সৃষ্টির শুরু থেকেই রাজায় রাজায় লড়াই করে আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার ফল ভোগ করে। সাধারণ মানুষের শান্তির জীবনে ছেদ পড়ে। প্রতিটি যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শত কোটি পরিবার, মৃত্যু হয় লক্ষ কোটি স্বপ্নের। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে আরো বেশি। কারণ এই বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হবে শক্তিশালী সব পারমাণবিক অস্ত্র। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার আঘাতের ফলে তেজস্ক্রিয়তার যে ভয়াবহতা সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে তা আজও বিভীষিকার জন্ম দেয়।
কোনো এক শান্ত সুন্দর সকালে আপনি যখন পরিবারের সাথে নাস্তা সেরে, ফুরফুরে মেজাজে কাজে বের হবেন বলে ভাবছেন। তখন হয়তো শুনতে পাবেন যুদ্ধ পূর্ববর্তী ৪ মিনিটের সাইরেন। ৪ মিনিটের সেই সাইরেনে আপনাকে সতর্ক হয়ে উঠতে হবে এবং পরিবার নিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন দিন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে তা আপনি নিজেও জানেন না। তাই এখনই সময় নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত করার। সাইরেন শুনে ৪ মিনিটে প্রস্তুতি না নিয়ে বরং আজ থেকেই নেয়া যাক যুদ্ধের প্রস্তুতি।
তেজস্ক্রিয়তা কী? কেন আমরা তেজস্ক্রিয়তাকে এতটা ভয়ঙ্কর বলছি?
প্রকৃতিতে একমাত্র হাইড্রোজেন (প্রোটিয়াম বাদে) ছাড়া বাকি সব মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন এবং নিউট্রন রয়েছে। প্রোটন এবং নিউট্রন নিউক্লিয়ার বন্ধনশক্তির মাধ্যমে নিউক্লিয়াসে আবদ্ধ থাকে। আর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের বাহিরে ঘূর্ণায়মান থাকে। প্রতিটি মৌলের নিউক্লিয়াসই স্থিতিশীল (Stable) অবস্থায় থাকতে চায়। আর নিউক্লিয়াসকে স্থিতিশীল রাখতে হলে প্রোটনের সাথে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নিউট্রনও থাকা জরুরি।
নিউট্রনের সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে কম বা বেশি হলে নিউক্লিয়াসটি অস্থিতিশীল (Unstable) হয়ে পড়ে। আর এই অস্থির নিউক্লিয়াস নিজেকে স্থির করতে প্রোটন এবং নিউট্রন নির্গত করে। যেসব অস্থির বা অস্থিতিশীল নিউক্লিয়াস নিজের প্রোটন এবং নিউট্রন নির্গত করে তাদেরকে তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস বলে। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর মধ্যে ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, থোরিয়াম অন্যতম।
কার্বন-১৪ এবং নিয়ন বাদে যেসব মৌলের পারমাণবিক ভর ২০৬ এর অধিক তারা সাধারণত তেজস্ক্রিয় হয়। ভারী নিউক্লিয়াসের দরুন এতগুলো প্রোটন এবং নিউট্রনকে নিউক্লিয়ার বন্ধন শক্তি দ্বারা আবদ্ধ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এরা যেকোনো তিন ধরনের রশ্মি, কখনো যেকোনো একটি রশ্মি নির্গমণ করে। একে তেজস্ক্রিয় ভাঙন বলে। যেমন- আলফা রশ্মি, বিটা রশ্মি এবং গামা রশ্মি। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলে এই তিন ধরনের রশ্মি নির্গত হবে।
এই তিন ধরনের রশ্মির মধ্যে আলফা রশ্মি বেশ সাদাসিধে এবং গোবেচারা টাইপের। কারণ আলফা রশ্মি হলো সর্বাপেক্ষা ভারী এবং হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের নিঃসরণ। একটি সাধারণ কাগজ দিয়েও একে থামানো যায়। তাই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধারণ কাপড় পরলেও একে সামাল দিতে পারবেন। তবে নিঃশ্বাস এবং খাবারের সাথে দেহে প্রবেশ করলে বাঁচার আর উপায় থাকবে না। কারণ এভাবেই হত্যা করা হয়েছিল আলেক্সান্ডার লিটভিনেনকোকে। তার চায়ের কাপে পোলোনিয়াম-২১০ মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল, যা ছিল আলফা কণা নিঃসরণকারী তেজস্ক্রিয় মৌল। তবে ভরসার বিষয়, আলফা রশ্মি উৎপত্তিস্থল থেকে কয়েক সেন্টিমিটারের বেশি ভ্রমণ করতে পারে না।
বিটা রশ্মি এতটা সাদাসিধে নয়। তেজস্ক্রিয় ভাঙনের ফলে যে ইলেক্ট্রন বা পজিট্রন নির্গত হয় তাকে বিটা রশ্মি বলে। এই রশ্মি ১০ মিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে। তারপর তা নিজেই বায়ুমন্ডলে শোষিত হয়ে যায়। বিটা রশ্মিকে থামাতে ৩ মিলিমিটার পুরু তামার পাত, কাঠ বা অ্যালুমিনিয়ামের বাধার প্রয়োজন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধারণ কাপড় পরলেও এর হাত থেকে মোটামুটি নিস্তার পাওয়া যাবে। তবে চামড়ায় লাগলে জ্বালাপোড়া হবে। একে বিটা বার্ন বলে।
এবার আসা যাক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গামা রশ্মির আগ্রাসনে। গামা রশ্মিকে থামাতে ৮ সেন্টিমিটার পুরু সীসার পাতের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া গামা রশ্মি অনায়াসে মানব শরীর ভেদ করে চলে যেতে পারে। সেই সাথে ক্রমে ক্রমে আপনার ডিএনএর গঠন বদলানো থেকে শুরু করে চামড়া, চুল এবং হাড়ের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কখনো কখনো তা ক্যান্সার কোষও সৃষ্টি করে।
যেভাবে রক্ষা করবেন নিজেকে ও নিজের পরিবারকে
এই তো গেল তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতার কথা। এখন আসা যাক যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কীভাবে নিজেকে এবং পরিবারকে এই ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন সে বিষয়ে। কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, আমাদের দেশে তেজস্ক্রিয় বোমা হামলা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তাহলে এত আয়োজন করে প্রস্তুতি নেয়ার কী দরকার? দরকার আছে। আমাদের দেশে বোমা হামলা না হোক। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তো হতেই পারে। আর এটা সাধারণ কোনো বোমা নয় যে শুধু ঐ অঞ্চলের ক্ষতিসাধন হবে, এটা পারমাণবিক বোমা। আর তেজস্ক্রিয়তা বাতাসের মাধ্যমের ছড়ায়।
তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচতে হলে প্রথমে থাকার জায়গা নির্বাচন করতে হবে। বাহিরের পরিবেশের সাথে যত বেশি স্তর তৈরি করতে পারবেন ততই সুবিধা। সবচেয়ে ভালো হবে মাটির নিচে অবস্থান করতে পারলে। শহরে অনেক বাড়িতেই মাটির নিচের ঘর বা সেলার (Cellar) স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আপনার বাড়িতে যদি সেলার না থাকে তবে গ্রামে বা বাসার আশেপাশে পরিবারের থাকার মতো জায়গা নিয়ে একটি গর্ত খুঁড়ুন এবং গর্তের উপরে ৩.৩-৪ ফুট উঁচু করে মাটি দিন। তাছাড়া আপনি চাইলে দক্ষ প্রকৌশলীর সাহায্য নিয়ে বাতাস চলাচল এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাও করতে পারেন।
এবার আসা যাক, যাদের গর্ত খুঁড়ে থাকার মতো অতিরিক্ত জায়গাও নেই এবং সামর্থ্যও নেই তাদের কথায়। যারা শহরে বাসা-বাড়িতে বাস করেন তারা বাসার বাহিরে দেয়ালের সাথে অতিরিক্ত ষ্টীল, মাটি, কংক্রিট, কাঠ ইত্যাদির যেকোনো একটি ব্যবহার করে পুরু স্তর তৈরি পারেন। নিচের তালিকায় কোনটা দিয়ে কতটুকু পুরু স্তর তৈরি করা যেতে পারে তা দেয়া হলো-
- ষ্টীল ২১ সেমি (০.৭ ফুট)
- পাথর ২-৩ ফুট
- কংক্রিট ২.২ ফুট
- কাঠ ৮.৮ ফুট
- মাটি ৩.৩ ফুট
জানালা-দরজা সবসময় বন্ধ রাখবেন। রেডিও বা টেলিভিশনের সংবাদে যখনই খবর পাবেন কাছাকাছি কোথাও তেজস্ক্রিয় বোমা হামলা হয়েছে তখনই ৫ মিনিটের মধ্যেই নিকটস্থ দালানে আশ্রয় নিন। তেজস্ক্রিয় বোমা হামলার পর কমপক্ষে ২ দিন ঘর থেকে কোনো অবস্থাতেই বের হওয়ার চেষ্টা করবেন না। সবচেয়ে ভালো হয় ৮-৯ দিন ঘরে কিংবা মাটির নিচের তৈরি করা গর্তে অবস্থান করলে। কারণ ফিশন বোমায় ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় আয়োডিনের অর্ধায়ু ৮ দিন।
প্ল্যান করে সব কিছু গোছানো
৮-৯ দিন অবস্থান করার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ঘরে মজুদ করতে হবে। কারণ বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা থাকলে তা খাবারেও পড়বে। আপনি যদি ভেবে থাকেন ২ দিন পরে গিয়ে বাজার থেকে খাবার কিনে নিয়ে আসবেন তাহলে এখনই সেই চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিন। কারণ ততদিনে খাবারও তেজস্ক্রিয়তা হয়ে উঠবে। তাই প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনার।
খাবারদাবার মজুদ
অপচনশীল খাদ্য মজুদ রাখার চেষ্টা করবেন। অপচনশীল খাবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যালরি পাওয়া যাবে এমন খাদ্যের তালিকা তৈরি করাই শ্রেয়। তালিকায় যা যা অবশ্যই রাখবেন- চাল, আটা, ময়দা, শিম শুকনা জাতীয় সবজি যেমন শুকানো মটরশুঁটি, শুকনা মরিচ, চিনি, মধু, খেজুর, ওটস, নুডলস, পাস্তা, গুঁড়া দুধ ইত্যাদি দীর্ঘদিন অপচনশীল খাদ্য মজুদ করতে পারেন। খাবারদাবার রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার ও চুলার ব্যবস্থা রাখবেন।
বড়সড় কন্টেইনারে পানির মজুদ রাখতে হবে। প্রথমে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে কন্টেইনারটি ধুয়ে নিন। তারপর পানি সিদ্ধ করে ছেঁকে কন্টেইনারে রাখুন। পানি এমনভাবে মজুদ করবেন যেন প্রতিদিন পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য ১ গ্যালন করে পানির বন্দোবস্ত থাকে।
কাল সকালে বাজারে গিয়ে সবকিছু কিনে এনে মজুদ করলেন। ফেলে রাখলেন যুদ্ধ কবে শুরু হবে সেজন্য। এমন কাজ করবেন না। নিয়মিত মজুদকৃত খাবার খাবেন এবং পানি ব্যবহার করবেন। আবার সেগুলো ঠিকঠাক ভরে রাখবেন। এতে খাবার এবং পানি দুটোই ভালো থাকবে।
যোগাযোগ করার ডিভাইস মজুদ করা
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুদ্ধের এবং সারা বিশ্বের সব খবরাখবর জানা জরুরি। তাই শুধুমাত্র ফেসবুক কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের আশায় বসে না থেকে সৌরচালিত ব্যাটারি দিয়ে চলে এমন রেডিও কিনে রাখতে পারেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। মোবাইল সবসময় চার্জ করার সুযোগ না-ও পেতে পারেন। তাই ফোনের ব্র্যান্ডের সাথে মিলিয়ে সৌরচালিত চার্জার কিনে ফেলুন।
প্রাথমিক চিকিৎসার প্রস্তুতি
যুদ্ধে নিহত না হোক কেউ না কেউ আহত হবে। এমন চিন্তা মাথায় রেখে এখন থেকেই কেটে গেলে সেলাই করা, ব্যান্ডেজ করা, প্লাস্টার করা ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় টুকটাক প্রাথমিক চিকিৎসা শিখে ফেলুন। এর জন্য ইউটিউব আপনাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে। তাছাড়া তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলো ত্বকে জ্বলুনির সৃষ্টি করে। তাই আফটার বার্নার, স্যাভলন, এন্টিসেপটিক ক্রিম, প্যারাসিটামল, নাপা, কাশির সিরাপ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় ঔষধ সামগ্রীও মজুদ করে রাখবেন। অতিরিক্ত ব্যাটারি সহ ফ্ল্যাশলাইট, নাকে ধুলাবালি যাতে না প্রবেশ করে সেজন্য অতিরিক্ত মাস্ক, ময়লা ফেলার জন্য ঝুড়ির বদলে বড় বড় পলিথিন, রেঞ্চ, পিলার এবং স্ক্রু ড্রাইভারও মজুদ রাখবেন। কিছু দিন পর পর চেক করে দেখবেন সব ঠিক আছে কিনা।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই সম্পূর্ণ শরীর ঢাকা যায় এমন কাপড় পরবেন। চেষ্টা করবেন হাতে গ্লাভস বা হাত মোজা এবং মুখে মাস্ক পরার। ঘরে ঢোকার পূর্বে হাত দিয়ে কাপড় ঝাড়বেন। এতে ঘরের ভেতরে অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কম হবে।
তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সবচেয়ে নিরাপদ থাকবে ৫ টি দেশ। প্রথমেই নিউজিল্যান্ড তারপর যুক্তরাষ্ট্র, আইসল্যান্ড, চিলি এবং গ্রীনল্যান্ড। কারণ এই দেশগুলোতে প্রচুর নিউক্লিয়ার বাঙ্কার রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র বাদে বাকি সব দেশই শান্তির পথে চলে।
ফিচার ইমেজ – future.wikia.com