ্চেভের উদ্যোগে গিওর্গি মালেনকভ সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন এবং বুলগানিন এই পদে অভিষিক্ত হন। এর ফলে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদটি শূণ্য হয় এবং ৭ ফেব্রুয়ারি ঝুকভকে এই পদে নিযুক্ত করা হয়। একই দিনে তিনি মার্কিন সাংবাদিকদের একটি বিস্তৃত সাক্ষাৎকার প্রদান করেন এবং মার্কিন–সোভিয়েত সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্ব পৃথিবীকে নিরাপদ তো করেইনি, উল্টো আরো বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করেছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো হুমকি নয়, কিন্তু মার্কিনিরা সোভিয়েত ইউনিয়নের চতুর্দিকে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঝুকভ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন, কিন্তু এগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান ছিল চলমান সৈন্যসংখ্যা হ্রাসকরণ প্রকল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ, কিন্তু যুদ্ধের পর সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে ৩০ লক্ষে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের ফলে ১৯৫০–এর দশকের প্রথমদিক নাগাদ সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪ লক্ষে উন্নীত হয়। ১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর পর এই সংখ্যা কমিয়ে ৪৮ লক্ষে নামিয়ে আনা হয়।
ঝুকভ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আরো ২০ লক্ষ সৈন্যকে ছাঁটাই করা হয়। মূলত কৌশলগত ও অর্থনৈতিক কারণে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। ঝুকভ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে বিরাট আকৃতির সশস্ত্রবাহিনীর প্রয়োজন হ্রাস পেয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ব্যয় হ্রাস করা প্রয়োজন।
১৯৫৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘকে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যসংখ্যা হ্রাসকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ করার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। এই প্রস্তাবগুলো পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যসংখ্যা ১৫ লক্ষে নেমে আসত। ঝুকভ এই প্রস্তাবের জোরালো সমর্থক ছিলেন এবং এই ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে ক্রুশ্চেভের চেয়ে বেশি নমনীয় ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়নি।
তদুপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব পশ্চিম জার্মানিকে পুনরায় অস্ত্রসজ্জিত করতে থাকে এবং ১৯৫৫ সালের মে মাসে তাদেরকে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’র অন্তর্ভুক্ত করে। প্রত্যুত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের ওয়ারশতে তাদের পূর্ব ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে, যেটি পরবর্তীতে ওয়ারশ জোট হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। এই চুক্তিটির শর্তাবলি নির্ধারণ করেছিলেন ঝুকভ এবং সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিয়াচেস্লাভ মলোতভ। ঝুকভ প্রস্তাব করেন যে, ওয়ারশ চুক্তি ৮৫ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে একটি সামরিক সংস্থা গঠন করুক, যেটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩২টি ডিভিশন সরবরাহ করবে। কিন্তু ওয়ারশ জোটের একটি পরিপূর্ণ সামরিক জোটে পরিণত হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়।
১৯৫৫ সালের জুলাইয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম সামিট অনুষ্ঠিত হয়, যেটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। বুলগানিন, ক্রুশ্চেভ ও মলোতভের পাশাপাশি ঝুকভও এই সামিটে সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের অংশ ছিলেন। এই সামিটের আগে ঝুকভ ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডুইট আইসেনহাওয়ারের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য সাক্ষাৎ নিয়ে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে বেশ জল্পনাকল্পনা হয়েছিল, কারণ ঝুকভ ও আইসেনহাওয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরস্পরের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
কিন্তু তাদের সাক্ষাৎকারের ফলে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য অর্জিত হয়নি। সামিট চলাকালে ঝুকভ আইসেনহাওয়ারের সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ করেন, কিন্তু নিখিল ইউরোপীয় যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ নিয়ে তারা কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। ঝুকভ এসময় মন্তব্য করেন, “রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার আর জেনারেল আইসেনহাওয়ার এক মানুষ নন!” বস্তুত বিগত বছরগুলোতে আইসেনহাওয়ার ও ঝুকভ উভয়েই রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছিলেন এবং এজন্য সৈনিক হিসেবে তারা পরস্পরের সঙ্গে যতটা খোলামেলা ছিলেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে ততটা খোলামেলা হওয়া তাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
ঝুকভ এবং বিস্তালিনীকরণ
১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং এই কংগ্রেসে একটি ‘গোপন ভাষণে’ ক্রুশ্চেভ স্তালিনের কঠোর সমালোচনা করেন। এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিস্তালিনীকরণ (De-Stalinization) প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। একই কংগ্রেসে ঝুকভ পার্টির প্রেসিডিয়ামের বিকল্প সদস্য (alternate member) নির্বাচিত হন এবং এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে প্রবেশ করেন। তিনি সাধারণভাবে ক্রুশ্চেভের বিস্তালিনীকরণ নীতিকে সমর্থন করেন এবং স্তালিনের সময়ে গৃহীত বেশকিছু পদক্ষেপের নিন্দা করেন।
স্তালিনের আমলে যুদ্ধবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়া সৈন্যদেরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হত এবং তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। প্রাক্তন যুদ্ধবন্দি সৈন্যদের প্রতি বৈষম্য সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্তের জন্য যে কমিশন গঠিত হয়, ঝুকভ ছিলেন তার সভাপতি। তিনি প্রাক্তন যুদ্ধবন্দিদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ করার এবং তাদেরকে যথাযথ সুযোগ–সুবিধা প্রদান করার জন্য সুপারিশ করেন। অনুরূপভাবে, অপারেশন বার্বারোসার প্রথম পর্যায়ে লাল ফৌজের পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের অধিনায়ক জেনারেল দিমিত্রি পাভলভ ও অন্যান্য সেনানায়কদের ভীরুতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। তাদেরকে নির্দোষ ঘোষণা ও দায়মুক্তি প্রদানের ক্ষেত্রেও ঝুকভ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন।
পোলিশ সঙ্কট: সোভিয়েত–পোলিশ রাজনৈতিক সমঝোতা
এদিকে ক্রুশ্চেভের গোপন ভাষণের খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে পোল্যান্ডের জনসাধারণের মধ্যে ধারণা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ডে সোভিয়েতদের সহায়তায় যে কর্তৃত্ববাদী কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটির মৌলিক সংস্কার করা সম্ভব। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং সংস্কারপন্থী কমিউনিস্টরা পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে। এদিকে ১৯৫৬ সালের জুনে পোজনানে একটি আন্দোলনের সময় নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে শত শত আন্দোলনকারী নিহত হয়। এই সঙ্কটের ফলে পোলিশরা ভ্লাদিস্লাভ গোমুলকাকে পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পুনরায় অধিষ্ঠিত করে। গোমুলকা ১৯৪০–এর দশকে পার্টির নেতা ছিলেন, কিন্তু তাকে জাতীয়তাবাদী হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং এজন্য নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
গোমুলকা যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেন, সেগুলোর মধ্যে ছিল পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল কনস্তান্তিন রোকোসোভস্কির অপসারণ। রোকোসোভস্কি ছিলেন জাতিগতভাবে অর্ধেক পোল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষ সমরনায়কদের একজন। পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে তার অধিষ্ঠিত থাকাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের মিত্রতার রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এজন্য তার অপসারণের প্রস্তাব মস্কোয় উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
পোল্যান্ডে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে ১৯ অক্টোবর ক্রুশ্চেভ বিনা ঘোষণায় ওয়ারশতে পৌঁছান। তার সঙ্গে ছিলেন ঝুকভ ও অন্যান্য শীর্ষ সোভিয়েত সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রোকোসোভস্কিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে বহাল রাখা এবং সংস্কারের গতি শ্লথ করার জন্য গোমুলকাকে বাধ্য করা। সোভিয়েতদের প্রস্তাব না মানলে সোভিয়েতরা পোল্যান্ডে সামরিক হস্তক্ষেপ চালাবে, এই সম্ভাবনাও ছিল। গোমুলকা সোভিয়েতদের দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানান, কিন্তু সোভিয়েত নেতাদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট শাসন কিংবা সোভিয়েত–পোলিশ মিত্রতা কোনোটিই ঝুঁকিতে নেই। অবশ্য রোকোসোভস্কি তার পদ ছাড়তে বাধ্য হন।
হাঙ্গেরীয় সঙ্কট: ঝুকভের কঠোরতা
একই সময়ে ক্রুশ্চেভের গোপন ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় হাঙ্গেরিতে আরো বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দেয়। ২৩ অক্টোবর কমিউনিজমবিরোধীরা হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের প্রধান বেতারকেন্দ্র দখলের চেষ্টা করলে হাঙ্গেরীয় নিরাপত্তা পুলিশ তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গোটা শহরে সশস্ত্র বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং হাঙ্গেরীয় সরকার বিদ্রোহ দমনের জন্য সোভিয়েত সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে। সেদিন সন্ধ্যায় ঝুকভ প্রেসিডিয়ামের কাছে এই মর্মে প্রতিবেদন পেশ করেন যে, এক লক্ষ লোক বুদাপেস্টে বিক্ষোভ করেছে এবং বেতারকেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রেসিডিয়াম শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ঝুকভ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন।
সেসময় হাঙ্গেরিতে বা হাঙ্গেরির সন্নিকটে ৫টি সোভিয়েত ডিভিশন মোতায়েন ছিল এবং ২৪ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের জন্য ৩০,০০০ সোভিয়েত সৈন্য ও ১,০০০ ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বুদাপেস্টের কৌশলগত অবস্থানগুলো অধিকার করা এবং অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া। এই উদ্দেশ্যগুলো তারা সহজেই পূরণ করতে সক্ষম হয়, কিন্তু সোভিয়েত হস্তক্ষেপের ফলে সশস্ত্র বিদ্রোহের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। এই পর্যায়ে এসে পোল্যান্ডে যেরকম রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে, সেরকম সমঝোতার বিনিময়ে হাঙ্গেরি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে কিনা এই প্রসঙ্গে প্রেসিডিয়াম সদস্যরা ২৬ অক্টোবরের বৈঠকে আলোচনা করেন।
কিন্তু ঝুকভ সৈন্য প্রত্যাহারের বিরোধিতা করেন এবং এটিকে ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি হাঙ্গেরিতে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন এবং একটি দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। এদিকে হাঙ্গেরিতে ইমরে নেগির নেতৃত্বে একটি সংস্কারপন্থী কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে আসে। নেগিকে একজন ‘হাঙ্গেরীয় গোমুলকা’ হিসেবে মনে হচ্ছিল এবং তিনি এমন একটি রাজনৈতিক সমঝোতার আভাস দিচ্ছিলেন, যেটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও হাঙ্গেরীয় বিদ্রোহী উভয় পক্ষকেই সন্তুষ্ট করবে। এর ফলে ২৮ অক্টোবর প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে ঝুকভ সীমিত আকারে সৈন্য প্রত্যাহার এবং নেগির সরকারকে সমর্থন প্রদানের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। একই দিন হাঙ্গেরিতে যুদ্ধবিরতি হয় এবং সোভিয়েত সৈন্যরা বুদাপেস্টের বাইরে তাদের ব্যারাকে ফিরে যেতে শুরু করে।
৩০ অক্টোবর প্রেসিডিয়ামের আরেকটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কেবল হাঙ্গেরি নয়, সকল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গেই সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি সমতার সম্পর্ক গড়ে তুলবে, এই মর্মে একটি বক্তব্য প্রদান করা হবে। ঝুকভ মন্তব্য করেন যে, বক্তব্যটিতে জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা উচিত এবং রক্তপাত বন্ধ করার আহ্বান জানানো উচিত। কিন্তু একদিন পরেই সোভিয়েত নেতাদের মনোভাব সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ ছিল দুইটি। প্রথমত, ১ নভেম্বর নেগি হাঙ্গেরিকে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করেন এবং ওয়ারশ জোট থেকে হাঙ্গেরিকে প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়ত, ২৯ অক্টোবর সুয়েজ খালের ওপর কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপনের জন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল সোভিয়েত মিত্র মিসরের ওপর আক্রমণ চালায়। এর ফলে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, হাঙ্গেরির ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখালে সেটি পশ্চিমা বিশ্বকে লাভবান করবে এবং মিসরের সঙ্গে তারা হাঙ্গেরিকেও নিজেদের অক্ষে টেনে নেবে। ১ নভেম্বরের প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয়বার হাঙ্গেরিতে অভিযান চালানো উচিত কিনা, এই নিয়ে আলোচনা হয়। ঝুকভ সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে জোরালো মত ব্যক্ত করেন।
৪ নভেম্বর সোভিয়েতরা দ্বিতীয়বারের মতো হাঙ্গেরিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং তীব্র লড়াইয়ের পর কয়েক দিনের মধ্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ২,০০০ সোভিয়েত সৈন্য এবং প্রায় ২৫,০০০ হাঙ্গেরীয় বিদ্রোহী এই লড়াইয়ে হতাহত হয়। লড়াই চলাকালে ঝুকভ নিয়মিতভাবে অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রেসিডিয়ামকে অবহিত করেন। লড়াই শেষে জানোস কাদারের নেতৃত্বাধীনে একটি সোভিয়েত–সমর্থিত সরকার হাঙ্গেরির ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং শত শত হাঙ্গেরীয়কে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। নেগিকে গ্রেপ্তার করে সোভিয়েত ইউনিয়নে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি সেখানে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এর মধ্য দিয়ে হাঙ্গেরীয় সঙ্কটের অবসান ঘটে।
হাঙ্গেরীয় সঙ্কট চলাকালে ঝুকভের বলিষ্ঠ ভূমিকা সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের মধ্যে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে তার ৬০তম জন্মদিনে তাকে চতুর্থ বারের মতো ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পদকে ভূষিত করা হয় এবং সোভিয়েত সংবাদপত্রগুলোর সামনের পাতায় তার ছবির পাশাপাশি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও মন্ত্রিসভা কর্তৃক প্রেরিত জন্মদিনের শুভেচ্ছাও ছাপা হয়। উল্লেখ্য, ঝুকভ মাত্র দুজন সোভিয়েত নাগরিকের মধ্যে একজন, যারা ৪ বার ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পদকে ভূষিত হয়েছেন!
ঝুকভের ভারত, বার্মা ও পূর্ব জার্মানি সফর
১৯৫৭ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ঝুকভ ভারত ও বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) সফর করেন এবং এর উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র দুইটির সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। এই সফর ছিল খুবই সফল এবং ঝুকভ উভয় রাষ্ট্রেই সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন। ভারত সফরকালে ঝুকভ হাতির পিঠে চড়েছিলেন এবং এই ঘটনার ছবিটি প্রচারিত হয়। বস্তুত ঝুকভের এই সফর ব্যাপক প্রচারণা লাভ করে এবং ঝুকভ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রত্যাবর্তন করার পর তার ভারত ও বার্মা সফর নিয়ে একটি রঙিন প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশিত হয়।
মার্চে ঝুকভ পূর্ব জার্মানি সফর করেন এবং পূর্ব জার্মান সরকারের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই সফরের সময় তিনি পূর্ব জার্মানিতে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদলের সিনিয়র কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে ঝুকভ উল্লেখ করেন যে, যদিও তাদের মূল দায়িত্ব মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোটের আক্রমণ প্রতিহত করা, কিন্তু তাদের দায়িত্ব কেবল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিনিরা আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে, এই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া মাত্রই সোভিয়েতদেরকে মার্কিনিরা আক্রমণ শুরু করার আগেই তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে হবে এবং দুই দিনে সোভিয়েত সৈন্যদের ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে! মে মাসে ঝুকভ মস্কোয় একটি সামরিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে এই বিষয়ে পুনরায় আলোচনা হয়। কিন্তু এই সম্মেলন থেকে ঝুকভ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সামরিক তত্ত্ব তখনও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে পারেনি।
অবশ্য ঝুকভের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ক্রমশ ঝুকভের অজান্তেই সমাপ্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ঝুকভ ছিলেন একজন আপাদমস্তক সৈনিক এবং রাজনীতির মারপ্যাঁচ তিনি কখনোই যথাযথভাবে আয়ত্ত করতে পারেননি। সোভিয়েত রাজনীতির শীর্ষস্থানে পৌঁছানোর পরেও তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করতে পারেননি। এজন্য শীঘ্রই তাকে মূল্য দিতে হবে!
(এরপর দেখুন ১২শ পর্বে)