জনসাধারণের লেখক আহমদ ছফা পরম মমতায়, অনেক যত্ন নিয়ে হাজার বছর ধরে চলে আসা বাঙালির জীবন সংগ্রামের ছবি এঁকেছেন এ উপন্যাসে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হাসিম হলেও উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই নিজ মহিমায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে এবং উপন্যাসের গতির অবধারিত অংশ হয়ে গেছে। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র তেজি তেজেন দা, যিনি উপন্যাসের কোথাও না থেকেও সারাক্ষণ আছেন হাসিমের স্মৃতিতে। বটগাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করা তেজেনের লাশ আর লাশের চোখের চাহনি সর্বপ্রথম দেখেছিল হাসিম।
এছাড়াও আছে দুই গ্রামের দুই মাতুব্বর, পরিষদের চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম, তেজস্বী যুবক ছদু, আছে কৃষক সমিতির নেতা মনির আলম, হিমাংশু আরও আছে দারোগা। স্বল্প পরিসরের এই উপন্যাসে পুরো সমাজের চিত্র আঁকা হয়েছে। উপন্যাসটা শেষ করার পর তাই আচ্ছন্ন হয়ে থাকতে হয় এর কাহিনীর প্রতি, এর চরিত্রগুলোর প্রতি। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে আসে।
উপন্যাসে আরও অনেক ছোটবড় চরিত্র থাকলেও উপন্যাসের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হচ্ছে প্রকৃতি এবং আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাঙালির ধর্ম বিশ্বাস এবং জীবনাচার। বরগুইনির দু’পাড়ে দু’টি গ্রাম গাছবাড়িয়া আর সাতবাড়িয়া। বরগুইনি নদী শুকিয়ে গেলেও তার বুকের পলি এখনো গ্রামের মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। গ্রামের মানুষেরা কখনও তাদের গ্রামের বাইরে যায়নি। তাদের কাছে এই গ্রাম দুটোই যেন পৃথিবী। তাদের জীবনধারণ পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর। বৃষ্টি না এলে জমিতে চাষ দেয়া যায় না, তাই নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টি নামানোর জন্য আছে গ্রামীণ লোকাচার। সৃষ্টিকর্তার কাছে বৃষ্টি ভিক্ষা করার পাশাপাশি চলে সেসব আচারের পালন।
“কালা ধলা মেঘা তারা সোদর ভাই
এক লাচা ঝড় (বৃষ্টি) দে ভিজি পুড়ি যাই।”
আবার বৃষ্টি এলে শত অভাবের মধ্যেও মানুষের গলা দিয়ে বের হয় গান।
“দেশ মরি গেল দুর্ভিক্ষের আগুনে
তবু দেশের মানুষ জাগিল না কেনে।”
আহমদ ছফার লেখার বড় দিক হচ্ছে, তিনি যখন যাদেরকে নিয়ে লিখেছেন, তাদের জীবনের একেবারে খুঁটিনাটি থেকে সবকিছুর দিকেই লক্ষ রেখেছেন। এ উপন্যাসের বিষয় যেহেতু গ্রামবাংলা এবং স্থান চট্টগ্রামের কোনো প্রত্যন্ত গ্রাম, তাই উপন্যাসের ভাষা সেখানকার স্থানীয় ভাষা।
এছাড়াও লেখার মধ্যে তিনি এমনসব বাস্তবধর্মী রূপক ব্যবহার করেছেন যে মনেহয় রূপকটা না থাকলে পরিস্থিতি আসলে পরিপূর্ণরূপে বর্ণনা করাই যেত না। হাসিমকে যখন তার দাদী কিছু অর্থসাহায্য করতে এসেছে সেখানে লিখেছেন,
”শিশু যেমন একমুঠো জোছনা চেপে ধরে, হাসিমও তেমনি টাকাগুলোকে চেপে ধরল।”
এ অর্থসাহায্য যেন হাসিমের জীবনে শুশ্রুষার জল, পিপাসার বারি হয়ে আসে। বুড়ো কাজীর জমি যখন খলু মাতুব্বর দখল নেয়ার জন্য চাষ দিতে শুরু করে, তখন সে খবর পেয়ে বুড়ো কাজী এসে জমির আইলের উপর বসে পড়ে।
লেখক তার বর্ণনা দিয়েছেন-
“দুঃখ আর বয়সের ভারে পৃথিবী তখন সেঁধিয়ে যাচ্ছে বুঝি মাটির ভেতর।” আবার মাটি বা জমিনকে তুলনা করেছেন ‘বোবা ছাওয়াল’ হিসেবে।
সমাজে সকল মানুষ জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থাকলেও ধর্মের বিভাজনটা ঠিকই ধরা পড়ে এ উপন্যাসের পটভূমিতে। হাজেরার সন্তান আবদুল আর আর মনমোহনের ছেলে শোভন একসাথে খেলাধুলা করলেও আবদুল মারা যাওয়ার পর শোভন যখন তাকে দেখতে যেতে চায়, তখন তার মা তাকে বাধা দেয়। তখন শোভন তার মাকে জিজ্ঞেস করে, “মুসলমান মানুষ নয় মা?” তার উত্তরে মা বলেন, “মুসলমানও মানুষ, তবে মুসলমান মানুষ।” তখন শোভন তার মাকে জিজ্ঞেস করে, “সব মানুষ এক নয় ক্যা মা? ধর্ম দু’ রকম ক্যা?” এখানে লেখক লিখেছেন,
“অবোধ শিশুর অবুঝ প্রশ্ন। অধরবাবুর সোনা-রূপোয় ভর্তি আলমারি, জাহেদ বকসুর দ্রোন দ্রোন সম্পত্তি, ফয়েজ মস্তানের কেতাব কবচ, রামাই পন্ডিতের প্রমাণ-পঞ্জি সংহতিতে এ প্রশ্নের কোনো সুদুত্তর নেই। ”
গ্রামে যখন কলেরার প্রকোপে মানুষ মারা যেতে শুরু করল, তখন হাসিমের সাথে পরিচয় হয় কৃষক সমিতির। মনির আহমদ, হিমাংশু- সবাই কৃষক সমিতির কর্মী। তারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মৃতদের সৎকারের ব্যবস্থা করছে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাদের কাছে ধনী-গরীব-ছোট-বড়, এসব জাতপাতের কোনো বিষয় নেই। সবাইকেই তারা সমান সম্মান দিয়ে কথা বলে। যদিও গ্রামের স্বার্থাণ্বেষী লোকেরা এই মানুষগুলোকে ‘কাফির’ বলে সম্বোধন করে।
কৃষক সমিতির মানুষেরা মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা বলছে। বলছে, লাঙ্গল যার জমি তার। পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকের শ্রম চুরি করে ধনীরা বালাখানা গড়েছে। সিগারেট কোম্পানি যখন চাষের জমি অধিগ্রহণ করতে এসেছে, তখন তারা কৃষকদেরকে একাত্ম করে বাধা দিয়েছে এবং তাদের রোষের শিকার হয়ে জেল হাজতে গিয়েছে। এভাবেই তাদের আন্দোলন আর আলোর মুখ দেখেনি। এটাই হয়তোবা গ্রাম বাংলার মানুষের নিয়তি। মাতুব্বর এবং ধনীদের বেড়াজাল থেকে কেউ তাদের মুক্ত করতে পারে না। তারা সারাজীবন নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য শুধু সৃষ্টিকর্তাকে অভিসম্পাত দিয়ে যায়।
তবুও জীবন বয়ে চলে। পুরনোরা গত হয়ে গেলে নতুন জীবনের বাণী নিয়ে আসে মানবশিশু। কিন্তু একজন মানবশিশুকে এ পৃথিবীতে আনতে নারীর যে ভয়ানক কষ্ট, তা খুবই হৃদয়স্পর্শী ভাষায় লেখক তুলে ধরেছেন। দুই গ্রামের গণ্ডগোলের সময় তরুণ ছদুর গায়ে আঘাত লেগে রক্তপাত ফিনকি দিয়ে হয়েছিল, সন্তান প্রসবের সময় নারীর রক্তপাতকে লেখক তার চেয়েও ভয়ংকর বলেছেন। তার ভাষায়,
“সুফিয়ার জরায়ু ফেটে চিরচির করে টাটকা তাজা রক্ত নির্গত হচ্ছে। এ রক্ত ছদুর রক্তের মতো নয়, আরো লাল, আরো গাঢ়, আরো তাজা।”
নতুন শিশুর আগমনের সময়কেও এ বইয়ে অপূর্ব মাধুর্যে বর্ণনা করা হয়েছে,
“রক্তের লাল বসনে আবৃত শরীর। আঁধার কেটে গেছে। পুবে ঢোল পহর দেখা দিয়েছে। সিঁদুররেখার মতো বিনম্র আলোর একটা ঈষৎ রেখা জাগল। তারপরে লাল হয়ে উঠল আকাশ। নবজাতকের রক্তাক্ত বসনের মতো লাল।”
জীবন বয়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। দেশে দেশে শিল্পের হাওয়া এসে লাগছে। নতুন নতুন কলকারখানা নির্মিত হচ্ছে। মানুষ ধীরে ধীরে শহরমুখী হচ্ছে। হাসিমও একসময় শহরের পথে পা বাড়ায়। কৃষক সমিতির নেতা কেরামত ভাইয়ের মাধ্যমে লেখক বলছেন,
“আকর্ষণ থাক বা না-থাক, সকলকে যেতে হবে। শহরের কল-কারখানা গাঁয়ের মানুষকে লোহার সকল দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে যাবে। আজ নাহয় কাল। দু’দিন আগে কিংবা পরে। কল রক্তের রস, বীর্যের ব্যঞ্জনা শুষে নিয়ে সকলকে চোঁচা করে ছাড়বে। ভুঁড়িওয়ালা মহাজনদের পেট মোটা হবে। হাড়ে হাড়ে আগুন জ্বলবে যেদিন, শ্রমিকেরা সেদিন জাগবে। ইতিহাসের কঠিন ইচ্ছা কার সাধ্য রোধ করে।”
কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা দেখি শ্রমিকেরা আর জাগে না। তারা বংশানুক্রমিকভাবে শ্রমিকই থেকে যায়। হয়তোবা মনেমনে স্বপ্ন দেখে মুক্তির কিন্তু সেটার আর অংকুরিত হয় না।
‘সূর্য তুমি সাথী’ নামকরণ পুরোপুরি সার্থক, কারণ মানবসভ্যতার সকল উত্থান-পতনের একমাত্র সাক্ষী হচ্ছে সূর্য। আবার সূর্যের আলোতেই আমাদের জীবনে চলে। আমাদের শরীর সমর্থ হয়। গাছেরা তৈরি করে খাবার। তাই যুগ যুগ ধরে সূর্যের সাথেই আমাদের জীবনচক্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লেখকের ভাষায়,
“নীল পাহাড়ের ঘন বনরেখার ললাটদেশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। রাঙিয়ে যাচ্ছে পুবদিকে। রাঙিয়ে যাচ্ছে হাসিমের সমস্ত চেতনা। বরগুইনির জলের হৃদয়ে আলোর শান্ত সাহস খেলা করছে। ট্রেন ছুটেছে পশ্চিমে ঝিক-ঝিক-ঝিক। সূর্যটা লাফিয়ে পশ্চিমে চলেছে যেন যুগ-যুগান্তরের সাথী।”
সূর্য তুমি সাথী বইটি সংগ্রহ করুন রকমারি থেকে।