নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নাম ‘ইত্যাদি’। অনুষ্ঠানটি আজও বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে দর্শকদের মনে এক অন্য উচ্চতায় সাফল্যমন্ডিত হয়ে আছে। একটা সময় ছিল টিভি পর্দায় ‘কেউ কেউ অবিরাম চুপি চুপি’ গানটি ভেসে উঠলেই সকলে প্রবল উৎসাহে টিভি সেটের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। আর এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি থেকে উঠে এসেছে অনেক গায়ক, অভিনেতা, শিল্পী ও কলাকুশলী। আজ এমনই কিছু গান নিয়ে আলোচনা করা হলো যা ইত্যাদিতে প্রচারিত হওয়ার পর গানগুলোর জনপ্রিয়তা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আমি আগের ঠিকানায় আছি- মুরাদ
ইত্যাদিতে প্রচারিত গানগুলোর মধ্যে সেই সময়কার সাড়া জাগানো একটি গান ছিল ‘আমি আগের ঠিকানায় আছি’ গানটি। অসম্ভব সুন্দর গানের কথা এবং হৃদয় ছোঁয়া সুরে শ্রোতাদের অসম্ভব ভালো লেগে যায় গানটি। গম্ভীর কন্ঠে মুরাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন শ্রোতার মনে না পাওয়ার ক্রন্দন তৈরি করেছিল যা গানটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সঙ্গীতা থেকে মুরাদের একটি মাত্র অ্যালবাম ‘তোমারই অজান্তে’ প্রকাশিত হয়। ইত্যাদিতে প্রচারিত গানটি এখনো শ্রোতাদের নস্টালজিক করে তোলে। গানটির ভিডিওতে মডেল হয়েছিলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী তানিয়া।
এই দেশে এক শহর ছিল- নাফিস কামাল
এখন যে গানটির কথা বলতে যাচ্ছি এটি একসময় অসংখ্য মানুষের মুখে মুখে ছিল। তখনকার সময়ের উঠতি মডেল রোমানা একজন কণ্ঠ প্রতিবন্ধীর চরিত্রে অভিনয় করেন। আর নাফিস কামালের প্রথম টিভি পর্দায় আগমন এই গানটির সাহায্যে।
কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখায় এবং নকীব খানের সুরে ‘এলোমেলো’ গানটি এখনো শ্রোতাদের নিয়ে চলে সেই দোতলা বাড়ির সামনে, যেখানে গায়ক নাফিস কামাল বারবার ছুটে যায় সেই নাম না জানা মেয়েটির সন্ধানে।
১৯৯৮ সালে নাফিস কামালের প্রথম একক অ্যালবাম ‘এলোমেলো’ প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামের জন্যে নির্মলেন্দু গুন, কবি কাজী রোজী, কাওসার আহমেদ চৌধুরী, লাকী আখন্দ, নকীব খান, ফুয়াদ নাসের বাবু, আশিকুজ্জামান টুলুর মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা কাজ করেন। ‘এলোমেলো’ অ্যালবামের প্রায় বছরখানেক পর, ২০০১ সালের দিকে নাফিস কামাল তার দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘অনুভবে একা’ প্রকাশ করেন।
আমার একটা নদী ছিল- পথিক নবী
ইত্যাদিতে প্রচারিত জনপ্রিয় গানের মধ্যে পথিক নবীর গাওয়া ‘আমার একটা নদী ছিল’ গানের কথা না বললেই নয়। ১৯৯২ সালের দিকের তৈরি করা গানটি পথিক নবী ২০০২ সালে ইত্যাদিতে উপস্থাপন করার পর থেকে গানটি সর্বসাধারণের অন্তরের গান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আকস্মিক জনপ্রিয়তায় পথিক নবীকে পরবর্তী কয়েক বছর অডিও জগতে অনেক কাজ করতে দেখা যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে পথিক নবীর জনপ্রিয়তা। তবে এখনো পথিক নবীর নাম উঠে আসলে ‘আমার একটা নদী ছিল’ গানটি তার প্রাপ্তির খাতার বিশাল অংশ জুড়েই থাকে। ২০০৫ সালের পর থেকে সঙ্গীতাঙ্গনে তেমনভাবে সক্রিয় না হলেও বর্তমানে তিনি লেখালেখি এবং গানের সাথে যুক্ত আছেন।
রিটার্ন টিকেট হাতে নিয়া- মমতাজ
গানের পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন মমতাজ। ছোটবেলা থেকেই সুরের ভেলায় ভাসতে ভাসতে বয়ে চলে তার সংগীত জীবনের পথচলা। পিতা মধু বয়াতির হাত ধরে সেই কিশোরী বয়স থেকেই কণ্ঠে গানের সাধনার শুরু। মিডিয়া জগতের সংস্পর্শ ছাড়াই ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন এই শিল্পী। খুব অল্প সময়ে গান তুলে ফেলার বিশেষ গুণ আছে সংগীতশিল্পী মমতাজের। ইত্যাদির সর্বেসর্বা হানিফ সংকেত তখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন মেধাবী এই গুণী শিল্পীকে। মমতাজ তখন হানিফ সংকেতের নামটা পর্যন্ত শোনেননি। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে আসলেন ঢাকায়, রেকর্ডিং করলেন ‘রিটার্ন টিকেট হাতে নিয়া’ গানটি। প্রচারের সাথে সাথে সাড়া পড়ে গেল শহরাঞ্চলে। কেননা গ্রামাঞ্চলে অনেক আগে থেকেই পরিচিত মুখ মমতাজ। ৩৫০টিরও উপরে অ্যালবামে কাজ করা হয়ে গিয়েছে তখন। ইত্যাদিতে মমতাজের গান প্রচার পাওয়ার সাথে সাথে তার খ্যাতি আরও বহুলাংশে বাড়তে থাকে। এরপর থেকে শুরু হয় মিডিয়া জগতে মমতাজের পদার্পণ। বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, নাটক ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত গান গাইতে থাকেন এই দরাজ কন্ঠশিল্পী। এত জনপ্রিয় গানের মাঝে এখনও শ্রদ্ধেয় রফিকুজ্জামানের লেখা ইত্যাদির জন্যে গাওয়া গানটি শ্রোতাদের মনে নাড়া দেয়। পরবর্তীতে ‘রিটার্ন টিকেট’ নামক অ্যালবামে গানটি অ্যালবামবন্দী হয়।
গাড়ি চলে না চলে না- দলছুট
‘আহ’ অ্যালবাম দিয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ হওয়া ব্যান্ড দলছুট তখনও তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি, ছিল বাপ্পা মজুমদারের একক বেশ কিছু অ্যালবামও। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ বারীন মজুমদারের ছেলে হিসেবে বাপ্পা মজুমদারের সুর ও সঙ্গীতের উপর বেশ শক্তপোক্ত দখল ছিল তা বলাই বাহুল্য। হানিফ সংকেতের চোখ এড়িয়ে যায়নি বাপ্পা আর সঞ্জীব চৌধুরীর রসায়ন। শাহ আবদুল করিম বয়াতির গান ‘গাড়ি চলে না, চলে না রে’ ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করলেন দর্শকদের সামনে, অ্যালবামবন্দী করলেন ‘হৃদয়পুর’ নামে অ্যালবামে। সেই থেকে দলছুটের গাড়ির চাকা আর আঁটকে যায়নি। কিন্তু ব্যান্ড হিসেবে দলছুট এক বিশাল ধাক্কা খেল ব্যান্ডের প্রাণ, গায়ক, লেখক, সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুতে। সেই থেকে দলছুট একটু ধীর গতিতে চললেও বাপ্পা মজুমদার বর্তমানে সংগীত জগতে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।
একদিন পাখি উড়ে- আকবর
ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনায় হানিফ সংকেত সর্বদাই সচেষ্ট। শিল্পের খোঁজে ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। তুলে এনেছেন অনেক সাধারণ মুখ, করে তুলেছেন অসাধারণ। তেমনি এক শ্রমজীবী শিল্পী আকবর, যাকে দিয়ে তিনি গাইয়েছিলেন বিখ্যাত গায়ক কিশোর কুমারের গাওয়া ‘একদিন পাখি উড়ে’ গানটি। শ্রোতারা যেন খুঁজে পেলেন নতুন এক কিশোর কুমার আর আকবর হয়ে উঠলেন শ্রমজীবী মহলের আশার আলো। পরবর্তীতে হানিফ সংকেতের তত্ত্বাবধানে প্রকাশ পায় তার প্রথম মৌলিক গানের একক অ্যালবাম। এই অ্যালবামে তার গাওয়া ‘হাতপাখার বাতাসে’ গানটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
ভিক্ষা কেমনে চাই- সান্টু
খুব পরিচিত মুখ না হলেও ইত্যাদিতে প্রচারিত এই গানটি সেসময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পুরো নাম হেদায়াতুল আজিজ সান্টু। নিজের লেখা ও সুর করা গানটি খুব সহজেই শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে তুলেছিল সেসময়। পরবর্তীতে চাইম ব্যান্ডের খালিদের সাথে ‘জন্ম’ নামক একটি অ্যালবামে গানটি স্থান পায়। তবে সান্টুকে সংগীত জগতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়নি।
নৌকা জামিন নাটাই- পান্থ কানাই
সংগীত মহলে ড্রামার পান্থ কানাই নামেই অধিক জনপ্রিয় এই গুণী শিল্পী। চট্টগ্রামের ছেলে পান্থ কানাইয়ের ছোটবেলা থেকেই ছিল সুরের দিকে ঝোঁক। তবলা বাজাতে খুব পছন্দ করতেন। পরবর্তীতে ড্রাম বাজানো শুরু, বাজিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডে। জেমসের ব্যান্ড ‘নগরবাউল’ প্রতিষ্ঠার শুরুর দু’বছর ব্যান্ডের নিয়মিত ড্রামার ছিলেন পান্থ কানাই। পরবর্তীতে নিজের ব্যান্ড ‘তান্ডব’ প্রতিষ্ঠা করেন। তান্ডব ব্যান্ডের একমাত্র অ্যালবাম ‘মা’ প্রকাশ করেন ২০০১ সালে। এরপর ‘আদম হাওয়া’ এবং ‘মন কারিগর’ নামক দুটি একক অ্যালবাম বের করেন। একসময় ইত্যাদিতে প্রচারিত হয় তার ‘নৌকা জামিন নাটাই’ গানটি। গানটি প্রচার হওয়ার পর শ্রোতারা নতুন করে খুঁজতে শুরু করলেন পান্থ কানাইকে। পরবর্তীতে ‘নৌকা জামিন নাটাই’ নামে তৃতীয় একক অ্যালবাম মুক্তি দেন ২০০৩ সালের শেষ দিকে। এছাড়াও পান্থ কানাইয়ের কিছু রিমিক্স গান, যেমন ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তিনি সর্বশেষ তিন গানের একক অ্যালবামের কাজ করেন যার নাম ‘দেহখাঁচা’।
আকাশ সংস্কৃতির এই অস্থির যুগে, ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এখনও খুব দাপটের সাথে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচার হয়ে আসছে ইত্যাদি। উল্লেখিত গানগুলো ছাড়াও ইত্যাদির অসংখ্য গান এখনও সাধারণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। নকুল কুমার বিশ্বাস ছিলেন ইত্যাদির নিয়মিত গায়ক। সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসংগতি ছিল নকুল কুমার বিশ্বাসের গানের মূল বিষয়। ২০০৪ সালে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে প্রয়াত শিল্পী খালিদ হাসান মিলুর সাথে গান করে জনসম্মুখে উঠে আসেন তার সন্তান প্রতীক হাসান। এছাড়াও এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, নকীব খান, তপন চৌধুরীদের মতো অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীও ইত্যাদিতে নিজেদের পরিবেশনা উপস্থাপন করেছেন। এখনও দর্শকরা বিপুল আগ্রহ নিয়ে বসে থাকেন ইত্যাদিতে নতুন কিছু পাওয়ার আশায়।
ফিচার ইমেজ- dailymotion.com