শৈশবে অধ্যবসায়ের উদাহরণ হিসেবে রবার্ট ব্রুস আর মাকড়সার কাহিনী শোনেননি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। যে কাহিনীতে রবার্ট ব্রুস যুদ্ধে হেরে আশ্রয় নিয়েছিলেন গহীন পাহাড়ে। সেখানে মাকড়সার নিরবচ্ছিন্ন জাল বুননের প্রচেষ্টা দেখে যিনি হয়েছিলেন অনুপ্রাণিত। এরপর পরাজয়ের ব্যথা ভুলে যিনি বার বার ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। হারান শক্তিমত্তায় এগিয়ে থাকা দুর্ধর্ষ ইংরেজ সেনাদের। হন স্কটল্যান্ডের স্বাধীন রাজা।
একবার ভাবুন তো- শৈশবের সেই অধ্যবসায়ের নায়ক রবার্ট ব্রুস যদি আপনার সামনে ফিরে আসেন; যুদ্ধ করেন, পালিয়ে বেড়ান পাহাড় থেকে পাহাড়ে, তবে কেমন হবে?
কীভাবে ফিরবেন তিনি? তৎকালীন ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের দ্বন্দ্বমুখর ইতিহাসে চোখ বুলিয়েই আমরা প্রবেশ করব সেই কথায়, ফিরব আউটল কিংয়ের আলোচনায়।
স্কটল্যান্ড; ইংল্যান্ডের উত্তরে এ ভূখণ্ডের অবস্থান। ১৭০৭ সালের আগপর্যন্ত দেশটি প্রায় এক হাজার বছর ধরেই একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে টিকে ছিল। এ স্বাধীনতা যদিও নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। ইংল্যান্ডের সাথে স্কটল্যান্ডের সীমানা প্রায় ১৫৪ কিলোমিটার। যুগে যুগে ইংল্যান্ডের রাজরাজড়াদের ক্ষমতার থাবা এ সীমানা অতিক্রম করেছে। আছড় পড়েছে স্কটল্যান্ডে। বিভিন্ন ইংরেজ নৃপতি দেশটির স্বাধীনতা হরণ করতে চেয়েছেন; কখনো শক্তি দিয়ে, কখনো কৌশলে। আর স্কটল্যান্ডকে বশ করতে চাওয়া সেরকম এক ইংরেজ রাজা ছিলেন প্রথম এডওয়ার্ড।
আজ থেকে প্রায় সাতশ বছর আগের, অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকের ঘটনা। স্কটল্যান্ডের লর্ডদের মাঝে বিভেদের সুযোগে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড সেখানকার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন, এবং কৌশলে স্কটল্যান্ডেরও রাজা বনে যান। তার শাসনের কিছুদিনের মধ্যেই উইলিয়াম ওয়ালেস নামক এক ব্যক্তি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য শুরু করেন যুদ্ধ। বিখ্যাত ‘ব্রেভহার্ট’ মুভিটি যারা দেখেছেন, তারা মোটামুটি উইলিয়াম ওয়ালেস নামটির সাথে পরিচিত। ওয়ালেসের সেই বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড প্রথমে স্কটল্যান্ডের লর্ডদের নির্দেশ দেন। ব্রুস পরিবার রাজা এডওয়ার্ডের সেই নির্দেশ অমান্য করে। তারা উইলিয়াম ওয়ালেসের বিদ্রোহ সমর্থন করে। কিন্তু অচিরেই ওয়ালেস ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়। ব্রুস পরিবার রাজা এডওয়ার্ডের সাথে আবারও অধীনতামূলক চুক্তি করতে বাধ্য হয়। চুক্তি সম্পাদনকালেই রাজা প্রথম এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী লর্ড জন কমিন এবং রবার্ট ব্রুসকে গার্ডিয়ান অব দ্য স্কটল্যান্ড ঘোষণা করেন। তিনি তাদের হাতে স্কটল্যন্ডের লর্ডশিপ রেখে ইংল্যান্ডে ফেরত যান। স্কটল্যান্ড ইংল্যান্ডের একটি প্রদেশ হিসেবে পরাধীন থেকে যায়।
আউটল কিং-এর কাহিনী সেখান থেকেই শুরু। সেখান থেকেই শুরু শৈশবের কিংবদন্তি রবার্ট ব্রুসের ফিরে আসা, সেখান থেকেই জীবন্ত হতে শুরু করে অধ্যবসায়ের সেই গল্পটি- সিনেমার পর্দায়।
শৈশবের সেই রবার্ট ব্রুসকে আউটল কিং মুভির মাধ্যমে পর্দায় এনেছেন বিখ্যাত স্কটিশ পরিচালক ডেভিড ম্যাকেনজি। ২০১৮ সালে মুভিটি মুক্তি পায় নেটফ্লিক্সে। এতে ব্রুসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন হলিউডের সাড়া জাগানো অভিনেতা ক্রিস পাইন। রবার্ট ব্রুসের স্ত্রীর চরিত্র অভিনয় করেছেন ব্রিটিশ অভিনেতা ফ্লুরেন্স পাগ।
ঐতিহাসিক সময়ধারায় চিন্তা করলে ‘আউটল কিং’ মুভিকে ‘ব্রেভহার্ট’ সিনেমার সিকুয়েল হিসেবে কল্পনা করা যায়। তবে ব্রেভহার্টের ঐতিহাসিক সিকুয়েল হিসেবে মাইকেল গ্যারি পরিচালিত রবার্ট ডি ব্রুস নামের মুভিটিও বিবেচনার দাবি রাখে। আগেই যেমন বলা হয়েছে- ব্রেভহার্ট নির্মিত রবার্ট ব্রুস-পূর্ববর্তী স্কটিশ যোদ্ধা উইলিয়াম ওয়ালেসের জীবন নিয়ে, যেখানে ওয়ালেসের মৃত্যুর মাধ্যমে সিনেমার কাহিনী শেষ হয়। আউটল কিং মুভিতে ওয়ালেসের সেই মৃত্যুর প্রেক্ষাপট টানা হয়েছে। মূলত ওয়ালেসের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়েই আউটল কিং মুভিটির কাহিনী আসল নাটকীয়তায় প্রবেশ করে। মুভিতে যেমন দেখানো হয়, উইলিয়াম ওয়ালেসের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া হিসেবে রবার্ট ব্রুস তার স্কটিশ প্রতিদ্বন্দ্বী জন কোমেনকে হত্যা করেন। এরপর তিনি নিজেকে স্কটল্যান্ডের রাজা ঘোষণা করেন, যেটা ছিল ইংল্যান্ডের রাজার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ। রাজা প্রথম এডওয়ার্ড স্বভাবতই এতে ক্ষুব্ধ হন, এবং ব্রুসকে তিনি আউটল বা আইন অমান্যকারী ঘোষণা করেন। একইসাথে ব্রুসের এ বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি ইংরেজ সেনাপতি আইমার ডি ভ্যালেন্সকে দায়িত্ব দেন। ধূর্ত ভ্যালেন্সের কাছে রবার্ট ব্রুস ম্যাথভেনের যুদ্ধে পরাজিত হন।
এরপরই শুরু হয় রবার্ট ব্রুসের পালিয়ে বেড়ানোর গল্প। শুরু হয় স্কটল্যান্ডের পাহাড়ে, গুহায়, লেকে কিংবা সমুদ্রের তীরে তার দুর্বিষহ পলাতক জীবন।
রবার্ট ব্রুসের সেই সংগ্রামী জীবনের কাহিনী নিয়ে এগিয়েছে আউটল কিং মুভির গল্প। ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের নয়নাভিরাম লোকেশনে এটি ধারণ করা হয়েছে। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফির মিশলে মুভিটি আপনাকে নিয়ে যাবে আজ থেকে সাতশো বছর আগের সেই সময়ে। বইয়ের পাতা থেকে শৈশবের রবার্ট ব্রুস জীবন্ত হয়ে উঠবেন স্ক্রিনে। জীবন্তে হয়ে উঠবে ব্রুসের সঙ্গীদের ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলার মুহুর্ত। ছোট নৌকায় উত্তাল সমুদ্র কিংবা শীতল হৃদে পালিয়ে বেড়ানোর ইতিহাস হয়ে উঠবে বাস্তব । আর এসবকে ক্রমিক গল্পে এক করে তোলায় অনন্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন পরিচালক। মুভির ভিজুয়্যাল ইফেক্টের কাজ ছিল নিখুঁত। ব্রুসের স্ত্রী চরিত্রে ফ্লুরেন্সের অভিনয়শৈলী পর্দায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। তার সহযোগী জেমস ডগলাসের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন এরন টেইলর। এছাড়া সিনেমায় রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন স্টিফেন ডিলেন।
সিনেমাটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও এর কাহিনী ধারায় কিছু ঐতিহাসিক বিকৃতি আছে বলে মনে করা হয়। যেমন- সিনেমাতে দেখানো হয়- উলিয়াম ওয়ালেসের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় রবার্ট ব্রুস বিদ্রোহ শুরু করেন। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ওয়ালেসের হত্যার আরো এক বছরেরও বেশি সময় পর ব্রুস বিদ্রোহ করেন। একইভাবে, সিনেমায় রবার্ট ব্রুসের বিয়ের সময় নিয়েও ঐতিহাসিক বিরোধ রয়েছে। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্রায়নেও ঐতিহাসিক ঘটনার বিকৃত ঘটানো হয়েছে।
এসকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চতুর্দশ শতকের প্রথমদিকে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক জটিল ঘটনাপ্রবাহকে মুভিটি সহজবোধ্য করে তুলেছে। দর্শক মুভিটি দেখে বিনোদনের পাশাপাশি গল্পে পড়া রবার্ট ব্রুসের কাহিনীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুধাবনের সুযোগ পাবেন। সিনেমাপ্রেমী কিংবা ইতিহাস-সচেতন ব্যক্তিদের জন্য মুভিটির দুই ঘন্টার রানিং টাইম তাই খুব দীর্ঘ সময় মনে হবে না।