‘মুগানগোয়া’ দক্ষিণ কোরিয়ার এক অতি পরিচিত ফুল। ইংরেজিতে ‘রোজ অফ শ্যারন’ নামে বেশি পরিচিত। হাজার হাজার বছর ধরে এই ফুল কোরিয়ানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতির ঐতিহ্যের সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই কোরিয়ার জনগণ এই ফুলের চাষ করে আসছে। খ্রিস্ট জন্মেরও বহু আগে থেকে এই ফুলটি কোরিয়ায় পাওয়া যায়। এমনকি তারও আগে থেকেও ফুলটি কোরিয়ার উপদ্বীপে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত বলে ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞদের।
হিবিসকাস সিরিয়াকাস গোত্রের মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই ফুলের উৎপত্তিস্থল এশিয়ায়। ‘হিবিসকাস’ কথাটির উৎপত্তি পারসিক ‘হিবিস’ শব্দ থেকে, যিনি মিশরের সৌন্দর্যের দেবতা। ফুলটি দেখতে মাঝারি আকৃতির, লম্বা সোনালি ডাঁটাযুক্ত। ঐতিহাসিকভাবে, কোরিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং জনজীবনের নানা উত্থান-পতনের এক নীরব সাক্ষী এই মুগানগোয়া ফুলটি। তাই আজ ‘মুগানগোয়া’ দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় ফুল।
কোরিয়ানদের অস্তিত্বের সাথে কীভাবে এই ফুল জড়িয়ে রয়েছে তা জানতে হলে কোরিয়ার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। সিলা কিংডমের রাজত্বকালে এই দেশকে মুগানগোয়ার দেশ হিসেবে ডাকা হতো। রাজা হুগোং ওয়াং-এর লেখা একটি চিঠিতেও এই ফুলের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। রাজা হুগোং চিঠিটি লিখেছিলেন তাং সম্রাটকে। চিঠিতে অনেক দুঃখে তিনি বলছেন যে, এই সেই মুগানগোয়ার দেশ, যা খুবই সুজলা সুফলা ছিল, তা দিনে দিনে রুক্ষ হয়ে পড়ছে। রাজা ইয়াংজের রাজত্বকালেও গোরিইয়ো রাজবংশের (খ্রিস্টপূর্ব ৯১৮- ১৩২৯) নথিতেও মুগানগোয়া ফুলের কথা পাওয়া যায়।
খুবই মজার ব্যাপার এই যে, একজন চীনা ভৌগোলিকের লেখা নথি ‘শানহাইজিং’-এ কোরিয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেকক মুগানগোয়া ফুলের কথা বলেছেন। সেই নথি হতে জানা যায় যে, একটি দেশ যখন সভ্যতার আলো দেখছে, অর্থাৎ দেশের মানুষ সভ্য হয়ে পরিচ্ছদ এবং অস্ত্রের ব্যবহার শিখছে, যুদ্ধ করাকে ঘৃণা করতে শিখছে, বাঘকে পোষ মানতে শিখছে, তখন সেখানে প্রচুর পরিমাণে মুগানগোয়া সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফোটে এবং সন্ধায় ঘুমিয়ে পড়ে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুগানগোয়া হচ্ছে কোরিয়ার আদি এবং মৌলিক দেশীয় ফুল।
১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়াবাসীদের জীবনের এক অন্ধকার সময়। যখন জাপান কোরিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন এই ফুলটি লাগানো বা এই ফুলের গাছ রোপন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি, জাপানীরা ফতোয়া জারি করেছিলেন যে, কেউ মুগানগোয়ার গাছ রোপণ করতে পারবে না। সেসময় জাপানীরা বিপুল সংখ্যায় এই ফুলের গাছ কেটে ফেলে, আবার কোথাও কোথাও পুড়িয়ে দেয়।
এর কারণ ছিল, এ সময় কোরিয়ার অনেক স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা জাপানের আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা ছড়িয়ে পড়েছিল চীনের সাংহাই, মাঞ্চুরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়। সেই সময় এই মুগানগোয়া ফুলই তাদের একতা ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে কাজ করতে থাকে। জাতিগত আনুগত্য, জনগণের একতাবদ্ধ হওয়ার পিছনে এই ফুলের অবদান বুঝতে পেরে জাপানীরা এই ফুলের প্রতি নির্মম হয়ে ওঠে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কোরিয়ার এই বিপর্যয়ের সময় এই মুগানগোয়া ফুল, কোরিয়ানদের নিজেদের প্রতি বিশ্বাস, দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের এক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
জাপানী উপনিবেশকালে, কোরিয়ান শিশুদের শেখানো হতো মুগানগোয়া ফুল শরীরের ও চোখের জন্য খুবই বিপদজনক। এই ফুল চোখের ক্ষতি করে, চামড়ায় প্রদাহ সৃষ্টি করে। তাই এই গাছ লাগানো উচিত নয়। এমনকি কোনো কোনো স্কুলে শিশুদের উদ্বুদ্ধ করা হতো এই ফুল গাছ উপড়ে ফেলার জন্য। কোনো কোনো স্কুলে তো আবার পুরষ্কার দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছিল। যেসব শিশু এই গাছ শিকড়সহ উপড়ে তুলে আনতে পারবে তাদের পুরষ্কার দেওয়া হতো।
মূলত মুগানগোয়া ফুলকে কোরিয়ানদের মন থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য জাপানীদের এই হীন চেষ্টা যে খুব সফল হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। এটি অনেকটা বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার জন্য পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। সেদিন বাংলাদেশের জনগণকে যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া এবং শোনা থেকে আটকে রাখা যায়নি, ঠিক তেমনি কোরিয়ার জনগণকেও মুগানগোয়া ফুলের রূপ, রস, গন্ধ আর তার আবেগ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়নি। কোরিয়ানরা জাপানীদের এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়েছিল।
জাপানের আগ্রাসনে কিছুদিন এই ফুলের চাষ ব্যহত হয়েছিল। অনেকদিন এই ফুল কোরিয়ানদের ঘরের ফুলদানীতে শোভা পেতো না। তাই বলে কি কোরিয়ানরা এই ফুলকে ভুলে গিয়েছিল? না, তা কখনোই ঘটেনি। এই ফুলকে আরো প্রবলভাবে নিজেদের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে নিয়েছিল কোরিয়ার জনগণ।
জাতীয় প্রতীককে বিলুপ্ত করে একটি জাতিকে, একটি দেশকে নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে খুবই বিরল। কিন্তু সে চেষ্টা বিফল হয়েছে। কোরিয়ানদের দমিয়ে রাখা যায়নি। তারা জাপানীদের সর্তক দৃষ্টি এড়িয়ে এই মুগানগোয়ার গাছ রোপণ করেছিল। কোরিয়ান মেয়েরা তাদের কাপড়ে এই ফুলের নকশা দিয়ে কোরিয়ার ভৌগলিক সীমানা ফুটিয়ে তুলতো এবং গর্ব অনুভব করতো। এই ফুলটিকে কেন্দ্র করে কোরিয়ানদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ হতে লাগলো। এই ফুলের গুচ্ছকে তারা নিজেদের ঐক্যের প্রতীক বলে ভাবতে শুরু করলো।
মুগানগোয়া ফুলের গাছ নাতিশীতোষ্ণ জায়গাতেই বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এদের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২০০। মুগানগোয়া ফুলের পাতলা, ছড়ানো পাতায় আছে অনেক শিরা, ফুলগুলো দেখতে বেশ বড় আকারের ঘন্টার মতো। এর পাঁচটি করে পাপড়ি থাকে।
এই ফুল বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। লাল, সাদা, গোলাপী এবং উজ্জ্বল রক্তবর্ণের এই ফুল প্রচুর পরিমাণে ফোটে। জুলাইয়ের শুরু থেকে অক্টোবরের শেষ সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ফোটে এই ফুল। ফুলের মৌসুমে কোনো কোনো গাছে প্রায় দুই থেকে তিন হাজারেরও বেশি মুগানগোয়া ফুল ফুটতে দেখা যায়। দূষণ প্রতিরোধেও এই ফুলের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে।
এই গাছ জনজীবনে খুবই উপকারী। জোসন রাজবংশের রাজ পরিবারের চিকিৎসক হু জুন রচিত ২৫ ভলিউমের মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়ায় মুগানগোয়া ফুলের গুণাবলীর কথা বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে অনিদ্রা রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে এই ফুল খুবই উপকারী বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও আগেকার দিনের চিকিৎসকরা মুগানগোয়া ফুলের রস নানা রোগব্যাধির উপশমে, বিশেষত চর্মরোগ সারানোর কাজে ব্যবহার করতেন। জার্মানরা এর পাপড়ি থেকে চা তৈরি করতো। জাপানীরা এই ফুল দিয়ে তৈরি করতো লোভনীয় খাবার।
জাপানের আগ্রাসন কোরিয়ানদের থামিয়ে দিতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও তাদের ধ্বংস করা যায়নি। আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা তাদের স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছে। এই মুগানগোয়াকেও শত চেষ্টায় নির্মূল করা যায়নি। বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মানসিকতার জন্যই হয়তো কোরিয়ানদের জীবনে, তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে এই ফুলের অবদান অপরিসীম।
তাই এখনো কোরিয়ানদের বাড়ির আঙিনায়, সরকারী-বেসরকারী স্থাপনায়, স্কুল-কলেজে, রাস্তাঘাটে এই ফুলের গাছ লাগাতে কার্পণ্য করে না সেদেশের জনগণ। এই ফুল শোভা পায় বাড়ির ড্রইং রুম থেকে লিভিং রুমে, অফিসের কর্মকর্তাদের বসার রুম থেকে মিটিং রুমে- সব জায়গায়। এমনকি কোরিয়ানদের পোশাক-পরিচ্ছদেও এই ফুলের রেপ্লিকা, প্রিন্ট দেখতে পাওয়া যায়।
কোরিয়ানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে এই ফুল যেন কোরিয়ান ভাবধারা ও চিন্তা-চেতনার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাই তো মুগানগোয়া বা মৃত্যুঞ্জয়ী এই ফুলকে তারা তাদের জাতীয় ফুল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে দু’বার ভাবেনি। এই ফুল তাদের কাছে গর্বের বস্তু। হয়তো এই ফুলের মাধ্যমেই কোরিয়ানরা আজ আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ। এই ফুলের কারণেই তারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
ফিচার ইমেজ: wikimedia commons