হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিমায় একজন মানুষ ক্যামেরার সামনে ছবি তুলছেন। তার গায়ে আমেরিকান হেভি মেটাল ব্যান্ড ‘ল্যাম্ব অফ গড’ এর একটি টি শার্ট আর লাল জ্যাকেট। পেছনে উচ্ছসিত জনতার কোলাহল। তার পরিচয়- তিনি ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ‘জোকো উইদোদো’। যারা এই ভদ্রলোক সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন না, তাদের জানিয়ে রাখি- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই আলোচনায় আসেন জনসংখ্যায় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক জোকো উইদোদো। কারণটা জানতে পারলে বেশ চমকে যাবেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন উইদোদো হেভি মেটাল সঙ্গীতের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। সভা সমাবেশ বা টিভি অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই তিনি উপস্থিত হন প্রিয় ব্যান্ডের টি শার্ট পরে। তার প্রিয় ব্যান্ডের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ‘মেটালিকা’। এছাড়াও ‘লেড জ্যাপেলিন’, ‘ল্যাম্ব অফ গড’ বা ‘মেগাডেথ’ সহ অনেক ব্যান্ডই থাকে এই মেটালহেড প্রেসিডেন্টের প্লে লিস্ট জুড়ে!
ইন্দোনেশিয়াতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের কারণে পশ্চিমা সংস্কৃতির চর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। উপরন্তু হেভি মেটাল সঙ্গীত সে দেশে একদমই সমাদৃত নয়। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু স্থানীয় মেটাল ব্যান্ডের বদৌলতে ভিন্নধারার এই গান নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় একটা নীরব বিপ্লব ঘটে চলেছে।
২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাবোয়া সুবিয়ান্তোকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন জোকো উইদোদো। ৫৩.১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে উইদোদো বিজয়ী হন। ফলাফল ঘোষণার অব্যবহিত পরেই উইদোদোকে ভোট জালিয়াতির ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করেন প্রতিদ্বন্দ্বী সুবিয়ান্তো, যদিও পুনরায় ভোট গণনার মাধ্যমে জালিয়াতির অভিযোগ নস্যাৎ হয়ে যায়।
জনগণের বন্ধু হিসেবে জোকো উইদোদোর সুখ্যাতি রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক কল্যাণকর পরিকল্পনা প্রণয়নে উইদোদো বদ্ধপরিকর। ইন্দোনেশিয়ার তরুণদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। নির্ভেজাল রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন ৫৬ বছর বয়সী এই রাষ্ট্রপ্রধান। বড় বড় কনসার্টে প্রিয় ব্যান্ডের গান শোনার জন্য নিয়মিত হাজির হন প্রেসিডেন্ট উইদোদো। ইন্দোনেশিয়ার মেটাল সঙ্গীত বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘মেটাল রেবেল’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উইদোদো বলেন,
“জুনিয়র হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি হেভি মেটাল গান ভালোবাসি, তখন আমার বয়স ছিল বড়জোর ১৪ বছর।”
জনতার বন্ধু উইদোদো
জোকো উইদোদোর মেটালপ্রেমের কারণেই বোধকরি ইন্দোনেশিয়ার জনগণের কাছে তিনি ভিন্ন মাত্রার জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। উইদাদো শুধু নিরাপত্তা বহর নিয়ে চলাফেরা করা কোনো গুরুগম্ভীর নেতা নন, কনসার্টের ভীড়ভাট্টার মাঝে জনগণের কাঁধে কাধ মিলিয়ে গানের তালে হেড ব্যাং করতে পারেন তিনি অনায়াসে। তার এই সঙ্গীতপ্রেম আর অকপট আচরণই যেন ইন্দোনেশিয়ানদের মনে জানান দিয়ে যায়, “আমি তোমাদেরই একজন”। নির্বাচনের সময় উইদোদোকে যারা ভোট দিয়েছিলেন, তাদের একাংশ যে মেটাল সঙ্গীতপ্রেমী তরুণ সমাজ, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
দ্বীপ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার সপ্তম প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো এর আগে রাজধানী জাকার্তার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পরিবারে কোনো প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বা সামরিক কর্মকর্তা নেই। খুবই সাদাসিধে পরিবারের ছেলে উইদোদো। তার বাবা ছিলেন দরিদ্র কাঠমিস্ত্রী, আসবাবপত্র বিক্রির ব্যবসা করতেন তিনি। সংগ্রামী জীবন পার করে নিজ শহর সুবাকর্ততে মেয়র নির্বাচিত হন উইদোদো। অসম্ভব জনপ্রিয় এই মেয়র একদিন ঠিকই তার দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।
রকস্টারদের শুভেচ্ছা বার্তা
জোকো উইদোদো যেসব ব্যান্ডের ভক্ত, তার মধ্যে অন্যতম ‘ল্যাম্ব অফ গড’। ২০১৪ সালে উইদোদোর বিজয়ের খবর প্রকাশিত হবার পর ল্যাম্ব অফ গড এর গায়ক র্যান্ডি ব্লাইথ উইদোদোকে উদ্দেশ্য করে এক অভিনন্দন বার্তা লেখেন ইনস্টাগ্রামে। অনূদিত বার্তাটি তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
“অসাধারণ!
লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান, ইন্দোনেশিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট একজন মেটালহেড এবং ল্যাম্ব অফ গড এর ভক্তও বটে। না, মোটেও রসিকতা করছি না। ছবিগুলো সত্যিকারের। উইদোদো আমাদের মতোই মেটালিকা, মেগাডেথ আর লেড জ্যাপেলিন ভালোবাসেন। বাহ! তিনি তাহলে পৃথিবীর প্রথম হেভি মেটাল প্রেসিডেন্ট। সাবেক গভর্নর, আসবাবপত্র ব্যবসায়ী, যিনি দারিদ্র্যের কাছে হেরে যাননি, সেই জোকো উইদোদো নির্বাচনে জিতে গেছেন! সত্যি বলতে কী, আমি ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না। সুতরাং সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি মন্তব্য করবো না। কেউ কী কখনো ভেবেছিল একজন মেটালহেড কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন? উইদোদো হচ্ছেন পৃথিবীর একমাত্র প্রেসিডেন্ট যার সাথে আপনি স্লেয়ার ব্যান্ডের কোন অ্যালবামটি সেরা- এই ব্যাপারে তর্ক করতে পারবেন।
আশা করি প্রেসিডেন্ট একদিন আমাকে কূটনৈতিক সম্মানের সাথে বালি ভ্রমণে নিয়ে যাবেন!”
অন্যরকম উপহার
গত নভেম্বরে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী লারস লোক্কে রাসমুসেন রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন ইন্দোনেশিয়ায়। ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী যে জোকো উইদোদোর মেটাল সঙ্গীত প্রেম সম্পর্কে জানতেন, সে ব্যাপারেই বলছি আপনাদের। মেটালিকা ব্যান্ডের ড্রামার লারস উলরিক জন্মসূত্রে ডেনমার্কের নাগরিক। আবার মেটালিকার কালজয়ী অ্যালবাম ‘মাস্টার অফ পাপেটস’ রেকর্ড করা হয়েছিল ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। উইদোদো মেটালিকার ভক্ত, সুতরাং রাসমুসেনের দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে অসুবিধা হয়নি। ‘মাস্টার অফ পাপেটস’ এর একটি স্পেশাল এডিশন বক্স সেট কিনে তাতে লারস উলরিক এর অটোগ্রাফ নিয়ে নিলেন রাসমুসেন। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতির বাসভবনে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের সময় এই অ্যালবাম উপহার দেওয়া হয় উইদোদোকে। প্রিয় শিল্পীর স্বাক্ষরিত অ্যালবাম পেয়ে উইদোদো তো যারপরনাই খুশী। ‘দ্য জাকার্তা পোস্ট’ পত্রিকাকে তার অনুভূতি জানান উইদোদো। চওড়া হাসি দিয়ে তিনি বলেন,
“প্রধানমন্ত্রী রাসমুসেন আমার কোন ধরনের গান পছন্দ, সে ব্যাপারে ভালোই জানেন দেখছি”।
লারস উলরিক এই উপহার প্রদানের ঘটনা সম্পর্কে টুইট করেন,
“ব্যাপারটি সত্যিই অসাধারণ! ডেনমার্কের প্রেসিডেন্টের জন্য মাস্টার অফ পাপেটস এর একটি বক্স সেট সই করে দিলাম। এটি ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইদোদোকে উপহার হিসেবে দেওয়া হবে। উইদোদো মেটাল সঙ্গীতের বিরাট ভক্ত এবং তিনি ২০১৩ সালে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত মেটালিকার কনসার্টে এসেছিলেন। গান সত্যিই মানুষকে এক করতে পারে।”
জোকো উইদোদো যেমন মেটালহেডদের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছেন, ক্ষেত্রবিশেষে তার বিপক্ষেও গেছে কেউ কেউ। একবার ইন্দোনেশিয়ায় দুই মাদক পাচারকারীকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ৯ কিলোগ্রাম হেরোইন পাচারের জন্য তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মৃত্যুদণ্ড। হঠাৎ জনপ্রিয় কয়েকজন রক তারকা এই শাস্তির রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রতিবাদ করে বসেন উইদোদোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ব্ল্যাক স্যাবাথ এর গিটারিস্ট টনি আইওমি, গানস এন্ড রোজেস এর গায়ক এক্সেল রোজ আর নাপাম ডেথ এর গায়ক বার্নি গ্রিনওয়ে উইদোদো বরাবর বার্তা পাঠান এই ফাঁসির রায় ঠেকানোর জন্য। এক্সেল রোজ লিখেছিলেন মস্ত বড় এক চিঠি, সেখানে তিনি বলেন, যারা মাদক চক্রের খুব নগণ্য অপরাধী, তাদের ফাঁসি দেওয়াটা লঘু পাপে গুরু দণ্ড বললে বেশি বলা হবে না। মূল গডফাদারদের বাদ দিয়ে পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির বিপক্ষে যান তিনি, উইদোদোকে অনুরোধ করেন অভিযুক্তদের মুক্তির জন্য। অবশ্য এসব অনুরোধ উইদোদোর মন গলাতে পারেনি। ফাঁসি হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত দুই হেরোইন পাচারকারীর। পরবর্তীতে এক্সেল রোজ উইদোদোকে কাপুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মেটালহেড পরিচয়ের বাইরে বিশ্ব রাজনীতিতে কী অবদান রাখতে পারবেন জোকো উইদোদো, সেটা নাহয় সময়ই বলে দেবে।
ফিচার ইমেজ: Huffington Post