Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেগালোডন: সমুদ্রের বুকে ভয়াবহ এক দানব

গোড়ার কথা

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজারো দ্বীপ। এর মধ্যে একগুচ্ছ দ্বীপ রয়েছে যেগুলো পলিনেশিয়া নামে পরিচিত। এখানকার মানুষেরা বাইরের দুনিয়া থেকে একটু আলাদা। তাদের ভাষা, রীতিনীতি, এমনকি ধর্ম-সংস্কৃতি-উপকথা নিজেদের মতো গড়ে উঠেছে। তাদের জীবন-জীবিকা সবকিছু সমুদ্রকেন্দ্রিক। সুতরাং তাদের গল্প-উপকথার বড় অংশ দখল করে রেখেছে বিশাল কুল-কিনারাবিহীন রহস্যময় সমুদ্র।

সন্ধ্যা নেমে এলে সব কাজ সেরে যখন বিশ্রাম নেয়ার সময় হয়, আজও ওরা একটি গল্প বলে, ভয়ানক এক প্রাণীর কথা, সমুদ্রের এক দানবের কথা। এত বড় প্রাণী কেউ কখনো দেখেনি আজকের পৃথিবীতে। তারা বসবাস করতো ঐ সমুদ্রের বুকে।

“তা কত বড় হবে সেই সমুদ্রের দানো?” ঝিকিমিকি তারার আলেয়ার নিচে বারান্দায় বসে যদি কোনো দুরন্ত বালক তার প্রপিতামহকে জিজ্ঞাসা করতো, তাহলে বৃদ্ধ প্রপিতামহ যে যৌবনে নিজেও সমুদ্র দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, দূরের এক গাছ তুলে দেখিয় বলতেন, “এই ধর, এখান থেকে ঐ গাছ পর্যন্ত হবে!”

“এত বড়?” চোখ গোলগোল করে জিজ্ঞাসা করতো বালক। দাদু আবার মাথা নাড়তেন। “আচ্ছা দাদু, তুমি কখনো দেখেছ সমুদ্রদানোকে?”

“নারে! তাদের কেউ দেখতে পায় না।”

তাদের গল্পগুলো আরো হাজার লক্ষ গল্পকথার মতো গল্পই রয়ে যেত, যদি না কিছু প্রকৃতি সন্ধানী বিজ্ঞানীর হাতে একটি অদ্ভুত ফসিল আসতো।

মানুষ এবং মেগালোডনের তুলনা; ছবিসূত্র: phenomena.nationalgeographic.com

মেগালোডন: গল্প নয় বাস্তব

ড্যানিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী নিকোলাস স্টেনো এমন কিছু অদ্ভুত হাড়ের কথা শুনলেন যেগুলোকে লোকে বিভিন্ন পাথরগাত্র থেকে সংগ্রহ করেছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকগুলোর বিশ্বাস, এগুলো প্রাগৈতিহাসিক ড্রাগনের জিহ্বা। নিকোলাস স্টেনো সেগুলো দেখে বুঝতে পারলেন, এক মহামূল্যবান আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না, এগুলো জিহ্বা নয়, বরং দাঁত, অতিকায় কোনো প্রাণীর বিধ্বংসী দাঁত।

তিনি বিস্তর গবেষণা করে ১৬৬৭ সালে একখানা বই লিখলেন, নামThe Head of a Shark Dissected’। সেখানে বিস্তারিত লিখলেন তার গবেষণার ফলাফল। এমনকি দাঁতের উপর ভিত্তি করে কেমন হতে পারে প্রাণীটির চোয়াল এর একটি চমৎকার ইলাস্ট্রেশন আঁকলেন। সুইস বিজ্ঞানী লুইস এগাসিজ প্রাণীটির নামকরণ করলেন মেগালোডোন। কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘মেগাস’ (বৃহদাকার) এবং ‘অগাস’ (দাঁত) থেকে, অর্থাৎ মেগালোডন শব্দের অর্থ দাঁড়ায় দৈত্যাকার দাঁতালো প্রাণী। যদিও কেউ কেউ একে ভালবেসে ‘দ্য জায়ান্ট হোয়াইট শার্ক’ কিংবা ‘মনস্টার শার্ক’ বলেও ডাকে।

একেবারেই যথার্থ নামকরণ। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে ভয়ংকর দাঁত খুব কম প্রাণীরই আছে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রমাণ সাইজের হাতের সমান একেকটি দাঁত। সবচেয়ে বড় যেটি পাওয়া গেছে সেটি সাত ইঞ্চি লম্বা আর মানানসই সাইজের চওড়া।

বাচ্চা এবং পূর্ণবয়স্ক মেগালোডনের দাঁত; ছবিসূত্র: megalodonswag.com

বর্তমান পৃথিবীর ভয়ানক হোয়াইট শার্কের দাঁত তিন ইঞ্চি হয় কদাচিৎ। ত্রিকোণাকৃতির দাঁতগুলো ক্রমশ সরু হয়ে সুঁচালো আকার ধারণ করেছে। শুধু দাঁতই নয়, এদের আকারও ছিল দশাসই।

দাঁত এবং কশেরুকা ছাড়া মেগালোডনের আর কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। তাই এদের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন। তারপরও নিকটতম আত্মীয় হোয়াইট শার্কের সাথে তুলনা করে এবং ফসিল পুনঃবিন্যাস করে বিজ্ঞানীরা এদের ব্যাপারে আমাদের মোটামুটি একটি ধারণা দিয়েছেন।

একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মেগালোডন লম্বায় গড়ে দশ মিটার থেকে শুরু হয়ে আঠার মিটারের কাছাকাছি। অন্য একটি হিসাব থেকে জানা যায়, মেগালোডন লম্বায় পঁচিশ মিটারের কাছাকাছি। আর ওজন দশ টন থেকে শুরু হয়ে পঁয়ষট্টি মেট্রিক টন পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। এমন লম্বা রেঞ্জের বৈচিত্র্যতার পেছনে একটি কারণ আছে, তা হলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়া এবং খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য। সাধারণত পৃথিবীর উত্তরাঞ্চল থেকে পাওয়া ফসিলগুলো থেকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ফসিলগুলো বৃহদাকার।

তবে আকার-আয়তনে ভিন্নতা থাকলেও এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, মেগালোডন ছিল এক অব্যর্থ জীবন্ত মারণাস্ত্র। আসলেই তাই। তার ভয় উদ্রেককারী আকার আর দাঁত দিয়ে সাগরে একচ্ছত্র রাজত্ব করে গেছে। সমুদ্রের আলফা লেভেলের শিকারী ছিলো এরা। মানে এরা ছিলো শিকারীদের মধ্যে সবার উপরে। ছোট মাছ থেকে শুরু করে সীল, সামুদ্রিক কচ্ছপ দিয়ে হরহামেশাই উদরপূর্তি করতো। বাদ যেত না ডলফিন বা স্বগোত্রীয় অন্য ছোট হাঙ্গরেরা। এমনকি সমুদ্রতলে পাওয়া তিমির কশেরুকায় গভীর ক্ষত এবং তার পাশে পড়ে থাকা মেগালোডনের দাঁত থেকে বোঝা যায় হতভাগ্য বো-হেড তিমিগুলো তাদের প্রকাণ্ড শরীর নিয়েও মাফ পায়নি।

মেগালোডনের চোয়াল; ছবিসূত্র: gastondesign.com

মেগালোডনরা সমস্ত পৃথিবীতে রাজত্ব করে বেড়িয়েছে। তাদের ফসিল আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উপকূল থেকে গভীর সমুদ্র- সব জায়গাতেই মানিয়ে নিয়েছিলো তারা নিজেদের। যদিও শিশু মেগালোডনরা মূলত উপকূলবর্তী এলাকায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ থেকে তাদের দেহাংশ উদ্ধার হয়েছে। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশও মেগালোডনের খপ্পর থেকে বঞ্চিত হয়নি ।

বিলুপ্তি

মেগালোডনরা ছিল উষ্ণ রক্তের প্রাণী। এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাদের জন্য। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ ঠান্ডা হওয়া শুরু করে। ফলে তারা যে খাদ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল তারাও খাদ্যের অভাবের কমে যেতে থাকে এবং বরফ যুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে অনেক প্রাণী মেরু অঞ্চলে চলে যায়। মেগালোডনের পক্ষে তাদের পিছু নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাদের শরীরকে উষ্ণ রাখার জন্য তারা উষ্ণ জলের উপর নির্ভরশীল ছিল।

তাছাড়া বরফ যুগের আগমনের সাথে সাথে সমুদ্রতলের উচ্চতা কমে যায়। ফলে তাদের চারণক্ষেত্র কমে যেতে থাকে। এ সময় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেয় খুনে তিমি সহ আরো কিছু শিকারী প্রাণী।

এভাবে আস্তে আস্তে মেগালোডন হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। মেগালোডনের বিলুপ্তি জীবজগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে বালিন তিমিরা নিজেদের আকার বাড়িয়ে নিয়েছিল খুব দ্রুত।

শিল্প-সাহিত্য-চলচিত্রে মেগালোডন 

মেগালোডন আমাদের মাঝে গল্প উপন্যাস এবং মুভিতে মাঝেমাঝেই ফিরে এসেছে। ২০০৩ সালে বিবিসির সি মনস্টার সিরিজ নির্মিত হয় তিনটি মেগালোডনের গল্পকে কেন্দ্র করে। হিস্ট্রি চ্যানেলের জুরাসিক ফাইট ক্লাবেও মেগালোডন তার মুখ দেখিয়েছে। তাছাড়া মেগা শার্ক সিরিজের কয়েকটি ছবিতে মেগালোডনকে দেখা গেছে। বলতে গেলে ফ্যান্টাসি-এডভেঞ্চার ঘরানার জনপ্রিয় চরিত্র বহু আগে হারিয়ে যাওয়া এই মেগালোডন। কয়েকটি গল্প উপন্যাসেও মেগালোডনকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেগালোডন: এ নভেল অব ডিপ সি টেরোর, দ্য ট্রেঞ্চ প্রভৃতি।

কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের গল্প

স্বাভাবিকভাবেই  ধরে নেওয়া হয়েছে, মেগালোডনেরা হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী থেকে। কিন্তু এ নিয়েও বিস্তর জল ঘোলা হয়েছে। সত্যিই কি তারা হারিয়ে গিয়েছে? মেগালোডনদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ইউটিউবে সার্চ দিলে শতশত ভিডিও আসতে শুরু করে।

কনস্পিরেসি থিওরিস্টদের মতে, মেগালোডনেরা এখনও বেঁচে আছে সমুদ্রের গহীনে; ছবিসূত্র: Youtube

আমরা বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ঘুরে আসি। নাৎসি বাহিনী তখন সবকিছু তছনছ করে প্রবল বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সের কয়েকটি নৌ বন্দর জার্মানীর হাতে চলে গেলো। এ সময়কার একটি গোপন নথি পরে উন্মুক্ত হয়, যেখানে দেখা যায় হাঙ্গর সদৃশ অতিকায় প্রাণী।

২০১৩ সালে কয়েক বন্ধু মিলে গিয়েছিলো মাছ ধরতে। জায়গাটি আফ্রিকার কেপ টাউনের উপকূলে। ইউটিউবের যুগে ভিডিও করার প্রবণতা সবার মধ্যে বেড়ে গেছে। তারাও এর বাইরে ছিল না। সমস্ত অভিযান ক্যামেরাবন্দী করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেই তারা গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু সেটা ছিল তাদের শেষ যাওয়া। কেননা তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি কখনো। পরে সমুদ্রের তল থেকে তাদের ভাঙ্গা বোটের অংশ বিশেষ আর ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়। সেখানে দেখা যায় অজ্ঞাত এক প্রাণী তাদের বোটটাকে আক্রমণ করেছে। বোটের ভাঙ্গা অংশের গায়ে পাওয়া যায় বিশালাকার কামড়ের চিহ্ন, যার সাথে মিলে যায় আজকের হোয়াইট শার্কের দাঁতের কামড়ের। কিন্তু হোয়াইট শার্কের কামড়ের চেয়ে অনেক বেশি বড় ছিল সেগুলো।

বিশেষজ্ঞদের কাছে অবশ্য কোনোটিই ধোপে টেকেনি। তারা মেগালোডনের টিকে থাকার সম্ভাবনা একেবারেই বাতিল করে দিয়েছেন। অধিকাংশই ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। তবে কল্পনাপ্রিয় মানুষেরা মেগালোডনের টিকে থাকার গল্পকেই সত্য বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, অন্তত কিছু উত্তেজনা বাড়ে তাতে। আর কন্সপিরেসি থিওরিস্ট? তারা বিশ্বাস করে, সমুদ্রের তলে আজও হয়তো টিকে আছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে খুনে প্রাণীদের কয়েকটি। আমাদের অগোচরে, আমাদের অলক্ষ্যে!

ফিচার ইমেজ- thesun.co.uk

Related Articles