Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জুনাইদ জামশেদ: রকস্টার থেকে ধর্মপ্রচারক হবার বর্ণময় জীবন যার

একজীবনে কত কী হতে পারেন আপনি? অথচ এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা ক্ষণিক জীবনে বহুক্ষেত্রে বিচরণ করে নাম কামিয়েছেন সর্বত্রই। রকস্টার, এয়ারফোর্স অফিসার, শখের অভিনেতা, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়-উদ্যোক্তা, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং সবশেষে ধর্মপ্রচারক। আজকে যার কথা থাকবে লেখায়, জীবনে ঠিক এতগুলো ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। একশ আশি ডিগ্রি রূপান্তরের রুপকথা যেন তার জীবনটি। ধর্মের আবেগ যেমন তার জনপ্রিয়তায় দিয়েছে নতুন পালক, তেমনি অবধারিতভাবেও দিয়েছে কিছু বিতর্ক। তিনি জুনাইদ জামশেদ।

বেড়ে ওঠার দিনগুলো

১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের রাজধানী করাচিতে জামশেদ আকবর ও নাফিসা আকবরের ঘর আলো করে জন্ম নেন জুনাইদ জামশেদ। বাবা ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ক্যাপ্টেন। সৌদি আরবে মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে তিনিও যোগ দিতে চেয়েছিলেন বাবার কর্মক্ষেত্রেই। পাইলট হবার স্বপ্ন ছিলো তার, কিন্তু দুর্বল দৃষ্টিশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাতে। পদার্থ ও গণিতে ব্যাচেলর করবার পর জুনাইদ ঠিকই যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে, বেসামরিক ঠিকাদার হিসেবে।

রকস্টারের প্রারম্ভ

Source: starsunfolded.com

চাকুরিকালে শিক্ষাকালীন অবকাশে তিনি শুরু করেন রক গানের কনসার্ট। পেশওয়ার ও লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বিভিন্ন শো করছিলেন, তখনো তিনি লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্র-প্রকৌশলে অধ্যয়নরত। গান গাইতে গাইতেই পরিচয় হয় রোহেল হায়াত ও শেহজাদ হাসানের সঙ্গে। তারা মিলেই খোলেন নতুন ব্যান্ড দল ‘ভাইটাল সাইন্স’, যার মূল ভোকালিস্ট ছিলেন জুনাইদ। সময়টা ১৯৮৬ এর মাঝামাঝি।

ভাইটাল সাইন্স ব্যান্ডের সদস্যদের সাথে তরুণ জুনাইদ (সর্বডানে); Source:parhlo.com

পরের বছরেই একই নামে বাজারে আসে তাদের অ্যালবাম। সেখান থেকে ‘দিল দিল পাকিস্তান’, ‘তুম মিল গায়ে’ দিয়ে দেশজোড়া খ্যাতি পান জুনাইদ ও তার ব্যান্ড। তারপর তো পড়া ছেড়ে পুরোদস্তুর গানেই মজে গেলেন জুনাইদ।

জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে

পরবর্তী দুই অ্যালবাম ‘ভাইটাল সাইন্স টু’ আর ‘অ্যাতবার’ এর জনপ্রিয়তা জুনাইদকে দেয় নতুন এক পরিচয়ের দিশা। ১৯৯৪ সালে পিটিভির ‘ঢুন্ডলে রাস্তে’ সিরিজটির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে জুনাইদ এবার নাম লেখালেন অভিনেতার খাতায়! অভিনেতা হিসেবে ছোট একটি ইনিংস খেলে জুনাইদ এবার মন দিলেন সলো গানের ক্যারিয়ারে। ১৯৯৮ সালে ব্যান্ড ছেড়ে এসে বের করলেন সলো অ্যালবাম ‘উস রাহ পার’ (১৯৯৯)। এই অ্যালবাম থেকে টাইটেল ট্র্যাকটি সহ ‘না তু আয়েগি’, ‘আঁখোঁ কো আঁখোঁ নে’, ‘ও সানাম’ বাজারে তুমুল জনপ্রিয় হয়। ২০০১ সালে বের হয় তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘দিল কি বাত’। ২০০৩ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক জরিপে ‘সেরা ১০ সুর’-এর তালিকায় ৭,০০০ গানকে পিছে ফেলে জায়গা করে নেয় জুনাইদের ‘দিল পাকিস্তান’।

অ্যাতবার অ্যালবামের মোড়ক; Source:parhlo.com

তারকার আকস্মিক ভূ-পতন

ভাগ্য সবসময় সুপ্রসন্ন থাকে না। জুনাইদের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটলো। এমনিতেই ব্যান্ড ছেড়ে দেবার পর কাছের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তার থেকে। উপরন্তু শেষ দুইমটি অ্যালবাম বাজারে তেমন কাটতিও পায়নি। কেবল ইউরোপ, আমেরিকায় কিছু শো করে দিন কাটছিলো জুনাইদের। কিন্তু ৯/১১ এর পর নিরাপত্তা আশঙ্কা ও ইসলামবিদ্বেষের কারণে জুনাইদ জামশেদের সব কনসার্ট বাতিল হতে থাকে পাশ্চাত্যে। জনপ্রিয়তার শিখর থেকে হুট করে এমন খাদেই পড়লেন জুনাইদ যে কোর্ট কর্তৃক তিনি দেউলিয়া পর্যন্ত ঘোষিত হলেন ২০০৪ সালে!

নতুন জীবনে জুনাইদ

এরপরই মিডিয়ার লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান জুনাইদ। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রিটা শেষ করে তিনি কাজ করলেন কিছু কোম্পানিতে। সেখানে মন টিকাতে পারলেন না তিনি। কাছের এক বন্ধুকে নিয়ে তিনি এরপর খুলে বসলেন ফ্যাশন হাউজ ‘জে ডট’। শোনা যাচ্ছিলো তখন থেকেই তিনি বেশ করে ঝুঁকে পড়ছিলেন ধর্মকর্মের দিকে।

ব্যবসায় উন্নতির সাথে সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন তাবলিগ জামাতের সাথেও। রক গায়ক, খণ্ডকালীন অভিনেতা থেকে তিনি বনে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং সর্বোপরি ধর্মপ্রচারক। তাবলিগের হয়ে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেবার পাশাপাশি  তিনি শুরু করলেন নাত (নবীর স্তুতিমূলক গান) গাওয়া। এই নাত দিয়ে পুনরায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠলেন জুনাইদ জামশেদ। তবে পুনর্জীবনের এ অধ্যায়ে অবধারিতভাবেই শ্রোতা-ভক্তের ধরনটা বদলে যায়। কিন্তু কণ্ঠ তো রয়েছে আগের ন্যায় মধুময়ই, এ কারণে জুনাইদের গাওয়া ‘ইয়ে সুভা মদিনা’, ‘তুনে পুঁছি ইমামত’, ‘মুলতাজিম পার দুয়া’, ‘মেরে মাদাদ আল্লাহ’র মতো অসংখ্য নাত পায় মানুষের ভালোবাসা। বাংলায় গাওয়া ‘হে রাসূল’ ও ‘নবী মোর পরশমনি’-র কাভারও ইউটিউবের কল্যাণে পেয়েছে বেশ বাঙালি-শ্রোতাপ্রিয়তা। বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের জন্য প্রচুর দাতব্য কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন জুনাইদ। পূর্বের গ্ল্যামারের সাথে ধর্মের মিশেলে তার এই নতুন কারিশমাটিক ভূমিকা তাকে পরিণত করে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে। মাত্র বছর দশেকের ব্যবধানে একজন রকস্টারকে এভাবেই পৃথিবী চিনলো সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে।

Source: starsunfolded.com

যখন বিতর্কের নাম জুনাইদ জামশেদ

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তার এক ভিডিও প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, “মুহাম্মদ (স) এর স্ত্রী আয়েশা স্বামীর বাড়তি মনোযোগ কামনা করতেন, তাই তিনি একবার অসুস্থতার ভান করেছিলেন”। ব্যস, ব্ল্যাসফেমি আইনে নবীর (সা) স্ত্রীকে অবমাননার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় সুন্নি তেহরিক নামক একটি সংগঠন। পরবর্তীতে বক্তব্য প্রত্যাহার ও ‘তওবা’ করে সে যাত্রায় মামলা থেকে পার পান জুনাইদ।

তবে ভাগ হয়ে যায় আলেম সমাজ। জুনাইদের দীক্ষাগুরু হিসেবে পরিচিত তাবলিগের প্রধান মাওলানা তারিক জামিল ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন জুনাইদের জন্য। সবাইকে বোঝাতে লাগলেন, “এ ভুল অনিচ্ছাকৃত। আর রাসুলের আদর্শ হলো ক্ষমার আদর্শ, তাই জুনাইদকেও ক্ষমা করে দেওয়া উচিত।

ওদিকে মাওলানা ইব্রাহিম ইসা বললেন, “এটি  যতটা না ব্লাসফেমি, তার থেকে সুস্পষ্ট আদবের  লংঘন”। জুনায়েদকে তিনি বললেন ‘অজ্ঞ’, এবং তাবলিগ জামাতের সাথে জুনায়েদের বন্ধন ছিন্ন করবার কথা বলেন। সেই সাথে তার পক্ষ নেবার জন্য তারিক জামিলকেও এক হাত নেন ইসা।

২০১৫ এর জানুয়ারিতে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে উগ্রপন্থীদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন জুনাইদ। কয়দিন আগে যেই ইমরান খান তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিজের নির্বাচনী এলাকায় গাইতে, তিনিও টু শব্দটি করলেন না এই নিগ্রহের বিরুদ্ধে! প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দল মুসলিম লীগের সদস্য হবার পরও জুনাইদ পাশে পাননি প্রধানমন্ত্রীকে। জুনাইদের প্রতি কেন এই নীরবতা? কেননা উগ্রবাদীদের চটাতে চাননি তারা কেউই। কিন্তু জুনাইদ সেদিন পাশে পেয়েছিলেন তার পূর্বতন ব্যান্ড জীবনের বন্ধুদের। খারাপ সময়ে পাশে না দাঁড়ালেও সুযোগ পেয়ে কথা শোনাতে ভোলেননি ইসলামপন্থী অনেকে। প্রথম স্ত্রীর সাথে হাত ধরা ছবি নিয়েও জুনাইদের পিণ্ডি চটকালেন তারা! কেন? কারণ জুনাইদ একমুখে পর্দার কথা বলেন, অন্যদিকে বেপর্দা স্ত্রীর হাত ধরে ছবি তোলেন! ‘ডিস্কো মোল্লা’র বিদ্রুপাত্মক খেতাব তাকে দিয়ে দিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামপন্থী নিন্দুকেরা।

Source: blogs.tribune.com.pk

২০১৫ সালের জুলাই মাসে ফের বিতর্কে জড়ায় জুনাইদ জামশেদের নাম। সামাজিক মাধ্যমে এক বার্তায় বলে বসলেন, “স্রষ্টা মেয়েদের অপছন্দ করেন, এ কারণে কোরআনে তিনি তাদের নাম নেননি”। পরবর্তীতে ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় পূর্বের বক্তব্যের ‘সঠিক অর্থ’ প্রদানপূর্বক আত্মপক্ষ সমর্থন করেন তিনি। সতর্কিত জুনাইদ লিঙ্গ অসংবেদনশীল বিতর্কিত কথা পুনরায় না বললেও ভিডিওর শেষে এসে বলেন, “মেয়েরা হলো হীরার ন্যায়, আর হীরা লুকিয়ে রাখাই শোভনীয়”। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়ে যায় সমালোচনার ঝড়! অনেকে এমনও বলছিলেন যে, “যার পেট চলে মেয়েদের জন্য পোশাক নকশা করে, মেয়েদের ছোট করে কথা বলা অন্তত তার সাজে না”।

করুণ জীবনাবসান

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় স্ত্রী নাহিয়া জুনাইদকে নিয়ে তাবলিগের কাজে তিনি খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চিত্রালে গিয়েছিলেন (উল্লেখ্য, জুনাইদের তিন পুত্র ও এক কন্যার জন্ম তার প্রথম স্ত্রী আয়েশা জুনাইদের গর্ভে)। ৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে ইসলামাবাদ ফেরার পথে তাকে বহনকারী পিআইএ ৬৬১ বিমানটি একই প্রদেশের হাভেলিয়ানে বিধ্বস্ত হয়। সস্ত্রীক নিহত জুনাইদের দেহকে স্বাভাবিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এক্সরে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দ্বারা সনাক্ত করতে হয়েছিলো তাকে। তার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়েছিলো তার অগণিত ভক্ত, যারা কেউ ভালোবেসেছিলো রকস্টার জুনাইদকে, কেউবা বেসেছিলো নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম গায়েন জুনাইদকে। এভাবেই ইতি ঘটেছিলো একটি বর্ণবহুল জীবনের, একটি বর্ণাঢ্য গল্পের।

ফিচার ইমেজ: blogs.tribune.com.pk

Related Articles