বহির্বিশ্বে যেসব রাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি থাকে, আন্তর্জাতিক ক্ষমতার রাজনীতিতে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু সাধারণত কোনো বৃহৎ শক্তি কেবল মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজস্ব সীমানার বাইরে ঘাঁটি স্থাপন করে না। নিজস্ব সীমানার বাইরে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ, ঘাঁটিটির পরিচালনা, যে রাষ্ট্রে ঘাঁটিটি স্থাপিত হয়েছে সেই রাষ্ট্রকে প্রদত্ত ‘ফি’ বা অন্য কোনো সুযোগ–সুবিধা, ঘাঁটিটিতে রসদপত্র পৌঁছানো প্রভৃতি বাবদ বহির্বিশ্বে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, এবং সাধারণত কেবল ‘মর্যাদা বৃদ্ধি’র জন্য কোনো রাষ্ট্র এত ব্যয় করে না। এজন্য বহির্বিশ্বে স্থাপিত প্রতিটি সামরিক ঘাঁটিরই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক বা ভূকৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স) এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির (জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইমারাত, ইসরায়েল, গ্রিস, জার্মানি, ইতালি, কানাডা প্রভৃতি) বহির্বিশ্বে এক বা একাধিক সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বহির্বিশ্বে যে রাষ্ট্রটির সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, সেটি হচ্ছে উত্তর আমেরিকান রাষ্ট্র ও বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট–বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০০টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সুতরাং বহির্বিশ্বে স্থাপিত সামরিক ঘাঁটির সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র সকলের শীর্ষে রয়েছে। এর পরবর্তী অর্থাৎ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরেশীয় রাষ্ট্র রাশিয়া। রাশিয়া আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের (এবং এশিয়া ও ইউরোপ উভয় মহাদেশের) বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পর রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। এমতাবস্থায় এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় রাশিয়ার বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। অবশ্য বহির্বিশ্বে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির সংখ্যার তুলনায় খুবই কম।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আইনগতভাবে রাশিয়া প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাষ্ট্র, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৯১ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের আগ পর্যন্ত সময়ে বহির্বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের বহু সংখ্যক সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া উক্ত ঘাঁটিগুলোর সিংহভাগ বন্ধ করে দেয় বা বন্ধ করতে বাধ্য হয়, এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশকিছু ভূখণ্ড থেকেও (এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, তুর্কমেনিস্তান প্রভৃতি) তারা সামরিক ঘাঁটি অপসারণ করে নেয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বহির্বিশ্বে রুশ সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু ২০১০–এর দশকে, বিশেষত ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সঙ্কটকে ঘিরে রুশ–পশ্চিমা স্নায়ুযুদ্ধ তীব্রতর রূপ ধারণের পর থেকে, রাশিয়া বহির্বিশ্বে বেশ কয়েকটি নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং আরো কতিপয় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।
আজারবাইজান: রুশ–তুর্কি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র
পশ্চিম এশীয় শিয়া মুসলিম ও বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত হাইড্রোকার্বনসমৃদ্ধ কাস্পিয়ান রাষ্ট্র আজারবাইজান প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র ছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই আজারবাইজানের ভূখণ্ডে বিস্তৃত সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া আজারবাইজানি ভূখণ্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে এবং ১৯৯৩ সালের মে মাসের মধ্যে রাশিয়া আজারবাইজান থেকে তাদের প্রায় সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। আজারবাইজানি ভূখণ্ডে কেবল একটি রুশ ঘাঁটি অবশিষ্ট থাকে এবং সেটি ছিল আজারবাইজানের কাবালা জেলায় অবস্থিত ‘কাবালা রাডার স্টেশন’ (রুশ: Габалинская радиолокационная станция, ‘গাবালিনস্কায়া রাদিওলোকাৎসিওন্নায়া স্তানৎসিয়া’)। এটি ছিল একটি ‘আর্লি ওয়ার্নিং রাডার’ ঘাঁটি এবং ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যে কোনো অংশ থেকে রাশিয়ার দিকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করা ছিল এই স্টেশনের কাজ। কিন্তু ২০১২ সালে রাশিয়া এই ঘাঁটিটিও বন্ধ করে দেয় এবং ২০১৩ সালের মধ্যে ঘাঁটির স্পর্শকাতর সরঞ্জাম আজারবাইজান থেকে রাশিয়ায় স্থানান্তরিত করে।
এর প্রায় ৭ বছর পরে ২০২০ সালে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে নতুন করে রুশ সামরিক উপস্থিতি গড়ে ওঠে। ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের অবসান ঘটে। পরবর্তী দিন, অর্থাৎ ১১ নভেম্বর, রাশিয়া ও তুরস্কের (আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আজারবাইজানের মূল সমর্থক) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং সেটির শর্তানুযায়ী নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য আজারবাইজানি ভূখণ্ডে একটি যৌথ রুশ–তুর্কি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি আজারবাইজানের আগদাম জেলায় উক্ত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটির উদ্বোধন করা হয় এবং ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কেন্দ্রটির কার্যক্রম শুরু হয়।
কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘নাগর্নো–কারাবাখ সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি ও সকল সামরিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের যৌথ রুশ–তুর্কি কেন্দ্র’ (রুশ: Совместный российско-турецкий центр по контролю за режимом прекращения огня и всех военных действий в зоне Нагорно-Карабахского конфликта, ‘সোভমেস্তনি রোসিস্কো–তুরেৎস্কি ৎসেন্তর পো কন্ত্রোলিউ জা রেঝিমোম প্রেকাশ্চেনিয়া ওগ্নায়া ই ভেসেখ ভোয়েন্নিখ দেইস্তভি ভে জোনে নাগর্নো–কারাবাখস্কোগো কনফ্লিক্তা’)। সংক্ষেপে এটি ‘যৌথ রুশ–তুর্কি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ নামে পরিচিত। পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ৬০ জন রুশ ও ৬০ জন তুর্কি সৈন্য রয়েছে এবং কেন্দ্রটির একজন রুশ ও একজন তুর্কি অধিনায়ক রয়েছেন। কেন্দ্রটির মূল দায়িত্ব বিরোধপূর্ণ নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চলে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখ এবং আজারবাইজানের মধ্যে স্থাপিত যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করা। পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সৈন্যরা গোয়েন্দা ড্রোনের সাহায্যে এই কাজটি সম্পাদন করে এবং আর্তসাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে।
আগদামে অবস্থিত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বাইরে মূল নাগর্নো–কারাবাখে একটি রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কার্যত নাগর্নো–কারাবাখের সিংহভাগ ভূখণ্ড আর্তসাখের নিয়ন্ত্রণাধীন, এবং এজন্য আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে রুশ সামরিক উপস্থিতিকে কার্যত আজারবাইজানে রুশ সামরিক উপস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, নাগর্নো–কারাবাখ আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত এবং রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে নাগর্নো–কারাবাখকে আজারবাইজানি ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। এই প্রেক্ষাপটে নাগর্নো–কারাবাখে অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিকে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে স্থাপিত রুশ সামরিক ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আবখাজিয়া: ৭ম রুশ সামরিক ঘাঁটি
পশ্চিম এশীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও জাতিগত আবখাজ–অধ্যুষিত কৃষ্ণসাগরীয় রাষ্ট্র আবখাজিয়া প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত জর্জিয়ার অধীনস্থ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ছিল এবং আবখাজিয়ার ভূখণ্ডে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া আবখাজিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেনি। ১৯৯২ সালে আবখাজিয়া জর্জিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৯২–১৯৯৩ সালের জর্জীয়–আবখাজ যুদ্ধে জর্জিয়া পরাজিত হওয়ার পর উভয় পক্ষ আবখাজিয়ায় ‘কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস’ (সিআইএস) শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাবকে সমর্থন করে। ১৯৯৪ সালে সিআইএস শান্তিরক্ষীরা আবখাজিয়ায় প্রবেশ করে, এবং কার্যত এই বাহিনীতে কেবল রুশ সৈন্য ছিল। ২০০৮ সালের রুশ–জর্জীয় যুদ্ধের পর রাশিয়া আবখাজিয়ায় একটি স্থায়ী ও একত্রিত সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০১০ সালে রাশিয়া ও আবখাজিয়ার মধ্যে এই বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া আবখাজিয়ায় ৪৯ বছরের জন্য ঘাঁটি স্থাপনের অনুমোদন লাভ করে। তদুপরি, এই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে চুক্তিটির মেয়াদ ১৫ বছর করে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আবখাজিয়া জুড়ে বহু সংখ্যক সামরিক ও সামরিক–সংশ্লিষ্ট স্থাপনার সমন্বয়ে এই ঘাঁটিটি গঠিত এবং এটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘৭ম ক্রাস্নোদার রেড ব্যানার ঝুকভ, কুতুজভ এবং রেড স্টার অর্ডার সামরিক ঘাঁটি’ (রুশ: 7-я Краснодарская Краснознамённая орденов Жукова, Кутузова и Красной Звезды военная база, ‘সিয়েদমায়া ক্রাস্নোদারস্কায়া ক্রাস্নোজনামিয়োন্নায়া অর্দেনভ ঝুকোভা, কুতুজোভা ই ক্রাস্নোয় জভেজদি ভোয়েন্নায়া বাজা’)। সংক্ষেপে এটি ‘৭ম রুশ সামরিক ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত।
আবখাজিয়ার রাজধানী সুখুমে উক্ত ঘাঁটির সদর দপ্তর অবস্থিত। উক্ত ঘাঁটির অধীনে আবখাজিয়ায় রুশ সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন শাখার অন্তত ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে এবং ঘাঁটিটির অধীনে বেশ কয়েকটি সেনাঘাঁটি, বিমানঘাঁটি ও নৌঘাঁটি রয়েছে। উক্ত ঘাঁটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আবখাজিয়ার ওপর আক্রমণ পরিচালনা থেকে জর্জিয়াকে নিবৃত্ত রাখা। তদুপরি, আবখাজিয়ার ওপর রুশ প্রভাব বজায় রাখা, দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে রুশ সামরিক ও ভূকৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করা এবং মার্কিন মিত্র জর্জিয়ার ওপর অব্যাহতভাবে চাপ প্রদান করাও এই ঘাঁটির ও আবখাজিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য।
উল্লেখ্য, জর্জিয়া আবখাজিয়াকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে এবং একে ‘রুশ দখলকৃত ভূমি’ হিসেবে অভিহিত করে। জাতিসংঘের সিংহভাগ সদস্য রাষ্ট্র জর্জিয়ার এই অবস্থানকে সমর্থন করে, এবং এই প্রেক্ষাপটে অনেকে আবখাজিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিকে জর্জীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত ‘অবৈধ’ রুশ সামরিক ঘাঁটি হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু রাশিয়া এবং জাতিসংঘের আরো ৫টি সদস্য রাষ্ট্র আবখাজিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং রাশিয়া ও আবখাজিয়া আবখাজিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে অবস্থিত রুশ ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করে।
আর্তসাখ: নাগর্নো–কারাবাখে রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনী
পশ্চিম এশীয় আর্মেনীয় অ্যাপোস্টোলিক খ্রিস্টান ও জাতিগত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত ক্ষুদ্র পার্বত্য রাষ্ট্র আর্তসাখ বর্তমানে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগর্নো–কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের সিংহভাগ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। নাগর্নো–কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত আজারবাইজানের অধীনে ছিল এবং সেখানে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া অঞ্চলটি থেকে তাদের সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৮৮–১৯৯৪ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের অবসানের পর থেকে রাশিয়া আর্তসাখকে কেন্দ্র করে চলমান আর্মেনীয়–আজারবাইজানি দ্বন্দ্ব নিরসনে সহায়তার উদ্দেশ্যে আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাব করে আসছিল, কিন্তু আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়েই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের পর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়েই আর্তসাখে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাবকে সমর্থন করে এবং ২০২০ সালের ১০ নভেম্বরে সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া আর্তসাখে ১,৯৬০ জন রুশ সৈন্যকে শান্তিরক্ষী হিসেবে প্রেরণ করে। এর পাশাপাশি ৯০টি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, ৩৮০টি অটোমোবাইল ও বিশেষ সামরিক সরঞ্জাম এবং বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টারকে শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে প্রেরণ করা হয়। উক্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, রুশ শান্তিরক্ষীরা ৫ বছর (অর্থাৎ ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত) আর্তসাখে অবস্থান করবে, এবং এরপর উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে সেখানে রুশ সৈন্যদের অবস্থানের মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আনুষ্ঠানিকভাবে, আর্তসাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষীদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে অঞ্চলটিতে আজারবাইজান এবং আর্তসাখ ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে যেন যুদ্ধ শুরু না হয় সেটি নিশ্চিত করা।
আর্তসাখের রাজধানী স্তেপানাকের্তে উক্ত রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তর অবস্থিত এবং রুশ শান্তিরক্ষীরা নাগর্নো–কারাবাখের সংযোগরেখা (অর্থাৎ আজারবাইজান ও আর্তসাখের সীমান্ত) বরাবর ও লাচিন করিডোরে (আজারবাইজানি ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে অতিক্রমকারী আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের মধ্যবর্তী সংযোগ রক্ষাকারী করিডোর) অন্তত ৩২টি পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি স্থাপন করেছে। কিছু কিছু তুর্কি ও আজারবাইজানি বিশ্লেষকের মতে, রুশরা আর্তসাখে যেসব ঘাঁটি নির্মাণ করেছে, সেগুলোর প্রতিটিতে ৩০০ জন করে সৈন্য থাকতে পারবে এবং এর ভিত্তিতে আর্তসাখে চূড়ান্তভাবে মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যের সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, এখন পর্যন্ত আর্তসাখে প্রায় ৫,০০০ রুশ সৈন্য অবস্থান করছে। এদের মধ্যে রুশ শান্তিরক্ষী বাদে রয়েছে রুশ সামরিক প্রকৌশলী, সামরিক চিকিৎসক, কারিগরি বিশেষজ্ঞ এবং রুশ জরুরি পরিস্থিতি মন্ত্রণালয়ের সদস্যরা, কিন্তু শেষোক্ত শ্রেণির ব্যক্তিরা রুশ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য হলেও রাশিয়া তাদেরকে সামরিক ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে না।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড মূলত আজারবাইজানি ভূখণ্ড এবং জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্রই আর্তসাখকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। এই প্রেক্ষাপটে অনেকে আর্তসাখে রুশ শান্তিরক্ষীদের উপস্থিতিকে কার্যত আজারবাইজানে রুশ সামরিক উপস্থিতির সম্প্রসারণ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন।
আর্মেনিয়া: ১০২তম রুশ সামরিক ঘাঁটি
পশ্চিম এশীয় আর্মেনীয় অ্যাপোস্টোলিক খ্রিস্টান ও জাতিগত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র আর্মেনিয়া প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র ছিল এবং আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে বিস্তৃত সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া আর্মেনিয়া থেকে অধিকাংশ রুশ সৈন্যকে প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র রুশ সৈন্যদল আর্মেনিয়ায় থেকে যায়। ১৯৯২ ও ১৯৯৫ সালে রাশিয়া ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সম্পাদিত দুইটি চুক্তি অনুযায়ী ঘাঁটিটির মেয়াদ ছিল ২৫ বছর এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিটি নবায়ন করার সুযোগ রয়েছে। ২০১০ সালে ঘাঁটিটির মেয়াদ ২৫ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৪৯ বছরে উন্নীত করা হয়।
ঘাঁটিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘১০২তম আলেক্সান্দর নেভস্কি অর্ডার রুশ সামরিক ঘাঁটি’ (রুশ: 102-я ордена Александра Невского российская военная база, ‘স্তোভতোরায়া অর্দেনা আলেক্সান্দ্রা নেভস্কোগো রোসিস্কায়া ভোয়েন্নায়া বাজা’), এবং এটি সংক্ষেপে ‘১০২তম রুশ সামরিক ঘাঁটি’ নামে পরিচিত। ঘাঁটিটিতে অন্তত ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ রুশ সৈন্য রয়েছে। ঘাঁটিটির ২টি সেনানিবাস গুমরি ও ইয়েরেভানে অবস্থিত এবং এর পাশাপাশি ইয়েরেভানের কাছে অবস্থিত এরেবুনি বিমানবন্দরে একটি রুশ বিমানঘাঁটি রয়েছে। তদুপরি, ২০২১ সালে চলমান আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্ত সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে রুশ সৈন্য ও সীমান্তরক্ষীরা আর্মেনিয়ার সিউনিক প্রদেশে দুটি ঘাঁটি স্থাপন করেছে।
সর্বোপরি, ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে রাশিয়া ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’র নিয়ন্ত্রণাধীন ‘বর্ডার সার্ভিস’ তুর্কি–আর্মেনীয় ও ইরানি–আর্মেনীয় সীমান্ত প্রহরা দেয়। এর পাশাপাশি ২০২১ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্ত সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্তের অংশবিশেষে রুশ সীমান্তরক্ষীদের মোতায়েন করা হয়েছে। আর্মেনিয়ায় রুশ বর্ডার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি রয়েছে এবং রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডে অন্তত ৪,০০০-৪,৫০০ জন রুশ সীমান্তরক্ষী মোতায়েন রয়েছে।
উল্লেখ্য, আর্মেনিয়া রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য এবং আর্মেনিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতির মূল উদ্দেশ্য বহিঃশত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আর্মেনিয়াকে রক্ষা করা। তদুপরি, আর্মেনিয়ার ওপর রুশ প্রভাব বজায় রাখা, দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে রুশ সামরিক ও ভূকৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করা, তুরস্ক ও আজারবাইজানের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ প্রয়োগ করা এবং পশ্চিম এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক ও ইরানের ওপর (যাদের সঙ্গে রাশিয়ার স্থল সীমান্ত নেই) নজরদারি করাও আর্মেনিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য।
কাজাখস্তান: সারি শাগান টেস্টিং রেঞ্জ
মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত সুন্নি মুসলিম ও বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত হাইড্রোকার্বনসমৃদ্ধ বৃহৎ কাস্পিয়ান রাষ্ট্র কাজাখস্তান প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র ছিল এবং কাজাখস্তানের ভূখণ্ডে বিস্তৃত সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া ও কাজাখস্তানের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী রাষ্ট্র দুটি কাজাখস্তানের ভূখণ্ডে অবস্থিত সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম ভাগাভাগি করে নেয় এবং এর সিংহভাগ কাজাখস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু কাজাখস্তানি ভূখণ্ডে অবস্থিত অল্প কয়েকটি সামরিক স্থাপনা রুশরা ব্যবহার করতে থাকে।
এগুলোর মধ্যে একটি ছিল কাজাখস্তানের বালখাশ হ্রদের তীরে অবস্থিত সোভিয়েত–নির্মিত ‘বালখাশ রাডার স্টেশন’। এটি ছিল একটি ‘আর্লি ওয়ার্নিং রাডার’ ঘাঁটি এবং বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যে কোনো অংশ থেকে রাশিয়ার দিকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপনাস্ত্রকে চিহ্নিত করা ছিল এই স্টেশনের কাজ। কিন্তু ২০২০ সালে রাশিয়া এই ঘাঁটিটি বন্ধ করে দেয় এবং ঘাঁটির স্পর্শকাতর সরঞ্জাম কাজাখস্তান থেকে রাশিয়ায় স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে।
অনুরূপ আরেকটি ঘাঁটি হচ্ছে ‘বাইকোনুর কসমোড্রোম’। দক্ষিণ কাজাখস্তানে সিরদরিয়া নদীর তীরে অবস্থিত সোভিয়েত–নির্মিত কসমোড্রোমটি বিশ্বের প্রথম মহাকাশ ঘাঁটি এবং এখান থেকে রুশ মহাকাশযানগুলো মহাকাশে উৎক্ষেপিত হয়। এর পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হতো। রাশিয়া ও কাজাখস্তানের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী, কাজাখস্তান বাইকোনুর কসমোড্রোমকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার কাছে ইজারা দিয়েছে। অবশ্য রাশিয়া কসমোড্রোমটি থেকে রুশ সৈন্যদের অপসারণ করেছে এবং সেখানে ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো বন্ধ করেছে। বর্তমান কসমোড্রোমটি বেসামরিক প্রশাসনের অধীন। এজন্য বাইকোনুর কসমোড্রোমকে আর সামরিক ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
বর্তমানে কাজাখস্তানে যে রুশ সামরিক স্থাপনাটি অবশিষ্ট রয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘সারি শাগান টেস্টিং রেঞ্জ’। সোভিয়েত–নির্মিত এই পরীক্ষণকেন্দ্রে সোভিয়েত ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি কাজাখস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৯৬ সালে রাশিয়া ও কাজাখস্তানের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী অঞ্চলটির অংশবিশেষ রাশিয়াকে ইজারা প্রদান করা হয়। বর্তমানে রাশিয়া এখানে তাদের বিভিন্ন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালায়। উল্লেখ্য, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, কাজাখস্তানে আরো কয়েকটি রুশ সামরিক স্থাপনা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না এবং সেই দাবিগুলো কতটুকু নির্ভরযোগ্য, সেটি যাচাই করার উপায় নেই।
উল্লেখ্য, কাজাখস্তান রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য এবং কাজাখস্তানে রুশ সামরিক উপস্থিতির মূল উদ্দেশ্য রুশ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে নিরাপদে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা। কাজাখস্তানের ওপর রুশ প্রভাব বজায় রাখা এবং মধ্য এশিয়ায় রুশ ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করাও কাজাখস্তানে রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য। কিন্তু কাজাখস্তান তুলনামূলকভাবে বৃহৎ একটি রাষ্ট্র এবং এজন্য আর্মেনিয়া বা আবখাজিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতির ফলে রাশিয়া সেই রাষ্ট্রগুলোতে যেরকম প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম, কাজাখস্তানের ক্ষেত্রে সেরকমটি সম্ভব নয়।