গর্ভাবস্থা একজন নারীর জন্য সবচেয়ে সুন্দর সময়। বিশেষ করে যারা নতুন মা হচ্ছেন তাদের জন্য গর্ভকালীন সময়টা আনন্দ, ভয় ও উত্তেজনা সব মিলিয়ে যেন সম্পূর্ণ নতুন এক জগৎ। কী করতে হবে আর কী করা যাবে না, গর্ভাবস্থায় এসব চিন্তা-ভাবনা নিয়ে হবু মায়েরা এমনিতেই বেশ এলোমেলো অবস্থায় থাকেন।
আপনি মা হচ্ছেন? ব্যস, এই অসাধারণ খবরটি পাওয়ার সাথে সাথে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতরা আপনার গর্ভধারণের সময়টি কীভাবে অতিবাহিত করবেন, সেসব সম্পর্কিত পরামর্শের ঝুড়ি খুলে নিয়ে বসবেন। সবাই আপনার ও আপনার অনাগত সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করতে একটু বেশি সচেতন হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সময়টায় আপনি এমন কিছু পরামর্শ ও ঘটনার সম্মুখীন হতে পারেন, যা আসলে কুসংস্কার বা কাল্পনিক কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আর তাই, আমাদের আজকের প্রবন্ধ সেইসব হবু মায়েদের জন্য, যারা গর্ভকালীন অবস্থায় নানা ধরনের পরামর্শ ও বাধা নিষেধের মধ্যে পড়ে বুঝতে পারছেন না, কোনটি সত্যিকারের কার্যকরী পরামর্শ আর কোনটি নেহায়েত ভ্রান্ত ধারণা।
আপনাকে দুজনের জন্য খেতে হবে
গর্ভবতী মায়েদের গর্ভধারণের শুরু থেকে বেশি বেশি খেতে বলা হয়। কারণ, এখন আপনাকে যে দুজনের জন্য খেতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি আদৌ সত্যি, নাকি কোনো উপকথা?
আপনি গর্ভের বাচ্চা ও নিজের জন্য দ্বিগুণ খাওয়া শুরু করার আগে জেনে নেওয়া দরকার, প্রতিদিন গর্ভবতী মায়েদের কতটুকু খাবার গ্রহণ করা জরুরি। American Congress of Obstetricians and Gynecologists (ACOG) এর মতে, একজন স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী নারীর গর্ভকালীন অবস্থায় বাচ্চা ও তার নিজের জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালোরির প্রয়োজন হয়। গর্ভাবস্থায় হবু মায়েদের নজর রাখতে হয়, যাতে তারা এই সময়টায় সুস্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। এই অবস্থায় যদি আপনি দুজনের জন্য খেতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত খাবার খেতে শুরু করেন, তাহলে গর্ভাবস্থায় আপনার ওজন অতিরিক্তভাবে বেড়ে যাবে। যার ফলাফল হিসেবে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, পিঠে ব্যথা হতে পারে এবং নর্মাল ডেলিভারির বদলে আপনাকে সি সেকশন (Cesarean Section) এ যেতে হতে পারে। কারণ, আপনার বাচ্চা আকারে বড়। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির কারণে আপনার অনাগত সন্তান বুদ্ধিস্বল্পতা, খাদ্যগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সমস্যা, এমনকি মানসিক সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে!
তাই গর্ভাবস্থায় দুজনের জন্য খেতেই হবে, এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা বানিয়ে নিন।
ব্যায়াম থেকে বিরত থাকুন
আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, গর্ভবতী নারীদের ব্যায়াম করা উচিৎ নয়, বরং নয় মাস পর্যন্ত একটানা বিশ্রাম করতে হবে। কথাটি মোটেও সত্যি নয়, বরং ডাক্তাররা বলেন, হবু মায়েদের ছোটখাট ব্যায়াম করা জরুরি। একটু হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি ঘরের হালকা কাজকর্ম করায় কোনো ক্ষতি নেই। তবে হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে গর্ভবতী মায়েদের জন্য অতিরিক্ত ব্যায়াম ও ঘরের ভারী কাজ করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
প্রকৃতপক্ষে, হবু মায়েরা যদি হালকা শরীরচর্চা করেন, তবে সেটা গর্ভের ভ্রুণের জন্যও যথেষ্ট উপকারী। গর্ভাবস্থায় হালকা ব্যায়াম করার ফলে হবু মায়ের শরীর চনমনে থাকে, রাতে ভালো ঘুম হয় এবং তিনি কম বিষণ্নতায় ভোগেন। ২০১৭ সালে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানানো হয়, গর্ভাবস্থায় শারীরিক ব্যায়াম মা এবং শিশু উভয় জন্য প্রধান শারীরবৃত্তীয় কাজ।
হাঁটাহাঁটি, সাঁতার, সাইক্লিং ও হালকা ধরনের ব্যায়াম হবু মায়েদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ওয়ার্ক-আউট। অবশ্যই কঠিন ও তীব্র ধরনের ব্যায়ামগুলো এড়িয়ে চলুন এই অবস্থায়। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে অ্যাজমা, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের ব্যায়াম করার ক্ষেত্রে কিছু বাঁধা নিষেধ থাকতে পারে, আর তাই এক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
বাসায় বিড়াল রাখা সম্পূর্ণ নিষেধ
গর্ভাবস্থায় আপনি সবচেয়ে বড় যে পরামর্শ বা নিষেধের সম্মুখীন হতে পারেন, সেটি হচ্ছে আপনার আদরের বিড়ালকে এই সময়ে বাসায় রাখতে পারবেন না। কারণ, এতে আপনার গর্ভপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আতঙ্কিত হবেন না, উপরের পরামর্শগুলোর মতোই এটিও খানিকটা অতি কল্পনার ফসল। গর্ভাবস্থায় বিড়াল রাখা বিপজ্জনক, কথাটি সম্পূর্ণ সত্যি নয়, বরং আপনার প্রিয় বিড়ালটিই আপনাকে গর্ভকালীন অবস্থায় বিষণ্নতা ও হতাশা থেকে দূরে রাখবে এবং আপনার মুখে হাসি ফোটাবে।
যদি বাড়িতে বিড়াল থাকে, তাহলে গর্ভকালীন অবস্থায় কোনোভাবেই আপনি নিজে বিড়ালের লিটার বক্স পরিস্কার করতে যাবেন না। কারণ, ডোক্সিস থেকে টক্সোপ্লাজমোসিসের ঝুঁকি থাকে, আর টক্সোপ্লাজমোসিস গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণায় আবার বলা হয়েছে বিড়াল থেকে টক্সোপ্লাজমোসিসের কোনো ঝুঁকি নেই। তবুও আপনার গর্ভকালীন অবস্থায় নিজে লিটার না বদলিয়ে অন্য কারও সাহায্য নিন এবং বিড়াল ধরার পর চেষ্টা করুন হাত ধুয়ে পরিস্কার রাখতে।
গরম পানিতে গোসল করা যাবে না
অনেকে বলেন, গর্ভাবস্থায় হট শাওয়ার বা গরম পানিতে গোসল করা একদম ঠিক নয়। আসলে কথাটি কতটুকু সত্যি এবং যুক্তিসঙ্গত?
এটি সত্যি যে, গর্ভাবস্থায় গরম পানি দিয়ে গোসল না করাই উত্তম। তবে কুসুম গরম পানিতে আপনি পাঁচ থেকে ছয় মিনিট সময় নিয়ে গোসল করতেই পারেন। তবে গর্ভাবস্থায় গরম পানির মধ্যে কোনো অবস্থাতেই বসে থাকা বা দীর্ঘ সময় ধরে গরম পানি শরীরে ঢালা ঠিক নয়। খেয়াল রাখতে হবে যাতে করে আপনার শরীরের তাপমাত্রা কোনোভাবেই ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে না যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে গরম পানিতে গোসল করলে ও বাথ ট্যাবে বসে থাকলে আপনার শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা নিউরাল ডিসঅর্ডারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই হবু মায়েদের উচিৎ অতিরিক্ত গরম পানি এবং অনেক সময় ধরে গরম পানিতে গোসল না করা, তবে কুসুম গরম পানিতে অল্প সময়ের জন্য গোসল করায় কোনো বাধা নেই।
গর্ভাবস্থায় সি-ফুড থেকে দূরে থাকতে হবে
বেশিরভাগ হবু মায়েদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে, গর্ভাবস্থায় কোনোভাবেই সি-ফুড খাওয়া যাবে না। এটি একদম ভ্রান্ত ধারণা, বরং উচ্চ মাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ গর্ভবতী মা ও তার অনাগত সন্তানের জন্য বেশ উপকারি।
যে মায়েরা গর্ভকালীন অবস্থায় কমপক্ষে বারো আউন্স সি-ফুড গ্রহণ করে থাকেন, তাদের শিশুরা উচ্চতর মৌখিক বুদ্ধিবৃত্তি, উন্নত সামাজিক ও যোগাযোগ দক্ষতা সম্পন্ন হয়।
গর্ভাবস্থায় কফি পান করা যাবে না
সকাল বেলায় এক কাপ কফি কি আপনার খুব প্রিয়? কিন্তু আপনি মা হবেন, এটি জানার সঙ্গে সঙ্গে আপনার জন্য কফি সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে! কারণ, কফি থেকে গর্ভপাত, নির্ধারিত সময়ের পূর্বে জন্মদান এবং কম ওজন সম্পন্ন বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি আপনার সকালের খুব পছন্দের এক কাপ কফি খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার আগে একবার নিশ্চিত হয়ে নিন, কফি কি সত্যিই এতটা বিপজ্জনক?
আপনাকে সম্পূর্ণরূপে কফি বাদ দেওয়ার দরকার নেই। তবে এনএইচএস (National Health Service) থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, দিনে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি কফি পান করা যাবে না। অর্থাৎ, আপনি দিনে এক কাপ কফি নিশ্চিন্তে পান করতে পারেন এবং এতে করে আপনার গর্ভের সন্তানের কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
হবু মায়েদের গর্ভধারণের সময়টি আরও একটু সুন্দর ও ভাবনাহীন করতে গর্ভাবস্থায় কী কী করবেন না, সে সম্পর্কে কিছু পরামর্শ:
- কাঁচা বা আধা কাঁচা মাছ, মাংস ও ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- ধূমপান করবেন না এবং ধূমপানরত কারও পাশে থাকবেন না।
- গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল একদম নয়।
- দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকবেন না, আবার দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়েও থাকবেন না।
- গর্ভাবস্থায় নিজের ও গর্ভের বাচ্চার প্রতি মনোযোগী হন। সকল প্রকার নেতিবাচক চিন্তা ও কাজ থেকে দূরে থাকুন।
- দীর্ঘ সময় গরম পানি দিয়ে গোসল করা যেমন মানা, ঠিক তেমনি দীর্ঘক্ষণ ধরে রোদেও থাকবেন না। এতে করেও আপনার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
- গর্ভকালীন অবস্থায় ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট নেওয়া উচিৎ নয়। আর নিতে হলে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিন।
- যদি আপনার কোনো বিষয় নিয়ে মনে শঙ্কা থাকে, তাহলে কারো কথায় হুজুগে গা না ভাসিয়ে নিজেই বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন। আজকাল তথ্য প্রযুক্তি এতটাই হাতের নাগালে রয়েছে যে, আপনার যেকোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আপনি নিজেই মিটিয়ে ফেলতে পারেন।
ফিচার ইমেজ: huffpost.com