৯/১১ এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তান দখল করে, তখন তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মোল্লা ওমরকে গ্রেপ্তার করা। মোল্লা ওমরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমেরিকা সে সময় ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যা ছিল বিন লাদেনের পর সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে কাজ করা প্রখ্যাত ডাচ সাংবাদিক বেটে ড্যাম (Bette Dam) সম্প্রতি তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের উপর একটি বই প্রকাশ করেছেন। Looking for An Enemy নামের এই বইয়ে উঠে এসেছে আফগানিস্তানের ইসলামিক ইমারাতের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান এবং তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের শেষ দিনগুলোর পলাতক জীবনের কথা, তার মৃত্যুর কথা এবং তাকে ধরতে মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতার কথা।
তার বইয়ের সারমর্ম অবলম্বনে মোল্লা ওমরের জীবনের শেষ দিনগুলো নিয়ে আমাদের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব। সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব এবং তৃতীয় পর্ব।
২০০১ সালের ডিসেম্বরে, কান্দাহার যুদ্ধের শেষ দিকে মোল্লা ওমর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তালেবান সরকারের অর্থমন্ত্রী মুতাসিম আগা জানের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি তাকে অনুরোধ করেন তার পরিবারকে নিরাপদে কোথাও সরিয়ে নেওয়ার জন্য। আগা জান বন্ধুর অনুরোধে তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে নিয়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তাদের সাথে মোল্লা ওমরের সেটাই ছিল শেষ দেখা।
পরিবারকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়ার পরপরই মোল্লা ওমর যোগাযোগ করেন আরেক বিশ্বস্ত তালেবান নেতা আব্দুল জব্বার ওমারির সাথে। আব্দুল জব্বার ছিলেন তালেবান সরকারের সময় আফগানিস্তানের বাগলান প্রদেশের গভর্নর। কিন্তু তারচেয়েও বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন জাবুল প্রদেশের হোতাক গোত্রের প্রধানদের মধ্যে একজন, মোল্লা ওমর নিজে যে গোত্রের সদস্য।
মোল্লা ওমর বড় হয়েছেন কান্দাহার এবং উরুজগান প্রদেশে। কিন্তু তার বাবা এবং দাদার বসবাস ছিল জাবুল প্রদেশেই। স্বাভাবিকভাবেই ঐ এলাকার লোকজন তালেবানদের সমর্থক। মোল্লা ওমর সিদ্ধান্ত নেন, জীবনের বাকি দিনগুলো তিনি সেখানেই কাটাবেন। তিনি আব্দুল জব্বার ওমারিকে অনুরোধ করেন, তাকে কান্দাহার থেকে নিরাপদে বের করে জাবুল প্রদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ডিসেম্বরের ৫ তারিখে মোল্লা ওবায়দুল্লাহর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দুইদিন পর্যন্ত মোল্লা ওমর কান্দাহারেই ছিলেন। কিন্তু ডিসেম্বরের ৭ তারিখে যখন ডোনাল্ড রামসফেল্ড প্রকাশ্যে হামিদ কারজাইয়ের তালেবানদের সাথে সমঝোতার উদ্যোগের নিন্দা করেন, তখন মোল্লা ওমর সিদ্ধান্ত নেন, কান্দাহার ছাড়ার এটাই উপযুক্ত সময়। সেদিন দুপুর বেলাতেই তিনি কান্দাহার ত্যাগ করেন।
দুটি গাড়িতে করে যাত্রা শুরু করেন মোল্লা ওমর এবং আব্দুল জব্বার ওমারি। একটি ছিল ল্যান্ড ক্রুজার, যেটিতে উঠেন আব্দুল জব্বার নিজে। আর অপরটি ছিল টোয়াটা স্টেশন ওয়াগন। সেটিতে চড়েন মোল্লা ওমর এবং দুজন অজানা ব্যক্তি। সাংবাদিক বেটে ড্যামের সাথে সাক্ষাৎকারে ওমারি তাদের পরিচয় জানাতে রাজি হননি। তবে ভিন্ন উৎস থেকে বেটে ড্যাম ধারণা করেন, তাদের একজন ছিলেন মোল্লা ওমরের দ্বিতীয় স্ত্রীর ভগ্নিপতি, মোল্লা আজিজুল্লাহ।
সন্ধ্যা নাগাদ তারা এসে পৌঁছেন কান্দাহার থেকে ১২৫ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত জাবুল প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী কালাত শহরে। কান্দাহারের পতন ঘটলেও কালাত তখনো তালেবানদের প্রতি অনুগত স্থানীয় গোত্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে আশ্রয়ের জন্য পলাতক তালেবানদের অনেকেই কালাতে এসে আশ্রয় নিচ্ছিল। এই কালাত শহরই হয়ে উঠে মোল্লা ওমরের আশ্রয়স্থল।
পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে, যখন কান্দাহারের মতো জাবুলেও আগের গভর্নরকে সরিয়ে আমেরিকার পরামর্শে হামিদুল্লাহ খান তোখি নামে এক নতুন গভর্নরকে নিয়োগ করা হয়। তোখি ছিলেন তালেবানদের অন্যতম প্রধান শত্রু, হেজব-ই-ইসলামী নেতা গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ারের সহযোগী। কান্দাহারের গভর্নর শেরজাইয়ের মতো তিনিও জাবুলে পালিয়ে আসা তালেবান সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে শুরু করেন।
উপায় না দেখে তালেবানদের অনেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে শুরু করে। মোল্লা ওমরকেও পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন আব্দুল জব্বার ওমারি। কিন্তু পাকিস্তানের মোশাররফ সরকার তখন ছিল আমেরিকার ওয়ার অন টেররের অন্যতম সহযোগী। আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া অনেক তালেবান সদস্যকে পাকিস্তান গ্রেপ্তার করে তুলে দিচ্ছিল আমেরিকার হাতে। ফলে মোল্লা ওমর পাকিস্তানীদেরকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি জাবুলে থাকার ব্যাপারেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন।
আব্দুল জব্বার ওমারি মোল্লা ওমরের থাকার ব্যবস্থা করেন তার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভার, আব্দুস সামাদ উস্তাদের বাড়িতে। উস্তাদ তখন কালাত এবং এর আশেপাশের এলাকায় নিয়মিত ট্যাক্সি চালাত। পরিবারসহ সে থাকত জাবুলের নবনিযুক্ত গভর্নর হামিদুল্লাহ খান তোখির বাড়ির কাছেই একটি মাটির তৈরি ঘরে। আব্দুল জব্বার ওমারি সিদ্ধান্ত নেন, মোল্লা ওমরের স্থান হবে সেই ঘরেই।
আব্দুস সামাদ উস্তাদের বাড়িটি ছিল আর দশটি সাধারণ আফগান বাড়ির মতোই। মাটির দেয়ালের তৈরি সারি বাঁধা অনেকগুলো রুম, আর মাঝখানে বিশাল আঙিনা। একসারি রুমের এক কোণে ছিল ইংরেজি এল-আকৃতির একটি বড় রুম। রুমটিতে প্রবেশের জন্য দৃশ্যমান কোনো দরজা ছিল না। বরং কাবার্ডের আড়ালে লুকানো গোপন একটি দরজা দিয়ে সেই রুমে প্রবেশ করা যেত। এই গোপন রুমটিই হয়ে উঠে মোল্লা ওমরের আস্তানা।
মোল্লা ওমর তার নতুন বাসস্থানে অভ্যস্ত হতে থাকেন। আব্দুস সামাদ তাকে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি রাখেননি। তিনি তার স্ত্রীকেও মোল্লা ওমরের প্রকৃত পরিচয় জানাননি। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা অবশ্য জানত, কোনার এল-আকৃতির রুমটিতে গোপনে কেউ বসবাস করছে। কিন্তু উস্তাদ তাদেরকে শুধু জানিয়েছিলেন লোকটি তালেবানের উচ্চপদস্থ এক নেতা, যার লুকিয়ে থাকার সংবাদ জানাজানি হলে সবাই বিপদে পড়তে পারে।
আব্দুস সামাদ উস্তাদের এই বাড়িটিতে মোল্লা ওমর দীর্ঘ চার বছর ছিলেন। উস্তাদ নিয়মিত ট্যাক্সি চালাতে চলে যেতেন, কিন্তু আব্দুল জব্বার থাকতেন মোল্লা ওমরের সাথেই। কারো চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে মোল্লা ওমর সাধারণত রুম থেকে বের হতেন না। কিন্তু তারপরেও সেই দিনগুলোতে তারা নিজেদেরকে মোটামুটি নিরাপদই মনে করতেন। সে সময় মার্কিন সেনারা মাঝে মাঝে কান্দাহার থেকে হেলিকপ্টারে করে কালাতে আসত। কিন্তু দুই-একদিন থেকেই আবার কান্দাহারে ফেরত যেত।
২০০৪ সালের দিকে তালেবানরা পুনরায় সংগঠিত হতে শুরু করে এবং আমেরিকানদের টহলও বাড়তে শুরু করে। এ সময় মার্কিন সেনারা দুইবার মোল্লা ওমরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। প্রথমবার যখন টহল দিতে দিতে তারা বাড়িটির কাছাকাছি চলে আসে, তখন মোল্লা ওমর এবং আব্দুল জব্বার ছিলেন ঘরের বাইরে। সেনাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে তারা একগাদা কাঠের স্তুপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু তাদের ভাগ্য ভালো, সেনারা না থেমেই পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
দ্বিতীয়বার মার্কিন সেনারা আসে বাড়িটিতে তল্লাশি চালানোর জন্য। তারা হয়তো ঠিক মোল্লা ওমরের উপস্থিতি জানত না, কিন্তু সম্ভবত কোনো তালেবান নেতা সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে সন্দেহ করেই সেখানে এসেছিল। আব্দুল জব্বার তখন সেখানে ছিলেন না, মোল্লা ওমর একা তার রুমের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। সেনারা প্রতিটি রুম এক এক করে তল্লাশি করে। কিন্তু কোনার রুমটির দরজা গোপন থাকায় তারা সেটি খুঁজে না পেয়েই ফিরে যায়।
২০০৪ সালে আমেরিকানরা আব্দুস সামাদ উস্তাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বের একটি স্থানে ‘ফরওয়ার্ড অপারেটিং বেজ ল্যাগম্যান’ নির্মাণের কাজ শুরু করে। মোল্লা ওমর সিদ্ধান্ত নেন, তার অবস্থান পরিবর্তন করার সময় এসেছে। উস্তাদ এবং আব্দুল জব্বারের সহায়তায় মোল্লা ওমরের স্থান হয় কালাত থেকে ২০ মাইল দূরে, সিউরে নামের একটি জেলায়। সেখানে নদীর পাড়ের একটি মাটির তৈরি বাড়িতে উস্তাদের বিশ্বস্ত একটি পরিবার বাস করত। সেই বাড়ির পেছনে ছোট একটি খুপরিতে স্থান হয় মোল্লা ওমরের।
তিনি সিউরে পৌঁছার পরপরই আমেরিকানরা সেখানেও একটি ঘাঁটি নির্মাণ করতে শুরু করে। ‘ফরোয়ার্ড অপারেটিং বেজ উলভেরিন’ নামের ঐ ঘাঁটিটি ছিল মোল্লা ওমরের ঘর থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরে। প্রায় ১,০০০ সৈন্যের সেই ঘাঁটিটি থেকে এলাকাটিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হতো। মোল্লা ওমর এবং আব্দুল জব্বার তাদের ঘরে বসে প্রায় সময়ই মার্কিন হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ার শব্দ, পাশের হাইওয়ে দিয়ে সৈন্যদের জীপ ছুটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেতেন।
সে সময় আমেরিকানদের উপর তালেবানদের আক্রমণ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তালেবানদের সন্ধানে মার্কিন বাহিনী নিয়মিত গ্রামের ভেতর অভিযান চালাত। পরিস্থিতি বেশি খারাপ মনে হলে মোল্লা ওমর এবং আব্দুল জব্বার তাদের ঘর ছেড়ে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেচের জন্য খননকৃত টানেলের ভেতর গিয়ে বসে থাকতেন। সে সময় মাঝে মাঝে পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা মার্কিন বাহিনীর সাথে তাদের দূরত্ব থাকত মাত্র কয়েক মিটার!
আব্দুল জব্বার ওমারি প্রায়ই তাদের অবস্থা নিয়ে হতাশায় ভুগতেন। কারণ তার হাতে ছিল তালেবানের প্রতিষ্ঠাতার জীবন রক্ষার গুরুদায়িত্ব, তার আশেপাশের গ্রামবাসীদের প্রায় সবাই ছিল তালেবানের সমর্থক, কিন্তু তারপরেও নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি কারও সাহায্য চাইতে পারতেন না। জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি তালেবানদেরকে অনুরোধও করতে পারতেন না, যেন অন্তত এই এলাকায় আমেরিকানদের বিরুদ্ধে তারা অভিযান না চালায়।
তারপরেও এলাকার মানুষজন জানত, এই বাড়িটিতে তালেবানদের উচ্চপদস্থ কোনো নেতা লুকিয়ে আছেন। আমেরিকান দখলদার বাহিনী এবং তাদের অনুগত আফগান সরকারের উপর ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী প্রায়ই অজ্ঞাত পরিচয় সেই রহস্যময় তালেবান নেতার জন্য বাড়ির মালিকের কাছে খাবার-দাবার এবং জামা-কাপড় দিয়ে যেত। আর এভাবেই গ্রামবাসীর প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় আমেরিকানদের নাকের ডগায় বছরের পর বছরের ধরে আত্মগোপন করে ছিলেন আফগানিস্তানে তাদের দ্বিতীয় মোস্ট ওয়ান্টেড শত্রু মোল্লা ওমর।
কিন্তু একাকী ছোট একটি খুপরির ভেতর সারাদিন তিনি কী করতেন? সংগঠনের সাথে কি তার কোনো যোগাযোগ ছিল? আর তার মৃত্যুই বা কীভাবে হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানব আমাদের এই সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ পর্বে। সবগুলো পর্ব প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব ও তৃতীয় পর্ব।