
হররের সাবজনরা তো আছে প্রচুর। সেখান থেকে নানা জনরায় ঘুরে বেড়ানো একদম সাম্প্রতিক চারটি হরর সিনেমা নিয়ে সাজানো হয়েছে এই লেখা।
Come To Daddy (2019) [হরর, ব্ল্যাক কমেডি]
‘কাম টু ড্যাডি’ হরর-কমেডি জনরার হলেও যথেষ্ট অদ্ভুত। তিন অংকের প্রতি অংকেই এই সিনেমা অনাকাঙ্ক্ষিত মোড় নিয়েছে, যা দেখার অভিজ্ঞতাকে আরো মজাদার করেছে। সিনেমার প্রিমাইজ সাধারণ ছকের খুব বেশি বাইরে নয়। ৩০ বছর পর বাবা তার সন্তানকে চিঠি লিখে, তাকে একবার দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। ছেলের সম্পর্কে সামনাসামনি বসে জানতে চাওয়ার আকুতি প্রকাশ করে। বাবার চেহারাটা ঠিকঠাক মনে করতে না পারা ছেলে সায় দিয়ে, ডিজে লুক নিয়ে, মোটামুটি জনপদবিচ্ছিন্ন সমুদ্রতীরবর্তী বাবার বাড়িটায় এসে উপস্থিত হয়। যেহেতু হরর জনরার সিনেমা একে বলা হচ্ছে, সুতরাং; অবশ্যই অনেককিছু উল্টোরথে চড়বে। এবং বাকিসময়ে অনেক রহস্য ঘনীভূত ও খোলাসা হবে।
‘কাম টু ড্যাডি’, বাপ-বেটার সম্পর্কের ডায়নামিককে চরমে নিয়ে গেছে; যতটা চরমে এটি দুঃসহ স্মৃতি বা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হিসেবে ধরা দিতে বাধ্য। এবং এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সাহায্যই চিত্রনাট্য করে গেছে। বুদ্ধিদীপ্ত তো বটেই, একইসাথে যথেষ্ট বিবরণীয়ও হয়ে উঠেছে চিত্রনাট্য। কোনো কিছুতেই ফাঁপা যুক্তি দাঁড় করানো হয়নি। প্রতিটি বিবরণে একটা মোচড় দেওয়ার পাশাপাশি ওই মোচড়েই প্রোথিত অদ্ভুত, অস্বস্তিদায়ক নিগূঢ় হাস্যরসটা সিনেমার সূক্ষ্ম বিষয়াদিকে আরো অভিঘাতী করেছে।
সিনেমার প্রথম দুই অংক, মৌখিক যুদ্ধ বা শব্দগত ভায়োলেন্সে থিতু থাকলেও, শেষ অংক ‘স্প্ল্যাটার’ জনরায় নিয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, এই মোড় অপরিকল্পিতভাবে আসেনি। এই সিনেমা দিয়ে অভিষিক্ত পরিচালক অ্যান্ট টিম্পসন, ভালো করেই জানেন তিনি কী বানাচ্ছেন, এবং তা কীভাবে বানাতে হয়। প্রতিটি শটই তিনি সমান দক্ষতা নিয়ে কম্পোজ করেছেন। হরেক রকম, অর্থহীন পরিস্থিতি থেকে কীভাবে হাস্যরস বের করে সেটিকে ভিজ্যুয়াল গ্যাগে কনভার্ট করতে হয় এবং উত্তেজনার একটা সূক্ষ্ম পরত কী করে তৈরি করতে হয়, তা তিনি ভালো করেই জানেন। একদম ইকোনোমিক ভিজ্যুয়াল ভাষা যাকে বলে।
তবে, ‘কাম টু ড্যাডি’র এই রসবোধ এবং থ্রিল যতটা কাজ করেছে ততটা করত না, যদি না ছেলের চরিত্রটিকে ঠিকঠাক লেখা হতো। তার বেদনা, নিরাশাই তাকে নানা পরিস্থিতির মুখে ঠেলেছে এবং সেসব পরিস্থিতিতে চরিত্রটির নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোই ওই হাস্যরস এবং থ্রিলের জায়গাটি গড়ে দিয়েছে। আর এই চরিত্রটির জন্য অভিনেতা এলাইজাহ্ উডকে নিখুঁত কাস্টিং।

The Battery (2012) [ড্রামা, হরর]
গতানুগতিক এবং খুবই জেনেরিক জম্বি সিনেমা দেখে জ্বালা ধরে গেলে, স্বস্তি জাগাতে পারে ‘দ্য ব্যাটারি’। জম্বি অ্যাপোক্যালিপ্সের প্রেক্ষাপটে দুই বন্ধুর গল্প, এই সিনেমা। পুরোপুরি চরিত্রনির্ভর ড্রামা সিনেমা। ‘বাডি-কমেডি’ জনরার বলতে হয়। বেইজবল খেলোয়াড় বেন এবং মিকিকে ঘিরে এই সিনেমা। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তারা। জানা নেই নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা। নতুন এই পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বেন। এমন অবস্থায় যেখানে বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা গুটিকয়েক কিংবা হতে পারে তারাই সর্বশেষ, সেখানে খুঁড়ে খুঁড়ে বাঁচতে শিখেছে সে। সবক’টা কৌশল রপ্ত করেছে। শিখেছে জ্বলে যাওয়া কাঠের ছোট্ট এক টুকরা অবশিষ্টাংশকেও কী করে কাজে লাগাতে হয়।
অপরদিকে মিকি সেই আগের জীবনের আচ্ছন্নতাতেই ডুবে থাকতে চায়। হেডফোন কানে লাগিয়ে সিডি প্লেয়ার ছেড়ে একের পর এক ব্যাটারি শেষ করে চোখের সামনের অদ্ভুত, জঘন্য বাস্তবকে অস্বীকার করতে চায় সে। বেন তাকে কিছু শেখাতে গেলে, না শেখার গোঁ ধরে। চারিত্রিক ভিন্নতা তো রয়েছেই তাদের মাঝে, থাকাটাই স্বাভাবিক। আগের পৃথিবীতে তা সেভাবে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু দুজনের একসাথে বেঁচে থাকাটাই যেহেতু এখন একমাত্র নিয়তি, তাই ভিন্নতাগুলোও গোমর ছেড়ে নির্লজ্জভাবে একেকটা দ্বন্দ্ব দাঁড় করায়। আর সেগুলো অমোঘ রূপ ধারণ করে যখন দুই বন্ধু দুটো ওয়াকিটকি খুঁজে পায়।
পরিচালক জেরেমি গার্ডনারের অভিষেক সিনেমা এটি। একইসাথে সিনেমার চিত্রনাট্যকার তিনি এবং বেন চরিত্রটি তিনি নিজেই রূপায়ন করেছেন। জম্বি জনরার প্রাথমিক অলংকারগুলো ‘দ্য ব্যাটারি’ ঠিকই ব্যবহার করেছে, তবে চেনা উপায়ে নয়। একটা ড্রামাটিক আবহ নিয়ে এসেছে। সাথে গার্ডনারের লেখা চিত্রনাট্যটির বিবরণপ্রীতি চরিত্র এবং সিনেমা দুটোতেই প্রগাঢ়তা যোগ করেছে। উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো হোক কিংবা ছোট কোনো জিনিসকে উদ্ভাবনী উপায়ে ব্যবহার করা হোক; বিবরণটা সবসময়ই গুরুত্ব পেয়েছে চিত্রনাট্যে। মিকির ক্লেশ, বেনের একাগ্রতা সবকিছুই যথার্থ রূপ পেয়েছে। বিবরণের কারণে খুব সহজেই তাদের চরিত্রের সাথে বোঝাপড়া স্থাপন করা যায়।
এমন জনরায় সচরাচর যে পরিমাণ ভায়োলেন্স, গোর দেখা যায় ওটার প্রায় অনেকটাই এখানে অফস্ক্রিনে। ভয়াবহতার মাত্রাকে চড়াও হতে না দিয়ে চরিত্রদের প্রতি সহমর্মী করে তুলতে চাওয়া হয়েছে দর্শককে। ধীরগতির ন্যারেটিভে এগিয়েছে দ্য ব্যাটারি। কয়েকটি লং টেকের শট দেখতে পাওয়া যায় সিনেমায়। গাড়ির ভেতরে প্রায় ৬-৭ মিনিট দীর্ঘ একটি শট আছে; যেখানে দেখা যায়, গাড়ির চারপাশে জম্বিরা ভীড় করে ক্রমাগত দোলাচ্ছে গাড়িটিকে। ভেতরে যখন-তখন ঢুকে পড়ার হুমকি দিচ্ছে। ওই অবস্থায় বেন কানে হেডফোন গুঁজে একের পর সিগারেট পোড়াচ্ছে, তরল পান করছে। বেনের মানসিক শক্তিটুকু ভেঙে ফেলা অব্দি অপেক্ষা করেছে ক্যামেরা। সারকথা হিসেবে বলতে হয়: চরিত্রনির্ভর এবং গভীরতাসম্পন্ন হরর সিনেমা হিসেবে বলে ওঠার মতো সিনেমা হয়েছে, ‘দ্য ব্যাটারি’।

1BR (2019) [সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, হরর]
এই যুগে প্রযুক্তিতে এতটাই বিভোর হয়ে থাকে মানুষজন, একই ঘরে থেকেও যেন হাজার মাইল দূরে। বিচ্ছিন্নতা এতটাই গ্রাস করেছে পরস্পরকে। সেখানে পাশের ফ্লাটে প্রতিবেশী কে কী করছে সেই খোঁজ নেওয়া আর সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করা রীতিমতো অলীক ভাবনার ব্যাপার। এমনকি ভাবতে গেলেও, তা জোগায় হাস্যরসের খোরাক। সেই হতোদ্যম অবস্থাকেই অন্য এক ভীতির রূপে উপস্থাপন করেছে এই সিনেমা।
সিনেমার মূল চরিত্র সারাহ্, সঙ্গত কারণ এবং নিজের স্বাধীনতার সবটুকু ভোগ করবে বলে বাবাকে ছেড়ে উঠেছে এক নতুন বাসায়। তার নতুন বাসার অবস্থান একটা ভিন্ন সম্প্রদায়ে। এখানে পাড়াপড়শি সবাই অনেক বেশি সৌহার্দ্যপূর্ণ, যেন সবাই এক ঘর এক প্রাণ। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অনেক বেশি সৌহার্দ্যপূর্ণতাই সারাহ্র ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে। কারণ ‘অতি’ স্বাভাবিক কিছুতেই যে প্রোথিত থাকে অস্বাভাবিকতার বীজ।
‘ওয়ান বি.আর’ মূলত ইন্ডি, সাইকোলজিক্যাল ড্রামা ঘরানার সিনেমা। হররের স্বাদটা সিনেমার সামগ্রিক বাতাবরণে। পরিচিত উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি ভিন্ন প্রিমাইজের গল্প। সাথে আছে সার্ভাইবাল গল্পের পরত। এই সিনেমার ধারণার দিকটি বেশ মজার এবং ভিন্ন। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক ডেভিড মার্মর জনরা সিনেমার অলংকারগুলোকে খানিক উল্টে-পাল্টে ব্যবহার করেছেন। জনরার সীমার মধ্য থেকেই প্রসারিত করেছেন, ‘কাল্ট’ অনুসরণ করা একটি হিপি সম্প্রদায়কে নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাকে। তার লেখনী বেশ চতুর, বুদ্ধিদীপ্ত। উত্তেজনা এবং ভয়ের মুহূর্তগুলো কীভাবে কোথায় কাজে লাগাতে হয় সেটা স্পষ্টতই জানেন তিনি।
চাইলেই অনেক বেশি ভায়োলেন্ট করে তুলতে পারতেন তিনি এই সিনেমাকে, কিন্তু ভায়োলেন্স এবং টর্চার যতটা সম্ভব অফ-স্ক্রিনেই রেখেছেন। স্বল্প জায়গা, একদম পরিমিত অভিনয় এবং বিভিন্ন অবজেক্টের শব্দের ব্যবহারে গোটা আবহকে উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছেন তিনি। ভয়টাকে তুলে ধরতে ব্যাসিক ক্যামেরা সেট-আপ অনুসরণ করেছেন। মিড আর ক্লোজ শটের প্রাচুর্যতা আছে। তবে বলতেই হয় প্রতিটি শট সুচিন্তিত। সেকারণেই তার ব্যাসিক ধারা এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে সিনেমাতে। সিনেমার তৃতীয় অংক অবশ্য প্রত্যাশিত ধারাতেই এসে মিশেছে। মার্মরের বয়ানভঙ্গি পরিচিতই। তবে তার চতুর লেখনী এবং দক্ষ পরিচালনায় একটি খাঁটি জনরা-সিনেমা হয়ে উঠেছে, ‘ওয়ান বি.আর’।

Boys From County Hell (2020) [ভ্যাম্পায়ার হরর, কমেডি]
আয়ারল্যান্ডের গ্রাম্যসাইডের একটা ফিকশনাল মফস্বল, সিক্স মাইল হিল। একদম নিরিবিলি এই শহরের বিশেষত্ব হলো, এখানে একদা এসেছিলেন লেখক ব্র্যাম স্টোকার এমন কথা প্রচলিত। তার বিখ্যাত হরর উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’ এ জায়গার উপরই ভর করে লেখা (সিনেমার পোস্টারেও আনা হয়েছে সেটা)। তো ব্র্যাম স্টোকারের সেই ড্রাকুলা আবার নতুন করে জীবিত হয়ে ওঠে। ‘আবহারট্যাক’ নামের এক কিংবদন্তী আইরিশ ভ্যাম্পায়ারের ছায়াতেই নাকি আসলে ড্রাকুলার জন্ম। সেই আবহারট্যাকের কবরের পাশেই একটা রোডে সংস্কার কাজ শুরু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কবর। এবং ভ্যাম্পায়ার আবহারট্যাক জেগে উঠে টেরোরাইজ করতে থাকে গোটা এই মফস্বলকে।
আয়ারল্যান্ডের এই ভ্যাম্পায়ার কিংবা কমেডি সিনেমা, ‘বয়েজ ফ্রম কাউন্টি হেল’-এর গল্পধারণাতেই রসবোধের জায়গাটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভ্যাম্পায়ার জনরা নিয়ে কাজ তো আর কম হয়নি। অলংকারগুলোর গড়পড়তা ব্যবহারে সেভাবে মজাদার কিংবা উপভোগ্য কাজও আসে কম এখন। তবে এই সিনেমা সেই গুটি চালতে পেরেছে ভালোভাবেই। বলতে হয় একদম প্রাণবন্তভাবেই। আয়ারল্যান্ডের কান্ট্রিসাইডের সেটিং, একটা কুইর্কি লোককথা (আইরিশ লোককথায় ‘আবহারট্যাক’-এর উপস্থিতি সত্যিই আছে) যোগ করেই এই সিনেমা তার অর্ধেক কাজ করে ফেলেছে। গল্পটাকে আগ্রহপূর্ণ করে তুলেছে এই লোককথার মিশ্রণ। সেই সাথে আয়ারল্যান্ডের কান্ট্রিসাইডে ভ্যাম্পায়ার সিনেমার এমন সেটিং সামগ্রিক আবহে একটা সতেজতা যোগ করেছে।
আর বাকিটা চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক ক্রিস বোও কুশলতার সাথেই করেছেন। চিত্রনাট্যের বোকা বোকা রসবোধের বিষয়টা গোটা সিনেমাকে আরো মজাদার করেছে। সংলাপে বেশ ভালো পরিমাণই ব্ল্যাক কমেডিক পাঞ্চ আছে। তীক্ষ্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত। চরিত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল অংশ সিনেমাকে আরেকটা আলাদা স্তর দিয়েছে কমেডি, হরর আর ভায়োলেন্সের পাশাপাশি। চরিত্রগুলোকে বাস্তবেরই মনে হয়েছে। নরওয়েজিয়ান জম্বি কমেডি ‘ডেড স্নো’র একটা ভাইব এই সিনেমায় কাজ করে। তবে সবকিছুতে আইরিশ ফ্লেভারটাই কড়া। যেমনটা হওয়া চাই। বলতেই হয়; গল্পে, গল্পবয়ানে একদম ব্যাসিক লাইন ধরে এবং পৃষ্ঠতলে থেকেই চতুর, চটপটে একটা জনরা সিনেমা হয়েছে ‘বয়েজ ফ্রম কাউন্টি হেল’।

এই রইল একগুচ্ছ ভালো হরর সিনেমার কথা। আরো অপরিচিত, স্বল্প-পরিচিত ভালো সব হরর নিয়ে লেখা হবে আবারো। ততক্ষণ পর্যন্ত পাঠকরা সময় নিয়ে ছুটির দিনে বসে যেতে পারেন।