বাংলাদেশে পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতি বছর ঘটে যাওয়া এই দুর্যোগ নিয়ে যায় কত না প্রাণ! কখনও বেশি, কখনও কম। বাদ যায়নি এই বছরও। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪০ জনে। শুধুমাত্র রাঙামাটিতেই মারা গেছেন প্রায় ৯৮ জন। সেনাবাহিনীর দুজন কর্মকর্তা ও দুই সৈনিকও প্রাণ হারিয়েছেন। পাহাড়ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক চালু করতে গিয়ে বড় পাথরখন্ড তাদের উপর আছড়ে পড়ে।
মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা থেকে রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধস শুরু হয়। বেলা ১১টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় শহরের ভেদাভেদ, রাঙ্গাপানি, যুব উন্নয়ন, টিভি স্টেশন, রেডিও স্টেশন, রিজার্ভ বাজার, মোনঘর, শিমুলতলি ও তবলছড়ি এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। সেখানে এখনও অনেক লোক মাটিচাপা পড়ে আছে। মৃত্যুর এই মিছিল যেন সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে। হয়ত এই লেখা শেষ করতে করতে মৃতের সংখ্যার আরও পরিবর্তন হবে। ক্রমশ বড় হতে থাকবে এই লাশের মিছিল। আর প্রিয়জন হারানো স্বজনদের বুকে জমবে চাপা দীর্ঘশ্বাস!
প্রতি বছর বান্দরবন যাওয়ার প্রধান রাস্তা পাহাড়ধসের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। পাহাড়ধসের সাথে ভেঙে পড়ে অনেক ঘরবাড়ি এবং সাথে নিয়ে যায় অনেক প্রাণ। আমাদের দেশের এই পার্বত্য এলাকাগুলো সম্পূর্ণ দেশের প্রায় ১৮ শতাংশ এবং তার সাথে সাথে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এসব পার্বত্য এলাকার রাস্তা তৈরি করার সময় ভূমিধ্বসের ব্যাপারটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি। যার ফলে অতি অল্প বৃষ্টিতেও পাহাড় ধসের ফলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
পাহাড়ধসের ফলে প্রতি বছর ঝরে যায় অনেক প্রাণ। কিন্তু কেনই বা এই ঝুঁকির মধ্যে মানুষ জীবনযাপন করে? একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির পরও মানুষ কি পাহাড়কে নিরাপদ মনে করছে?
পাহাড়ে বসতি গড়ে কারা এবং কেন?
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণত রাখাইন উপজাতির লোকেরা পাহাড়ে বসবাস করে। এদের জীবন পাহাড়কেন্দ্রিক বলে এরা বংশ পরম্পরায় পাহাড়ের জীবনযাপনই বেশি পছন্দ করে। আমাদের দেশের চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের অনেক অধিবাসীও পাহাড়ে বসবাস করে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য ছাড়া যারা বসবাস করে, তারা হলো আমাদের দেশের বাস্তুহারা মানুষ। বিভিন্ন অঞ্চলের বাস্তুহারা মানুষ বাসস্থান হিসাবে পাহাড়ি অঞ্চলকে আশ্রয়ের অন্যতম স্থান হিসাবে দেখে। এসব বসতির সিংহভাগই অবৈধ। পাহাড় কেটে নিয়মনীতি না মেনেই এসব ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়।
পাহাড় কেন ধসে?
পাহাড়ধসের কারণকে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট- এই দু’ভাগে ভাগ করা যায়। জিও সায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় বলা হয়, পাহাড়ধসের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
পাহাড়ের ঢালের কোনো অংশে যদি বড় গর্ত থাকে তখন অতিবৃষ্টিতে ভূমিধ্বস হতে পারে। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকেও পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হিসাবে বলা যায়। এছাড়াও পাহাড়ের পাদদেশের নদী ও সাগরের ঢেউ থেকেও পাহাড় ধসের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
আর মানব সৃষ্ট কারণ হিসেবে গবেষণায় পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলা, মাটি কাটা, পাহাড়ে প্রাকৃতিক খাল বা ঝর্ণার গতি পরিবর্তন, পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভার দেওয়া- এসবকে দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ে খনি খনন ও পাহাড়ের পাশ দিয়ে ভারি যানবাহন চলাচলের কারণেও পাহাড়ধস ঘটতে পারে বলে উক্ত গবেষণা থেকে জানা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানবসৃষ্ট এসব কারণ ছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো জুমচাষ। জুমচাষের ফলে পাহাড় প্রতিনিয়ত তার শক্তি হারাচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে জুম ও অন্যান্য ফসল চাষ গত কয়েক বছরের পাহাড়ধসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া আমাদের দেশের পাহাড়ে কোনো কঠিন শিলা নেই। তাই অতিবৃষ্টি হলেই পাহাড়ধস নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা। জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “অতীতে পাহাড় ধ্বংস করা হয়েছে। এখনও পাহাড় কাটা হচ্ছে। দখল চলছে। পাহাড়ে বসতি ব্যবস্থাপনায় নিয়ম-শৃঙ্খলা আনা না গেলে ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যা দেখা দেবে।” পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে আগেই প্রস্তুতি নেওয়া যেত বলে মনে করেন তিনি। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই অধ্যাপক বলেন, এবার যে আগাম বর্ষা হবে, তা ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ যাওয়ার সময়ই বলে গিয়েছিল। কিন্তু তা কেউ কানে তোলেনি। পাহাড়খাদক দখলদারেরা বাঁচার আশা নিয়ে আসা মানুষদের পাহাড়ে বসিয়ে দেয়। উদ্বাস্তুর আশা মাথা গোঁজার ঠাঁই, আর দখলদারদের আশা জমি-মাটি-টাকা। সমতলের বাঙালিরা পাহাড়ে বসতি গড়ার কায়দা-কানুন জানে না। তারা মাটি আর পাহাড়ের তফাত বুঝতে পারে না। পাহাড়ে বসবাসের তরিকা রপ্ত করার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য পাহাড়ধস
১৯৬৮ সালে কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনা রাস্তায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বড় পাহাড়ধস ঘটে। মাটি ঢাল বেয়ে নদীতে প্রবাহের সাথে মিশে কাপ্তাই হ্রদে গিয়ে পড়ে। এর ফলে হ্রদের একটি বড় অংশ পলি মাটি দ্বারা ভরাট হয়ে যায়। ১৯৭০ সালে ঘাগড়া-রাঙামাটি রাস্তায় একইভাবে পাহাড়ধস ঘটে।
১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে বান্দরবনের চড়াইপাড়াতে বিশাল পাহাড়ধস ঘটে। প্রায় ৯০,০০০ বর্গমি. জায়গা এই পাহাড়ধসে আক্রান্ত হয়। এই পাহাড় ধসযে এলাকায় ঘটে, সে এলাকায় জনবসতি ছিল নগণ্য। যদি বান্দরবান শহর এটি দ্বারা আক্রান্ত হত, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ হত অগণিত!
১৯৯৯ সালের ১১ ও ১৩ আগস্ট দুটি পাহাড়ধস ঘটে। একটি বান্দরবনে এবং অপরটি চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম জেলার ১০ জন ও বান্দরবন জেলার ৭ জন মারা যান।
২০০০ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের অন্যান্য জায়গার কমপক্ষে ১৩ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন ঐ বছরের পাহাড়ধসে। এর সাথে সাথে কয়েক লক্ষ টাকার ক্ষতি হয় আক্রান্ত এলাকাগুলোতে।
২০০৭ সালের জুন মাসে অতিরিক্ত মৌসুমি বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামে বেশ কিছু ভূমিধ্বস ঘটে। ৫৯ শিশুসহ প্রায় ১২৮ জন প্রাণ হারান এবং আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় অর্ধশতাধিকে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লেবু বাগান এলাকা থেকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮০০০ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়।
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় পাহাড়ধসে মৃত্যু হয় ১১ জনের।.
২০০৯ ও ২০১০ সালে মারা যান ছয়জন।
২০১১ সালে চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকায় একই পরিবারের পাঁচজন সহ ১৭ জন মারা যান মাটি চাপায়।
২০১২ সালের ১২ জুন চট্টগ্রাম নগরীর চার স্থানে পাহাড়ধসে ২৮ জনের প্রাণহানি ঘটে।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের ইস্পাহানী মোড় এলাকায় পাহাড় ধসে এক গৃহবধূ মারা যান। একই বছর ২৯ জুলাই এক মা-মেয়ের করুণ মৃত্যু হয় পাহাড় ধসে।
সর্বশেষ ২০১৫ সালে পাহাড়ধসে চট্টগ্রাম জেলায় মারা যান ছয়জন।
মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান দেখলে বেশ কিছু প্রশ্নই মনের ভেতরে উঁকি দেয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পরেও ২০১৭ সালে সালে মৃতের সংখ্যা শতাধিক হলো কিভাবে? সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে কি আমাদের দক্ষতা কমে যাচ্ছে? তাহলে কি কমে যাচ্ছে মানুষের সচেতনতা? নাকি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী? আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পাহাড়ধসের কারণ কি শুধুমাত্র অতিবৃষ্টি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল কেউই দেখতে চায় না আর!