স্ক্রিপ্ট ব্রিফিংয়ের সময় বিদেশি আর্টিস্টকে বাংলাদেশ সম্বন্ধে আমার নানান কিছু বলতে হইছিলো। তার মধ্যে ‘জেলের সাথে প্রথম দেখাতেই তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য’টা নিয়ে মোটামুটি বেশ কিছুক্ষণ বলতে হইছে। তাকে বোঝাইতে হইছে যে, একজন চুড়ান্ত স্ট্রেন্জারকেও এক দেখাতেই দাওয়াত দিয়ে নিয়ে খাওয়ানো একমাত্র বাংলাদেশিদের পক্ষেই সম্ভব। আমার আম্মাকে দেখতাম ধার করে অতিথিকে আপ্যায়ন করতেন। এটাই আমাদের ট্রেডমার্ক বাংলাদেশি আতিথেয়তা। রাঁধুনির জন্য করা “আমার বাংলাদেশ” সিরিজের এই দ্বিতীয় কাজটাতে আমরা বাংলাদেশের খাবার দাবারের পাশাপাশি এই আতিথেয়তার ব্যাপারটা ধরতে চাইছি।
কথাগুলো নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর। বিজয় দিবস উপলক্ষে স্কয়ারের জন্য বিউটি অ্যান্ড টেস্ট সেলিব্রেশন নামের দুটো প্রমোশনাল ভিডিও বানিয়েছিলেন তিনি। সেই ভিডিওতে লরা নামের ভিনদেশি এক তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বৃটিশ নাগরিক অ্যালেক্স ডবসন। ‘টেস্ট অফ বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই বিজ্ঞাপনের একটি দৃশ্যে লরা এবং তার বান্ধবী জুঁইকে বাংলাদেশি এক জেলে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন একবেলা খাবারের জন্য, কারণ, তার জালে বড় মাছ ধরা পড়েছে। বিদেশি মেহমান এসেছে এলাকায়, তাকে তো বড় মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করতেই হবে। কিন্তু এই দৃশ্যটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না অ্যালেক্স ডবসনের কাছে। অপরিচিত একজন মানুষ কেন দুই অচেনা তরুণীকে নিজের বাসায় নিমন্ত্রণ করবে?
ডবসন যে দেশ থেকে এসেছেন, সেখানে এমন কিছু তিনি দেখেননি কখনও। কাজেই এই দৃশ্য তার কাছে অদ্ভুত লাগাটাই স্বাভাবিক। তাকে লম্বা সময় ধরে ব্রিফ দিয়ে বোঝাতে হয়েছে যে, এটাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি। অচেনা, অপরিচিত একজন মানুষকেও এখানে চূড়ান্ত রকমের আপ্যায়ন করে আদর-যত্ন করার এই রীতিটা বাংলাদেশে আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এটাই এই বদ্বীপের নিজস্বতা।
বাংলার মানুষের কাছে যখন গোলাভর্তি ধান আর পুকুর ভর্তি মাছ ছিল, তখন থেকেই আতিথেয়তার এই গুণাবলী তার চরিত্রে মিশে গেছে। নিজের ঘরে কী আছে কী নেই, সেদিকে না তাকিয়ে মেহমানের সেবায় সবসময়ই শতভাগ উজাড় করে দিয়েছে এই অঞ্চলের মানুষ। বাড়ির সামনে দিয়ে অচেনা-অজানা একটা লোকও যদি যাওয়ার সময় এক গ্লাস পানি খেতে চায়, পানির সঙ্গে তাকে অন্তত একবেলা পেটপুরে খাওয়ানোটাকে অবশ্যকর্তব্য ভাবে এখানকার মানুষ। আমাদের আর্থিক অবস্থা কখনও ভালোর দিকে গেছে, কখনও খারাপের দিকে। কিন্তু অতিথিসেবায় আঁচড় পড়েনি তাতে, সাধ্যের সবটুকু দিয়ে আমরা অতিথিকে আপ্যায়ন করেছি বরাবরই। তখনও, এখনও।
অতিথি আপ্যায়নের জন্য এদেশের মানুষের উৎসব-পার্বনের দরকার হয় না। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে সেটাই উৎসব। সেই খাবার সামান্য পরিমাণে হলেও প্রতিবেশীদের জন্য আলাদা করে রাখা, রমজানে বাড়িতে বাড়িতে ইফতার পাঠানো- এগুলো আমাদের লাইফস্টাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যখন বাংলায় এসেছিলেন, তখনও নিজের ভ্রমণগাথায় এই ব্যাপারটি উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এখানকার গরম আবহাওয়া তাকে রুষ্ট করেছিল, কিন্তু মানুষের ব্যবহার করেছিল তুষ্ট।
সেই আতিথেয়তাকে উপজীব্য করেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বুনেছেন তার ‘টেস্ট অফ বাংলাদেশ’ ভিডিওর গল্প। যে গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এদেশের বৈচিত্র্যময় খাবারের স্বাদ। লরা এবং জুঁইয়ের জার্নির প্রথম পর্বটি ছিল বাংলাদেশের সৌন্দর্য নিয়ে। দ্বিতীয় পর্বে দুজনের জার্নিতে একাত্ম হয়ে গেছে কলাপাতায় বাঁশ কোড়ল-সাদা ভাত, নিতান্ত ঘরোয়া আয়োজনের রান্না, সর্ষের তেলে ভাজা ইলিশ আর গরম ভাত, শীতের পিঠাপুলি, পড়ন্ত বিকেলে ধোঁয়া ওঠা চা, পুরান ঢাকার তেহারি-বিরিয়ানি-কাচ্চি, ঐতিহ্যবাহি বাকরখানি, ঘোল, লাচ্ছি, চটপটি বা ফুচকা আর আগুন পানও।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করার বেলায় বেশিরভাগ সময়ই আমরা সমতলের মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করি। পাহাড়ে বাস করা মানুষগুলোকে মূল ধারার বাইরে রেখে দেই প্রায়ই। টেস্ট অফ বাংলাদেশের অভিনবত্ব এখানেই। নির্মাতা এবং ভিডিওর পেছনে থাকা পুরো টিম মিলে বাংলাদেশের আনাচে কানাচের অনেক ধরনের খাবারকেই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন, সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি পাহাড়ে প্রচলিত খাবারগুলোও। নীলগিরি বা নীলাচলের অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে বসে লরা এবং জুঁইকে বাঁশ কোড়লের সাদা ভাত কিংবা ‘ব্যাম্বু চিকেনে’র রসনায় সিক্ত হতে দেখে জিভে জল আসে অজান্তেই। দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ফুটিয়ে তোলার এই সচেতনতা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাবে।
এই বিজ্ঞাপন বানানোর জন্য বিশাল টিম নিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ছুটে গেছেন সুদূর দেবতাখুমে। অথচ এই ভিডিওতে দেবতাখুম জায়গা পেয়েছে সর্বসাকুল্যে পাঁচটি দৃশ্যে, স্ক্রিনটাইম দশ থেকে এগারো সেকেন্ড। দশ সেকেন্ডের দৃশ্যধারণের জন্য গোটা টিমের এই প্রচেষ্টাটাই বুঝিয়ে দেয়, ‘বিউটি অ্যান্ড টেস্ট সেলিব্রেশনে’র মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে কতটা আন্তরিক ছিল পুরো টিম।
বিউটি অ্যান্ড টেস্ট সেলিব্রেশনের এই দুই ভিডিওতে বাংলাদেশী তরুণী জুঁইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিদ্রা দে নেহা। প্রোজেক্টের কো-ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন গোলাম কিবরিয়া ফারুকী, আর ক্যামেরার পেছনে ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফিতে ফারুকীর বিশ্বস্ত সহচর শেখ রাজিবুল ইসলাম। ছবিয়াল টিমের পাশাপাশি এই দুটো ভিডিও নির্মাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আরও কিছু মানুষ, যাদের গল্পটা হয়তো অজানা রয়ে যাবে। স্থানীয় জনসাধারণ, প্রশাসন, পুলিশ, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে শুটিং স্পটগুলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান- সবার সহায়তাই পেয়েছে ছবিয়াল টিম। নইলে এই ক্যাম্পেইন নামানোটা অসম্ভব হতো, সেটা ভিডিওর আয়োজনের বিশালত্ব দেখলেই অনুমান করা সম্ভব। পুরো টিমেরও দম বেরিয়ে গেছে দুটো ভিডিও বানানোর জন্য গোটা বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে গিয়ে। সেই পরিশ্রমের ফলটা যে যথেষ্ট মিষ্টি হয়েছে, তা তো বলে না দিলেও চলছে।
জুঁই এবং লরার জার্নিটা এবারকার মতো এখানেই শেষ। শেষ হলেও রেশ রয়ে গেছে পুরোপুরি। ভিডিওর শেষ প্রান্তে এসে লরাকে জিজ্ঞেস করেছিল জুঁই, বাংলাদেশে কোন জিনিসটা তুমি সবচেয়ে বেশি মিস করবে? খুব আত্মবিশ্বাসের সাথেই লরা জবাব দিয়েছিল- ‘দ্য টেস্ট অফ বাংলাদেশ!’ এই স্বাদ শুধু খাবারের স্বাদ নয়, এই স্বাদ আতিথেয়তার, এই স্বাদ অচেনা অজানা একজন মানুষকে আপন করে নেয়ার, ঘরহারা এক তরুণীর কাছে এই স্বাদ নিজের একটা ঘর খুঁজে পাওয়ার। এই স্বাদের খোঁজ পাওয়া যাবে বাংলার পথে-প্রান্তরে, বাংলার মানুষের মনে। টেস্ট অফ বাংলাদেশ সেই স্বাদের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লরাকে, পরিচয় করিয়েছে আমাদেরকেও।