শরৎচন্দ্র তখন সাহিত্যজগতে কেবলই পদচারণা শুরু করেছেন। জনপ্রিয়তা পেয়েছে কয়েকটি উপন্যাস। তখন অনেকেই বলে বসলেন, শরৎচন্দ্রের লেখায় রবীন্দ্রনাথের গদ্যশৈলীর অনুঢঙের প্রভাব রয়েছে। তাই অনেকেই শরৎচন্দ্রকে রবীন্দ্রপ্রভাবিত সাহিত্যিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া শুরু করলেন। কিন্তু যার ভেতরে সত্যিকারের প্রতিভা আছে, তা আটকে রাখার সাধ্য কার!
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই নিজের স্বকীয়তা ও প্রতিভার প্রমাণ দিতে শুরু করলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। পেলেন তুমুল জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি। বাঙালির আবেগ, আবহ, মমতা আর জটিল সব আখ্যানের রূপায়নে সৃষ্টি করতে থাকলেন কালজয়ী সব সাহিত্যকর্ম। তার কলমে উঠে এসেছে সে সময়ে বাঙালির দিশেহারা জীবন, নিম্নবিত্তের অসহায়ত্ব, সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাত। অপরদিকে, ভালোবাসা আর মানুষের প্রতি মানুষের মমতার নির্মোহ উপাখ্যানও। আবেগী কথামালায় পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে শিল্প নির্মাণে সিদ্ধহস্ত শরৎচন্দ্রের একেকটি চরিত্রের সাথে আবেগী সহযাত্রী হয় পাঠক। শতাব্দীপূর্ব থেকে আজ অবধি এই সহযাত্রীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে।
‘গৃহদাহ’ শরৎচন্দ্রের এক অমর সৃষ্টি। এ উপন্যাস আবহমান বাংলার প্রণয় সঙ্কটে ভুগতে থাকা তিনজন নর-নারীর ত্রিভুজ প্রেমের আখ্যান। ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সমসাময়িক বাঙালির আত্মিক বৈশিষ্ট্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ব্যক্তিমানসের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের প্রেম-পরিণয়, বিশ্বাসকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সমাজ-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ন্যায়-নীতি যে কীভাবে সম্পূর্ণরূপে এ সমাজের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তা এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মূলত অচলা। তাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান দুটি চরিত্র- মহিম এবং সুরেশ। পুরো কাহিনী বর্ণিত হয়েছে অচলার মনোজাগতিক সিদ্ধান্তহীনতাকে কেন্দ্র করে। অচলার চিত্তজাগতিক দোলাচলবৃত্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা নষ্ট করেছে তার মনোভারসাম্য, দগ্ধ করেছে তার অন্তরালয়। অচলা আসলে কাকে চায়? মহিম, নাকি সুরেশ? এই অন্তর্দ্বন্দ্ব কেন্দ্রিক অচলার চারিত্রিক সিদ্ধান্তহীনতার সমাপ্তি পাঠক কখনোই খুঁজে পাবেন না। মাঝখানে পাবেন অচলা চরিত্রের প্রতি দগ্ধ-বিদগ্ধ ক্ষোভ-হতাশা আর ভারসাম্যহীনতা।
ভালোবেসে মহিমকে বিয়ে করে অচলা সুখী হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। শহুরে আধুনিকা অচলা গ্রামীণ পরিবেশে তার ভালোবাসার মহিমকে খুঁজে পায়নি। এ সুযোগে তার সাক্ষাৎ হয়েছে মহিমেরই ধনাঢ্য বন্ধু সুরেশের সঙ্গে। সেখান থেকেই মহিম-অচলার প্রেমত্রিভুজের আরেক কোণে যুক্ত হয় সুরেশ। অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে সুরেশের কাছে অচলার সংলাপে ধরা পড়েছে সিদ্ধান্তহীনতাজাত তার এই চিত্তদাহ,
“সুরেশবাবু, আমাকে তোমরা নিয়ে যাও- যাকে ভালোবাসিনে, তার ঘর করবার জন্যে আমাকে তোমরা ফেলে রেখে দিয়ো না।”
সমগ্র উপন্যাস জুড়ে শরৎচন্দ্র পাঠককে চরম উৎকণ্ঠা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং ভারসাম্যহীন অবস্থানে রেখেছেন। স্বামী মহিমের প্রতি যে অচলার সম্মান বিদ্যমান রয়েছে, তার প্রমাণ উপন্যাসের বিভিন্ন অংশ থেকে জানা যায়। কিন্তু একইসাথে প্রাণচঞ্চল সুরেশের জন্য তার হৃদয়ের প্রধান অংশ থেকেছে সদা তৃষিত। দোলাচলে থাকা অচলার ব্যক্তিক সঙ্কট সুরেশ-মহিমের দ্বৈরথ আকর্ষণে নিজেকে উদ্ধারের চেষ্টা করে।
অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে হাওয়াবদলে যাওয়ার সময়ে অচলা আহ্বান জানায় সুরেশকে, তা কি কেবল ভদ্রতাসুলভ? এ সিদ্ধান্ত পাঠকই নিতে পারবেন। সুরেশের প্রতি অচলা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত, তা স্পষ্ট হয়েছে এখানে। ট্রেনে অপরিচিত মেয়েটিকে কেনই বা অচলা স্বামী হিসেবে সুরেশকে পরিচয় করিয়ে দিল? পাঠকের একসময় মনে হবে, হয়তো চাইলেই অচলা এই দোলাচল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত। কিন্তু, আসেনি।
অচলা পরিবেশের প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। সুরেশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। শেষতক অচলা আবার স্বামী মহিমের কাছেই তার শেষ আশ্রয়ের সন্ধান করেছে। অচলার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘটনা দিয়ে শরৎচন্দ্র প্রকৃতপক্ষে দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।
উপন্যাসের অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো মৃণালিনী এবং কেদারবাবু। উপন্যাসের পটপরিবর্তনে এদের ভূমিকা অনেক বেশি। যদিও খুব কম জায়গায় তাদের কথা উঠে এসেছে।
অচলাকে কেন্দ্র করে বৃত্তের চারপাশে ঘুরতে থাকা মহিম এবং সুরেশ চারিত্রিক দিক দিয়ে দুই মেরুর দুই বাসিন্দা। একদিকে চটপটে এবং উৎফুল্ল সুরেশ, যার কাছে ভালোবাসা অর্থ হলো হৃদয়ের চেয়ে শরীর বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে মহিম। পুরোটা গল্প জুড়ে সে ছিল নির্লিপ্ত। তাই তো মৃণালিনী বারবারই সন্দেহ করে বসেছেন, মহিমের আসলেই মন আছে কি না। নির্লিপ্ত মহিমের মধ্যে শরৎচন্দ্র ফুটিয়ে তুলেছেন নিম্নবিত্ত এবং নিরুপায় এক শিক্ষিত যুবকের স্ত্রীর প্রতি অসহায় ভালোবাসা। এক্ষেত্রে বলতে হয় উপন্যাসের নায়ক মূলত মহিম।
সামগ্রিক উপন্যাসের পর্যালোচনা থেকে বোঝা যায়, বাঙালি নারীর চরিত্র উদঘাটন করাই ছিল শরৎচন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। মহিম এবং সুরেশের প্রণয়ের দোলাচলে ভুগতে থাকা অচলাকে দিয়ে শরৎচন্দ্র বাঙালি সমাজের এক সামাজিক ব্যাধি তুলে এনেছেন। এটা করেছেন প্রথাগত সমাজকে রক্ষা করার তাগিদে, কেননা বঙ্কিমের মতো শরৎচন্দ্রও সামাজিক দায়বদ্ধতার বেড়াজাল মাড়াতে পারেননি। তাই অচলা-সুরেশ পরকীয়া প্রণয়ের পরিণতি বিচ্ছেদে; মিলনে নয়। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টানো উপন্যাসের বৈপরীত্য বেশ চমকপ্রদ। সুরেশের মৃত্যুর পর পরকীয়ায় ভুগতে থাকা অচলা কতটা অসহায় এবং নিরুপায় হয়ে পড়ে, পাঠককে তা ভাবতে শেখাবে। শরৎচন্দ্রের ভাষায়, দোলাচলে অচলাদের আঁচলেই নির্মিত হয় সংসারের গৃহদাহ।
শরৎচন্দ্রের এ উপন্যাসের গতিপথ গতানুগতিক ধারায় চলেনি। লেখক এখানে ভিন্নমাত্রার ভাবনার ছায়া ফেলেছে। কলম চালিয়েছেন বাঙালি সমাজের এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিক্রিয়া নিয়ে। যুগে যুগে পাঠক গৃহদাহ পড়ে বিদগ্ধ হয়েছেন, জ্বলেছেন অন্তর্জ্বালায়। বৈদগ্ধ্যের চূড়ান্ত মুহূর্তে বই বন্ধ করে আকাশপানে চেয়ে কেউ কেউ হয়তো বলেছেন, “কেন এমন হলো?'” পাঠকের এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন শরৎচন্দ্রের লেখনীর সফলতারই জানান দিয়েছে।
‘গৃহদাহ’ প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। এর প্রায় অর্ধশতক পরে ১৯৬৭ সালে, এ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেন উত্তম কুমার। সুবোধ মিত্রের পরিচালনায় ‘উত্তম কুমার ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। উত্তম কুমার প্রযোজিত এ চলচ্চিত্রে অচলা চরিত্রে অভিনয় করেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। মহিমের ভূমিকায় অভিনয় করেন উত্তম কুমার নিজে এবং সুরেশের ভূমিকায় ছিলেন প্রদীপ কুমার।
বইয়ের পাতা এবং সেলুলয়েডের ফিতায় ‘গৃহদাহ’ বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অপূর্ব সৃষ্টি। যা মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, সমাজ, সংস্কৃতি এবং জটিল সামাজিক রসায়নের চিরায়ত উপাখ্যান। সব মিলিয়ে কালজয়ী এ উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা সকলকে যুগেই বিদ্যমান থাকবে বলে প্রতীয়মান হয়।
বই: গৃহদাহ
লেখক: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশনা সংস্থা: প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
প্রথম প্রকাশ: ৬ নভেম্বর, ১৯২০ সাল
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৯৬ পৃষ্ঠা