Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেমন ছিল শেখ হাসিনার পৌনে ছয় বছরের দিল্লি জীবন?

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে দেশের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন তিনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করে।

তবে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে যান শেখ মুজিবের পরিবারের দুই সদস্য, তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বাংলাদেশের ইতিহাসের লাল অক্ষরে রচিত সেই দিনে শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে, রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসভবনে। সেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে আরো ছিলেন তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া এবং দুই শিশুসন্তান, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের খবরটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের কাছে আসে পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সানাউল হকের বাসায় ফোন দিয়ে জানান এই দুঃসহ সংবাদ। পরবর্তীতে ব্রাসেলস থেকে শেখ হাসিনারা চলে যান বনে রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর বাসভবনে। সেখান থেকেই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে তারা নিশ্চিন হন বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে।

পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেখ হাসিনা; Image Source: Bangladesh Awami League

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকেই রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী শুরু করেন গোপন তৎপরতা; বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত কন্যাকে কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিয়ে দেয়া যায় কি না। এ বিষয়টি দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, এবং দুদিন পরই তারা বলে, শিগগিরই যেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লিতে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়। ভারতীয় কর্মকর্তাদের তরফ থেকে আরো বলা হয়, গোটা বিষয়টি যেন খুব গোপনে ও দ্রুত সম্পন্ন করা হয়, এবং শেখ হাসিনাদের যেন এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে সরাসরি দিল্লিতে পাঠানো হয়।

এভাবেই শেখ হাসিনারা ২৪ আগস্ট বিকেলের দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন, এবং ২৫ আগস্ট খুব ভোরে তারা দিল্লিতে পৌঁছান। এর মাধ্যমে শুরু হয় শেখ হাসিনার পৌনে ছয় বছরের দিল্লি জীবন।

বাসস্থান

শেখ হাসিনাদের প্রথমে রাখা হয় ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউজ’-এ। পরে তাদেরকে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং তাদের প্রতি তিনটি পরামর্শ দেয়া হয়। প্রথমত, তারা যেন বাড়ির বাইরে না যান; দ্বিতীয়ত, তারা যেন সেখানে কারো কাছে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় না দেন; তৃতীয়, দিল্লিতে কারো সঙ্গে যেন যোগাযোগ না রাখেন।

দিন দশেক পরে, ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের একজন সরকারি কর্মকর্তা শেখ হাসিনাদের নিয়ে যান ইন্দিরা গান্ধীর সরকারি বাসভবন, ১ সফদরজং রোডের বাসায়। এরও আরো দশদিন পর তাদেরকে পান্ডারা পার্কের সি ব্লকের একটি ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। ওই ফ্ল্যাটে তিনটি শোবার ঘর আর কিছু আসবাব ছিল। খবর দেখার জন্য একটি সাদা–কালো টেলিভিশন সেটও দেওয়া হয়। তখন ভারতের টেলিভিশনে শুধু দুই ঘণ্টার জন্য দূরদর্শনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। তবে সেই সময় তাদের বাড়িতে কোনো টেলিফোন সংযোগ দেওয়া হয়নি।

কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে দিন কাটত তাদের। বাড়ির আশপাশে ছিল নিরাপত্তার কড়া বেষ্টনী। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তাদের ভয় ছিল শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে। তাই নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দাদের নজরও থাকত সেখানে।

লন্ডনে শেখ রেহানার বাড়ির সামনে শেখ হাসিনা (১৯৮০ সালে); Image Source: Prothom Alo 

ওয়াজেদ মিয়ার চাকরি

পশ্চিম জার্মানিতে শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া কর্মরত ছিলেন একজন পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে নির্বাসনকালেও তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। নয়া দিল্লির অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে চাকরি নেন তিনি এবং ১৯৮২ সাল অবধি সেখানেই কাজ অব্যাহত রাখেন।

সন্তানের পড়াশোনা

শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতেই কয়েকটি বোর্ডিং স্কুলে যান। এর মধ্যে ছিল তামিল নাড়ুর পালানি হিলসের কোদাইকানাল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং নৈনিতালের সেইন্ট জোসেফ’স কলেজ। তিনি ইউনিভার্সিটি অভ ব্যাঙ্গালোরে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন, এবং পরবর্তীতে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের আর্লিংটনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসে।

প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সম্পর্ক

শেখ হাসিনারা যখন প্রথম দিল্লিতে পৌঁছলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে বলেছিলেন, “আপনি এখন থেকে দিল্লিতে ওদের অভিভাবক।” বাস্তবিকই শেখ হাসিনাদের সত্যিকারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রণব মুখার্জি।

প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনাকে তার বড় মেয়ে বলে মনে করতেন। তার ছেলে অভিজিতের সঙ্গে হাসিনার ছেলে জয়ের এবং শেখ রেহানার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির মেয়ে শর্মিষ্ঠার ভাল সম্পর্ক ছিল।

প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনাকে তার বড় মেয়ে মনে করতেন; Image Source: Focus Bangla

এদিকে শেখ হাসিনার সঙ্গেও দারুণ ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির। তাকে ‘বউদি’ বলে ডাকতেন শেখ হাসিনা। এতটাই হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল সেই সম্পর্ক যে, ২০১৫ সালে শুভ্রা মুখার্জি যখন মারা যান, তখন শেখ হাসিনা প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন।

আর ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। শেখ হাসিনা তাকে এতটাই শ্রদ্ধা করতেন যে, নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে চাইতেন। 

সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ

দিল্লি বাসের পৌনে ছয় বছরে খুব বেশি সাধারণ মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পারেননি শেখ হাসিনা। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল তার নিরাপত্তা। তাই হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও আমলা ছাড়া খুব বেশি লোকের সঙ্গে তার পক্ষে দেখা করা সম্ভব ছিল না।

ওই সময় তার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন, এমন একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হলেন দিল্লি ফুটবল সার্কেলের পরিচিত মুখ ও হিন্দুস্তান ফুটবল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ডি কে বসু। তিনি একাধিকবার গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার পান্ডারা পার্কের বাড়িতে।

বসুর ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথমবার তার শেখ হাসিনার বাড়ি গমনের পেছনে অবদান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষাবিদের। সেদিন তৎকালীন বাংলাদেশের অবস্থা এবং বাংলা সাহিত্য নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। শেখ হাসিনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার অনেক বড় ভক্ত। তাই তিনি শেখ হাসিনাকে উপহার দিয়েছিলেন বাঙালি সাহিত্যিকদের রচিত অসংখ্য বই। শেখ হাসিনার আন্তরিক, নম্র-ভদ্র ব্যবহারে মুগ্ধ হন বসু। 

দিল্লির পার্ক স্ট্রিট রোড এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রোড; Image Source: DW/Rajib Chakraborty

রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা

বিস্ময়কর হলেও সত্য, দিল্লি বাসের সিংহভাগ সময়ই রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন শেখ হাসিনা। এর কারণ সম্ভবত এই যে, তখন ভারতেও চলছিল জরুরি অবস্থা। তাই নিজ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যতই শোচনীয় হোক না কেন, ভারত সরকারের নির্দেশে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নিতে পারেননি।

তবে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা নিয়মিতই শেখ হাসিনার বাড়িতে যেতেন এবং চেষ্টা করতেন তাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য রাজি করাতে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার চেষ্টা করতে থাকেন শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য, যেন তিনি তাদেরকে নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কারণে শেখ মুজিবের পরিবারের অবশিষ্ট কারোই বাংলাদেশে প্রবেশ সম্ভব ছিল না। তারপরও ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

আরো উল্লেখ্য, দিল্লির সেই দিনগুলোতে বিশিষ্ট সাংবাদিক এ এল খতিব কাজ করতেন শেখ হাসিনার সহকারী হিসেবে। তিনিই ‘হু কিল্ড মুজিব?’ বইটির রচয়িতা, যেটাকে মনে করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ড বিষয়ক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

মানসিক অবস্থা

দিল্লিতে কাটানো পৌনে ছয় বছরে মানসিকভাবে শেখ হাসিনা ছিলেন অত্যন্ত বিপর্যস্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার পরিবারের সিংহভাগ সদস্যের সঙ্গে যা হয়েছিল, তা মেনে নেয়া শেখ হাসিনার জন্য ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। সেদিনের স্মৃতি বিভীষিকার মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তাকে।

এমনকি ১৫ আগস্টের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উল্লেখও ছিল শেখ হাসিনার জন্য বড় ধরনের ট্রিগার। তাই তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া তার সঙ্গে দেখা করতে আসা সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ করতেন, তার সামনে যেন ১৫ আগস্ট বিষয়ক কোনো কথাই তোলা না হয়।

১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস; Image Source: Jugantor

শেষ কথা

শেখ হাসিনার দিল্লিতে কাটানো পৌনে ছয় বছরের বিশেষ গুরুত্ব হলো, ওই সময়টাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন নিজের মন শক্ত করতে, এবং দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে।

১৯৭৫ সালে নিজের পরিবারের প্রায় সবাইকে হারানোর পরপরই বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারলে শেখ হাসিনা কী করতেন, আর বাংলাদেশের ৭৫-পরবর্তী ইতিহাসই বা কেমন হতো, তা আমাদের কখনোই জানার সুযোগ হবে না।

তবে এটুকু বলাই যায়, ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি যে মানসিকভাবে শক্তিশালী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজ স্বদেশ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, এবং পরবর্তীতে ধরেছেন বাংলাদেশের হাল, সেই অধ্যায়ের ভিত রচিত হয় তার পৌনে ছয় বছরের দিল্লি জীবনেই।

This article is in Bengali. It is about how Sheikh Hasina's life was in Delhi between 1975 and 1981. Necessary references have been hyperlinked inside. 

Featured Image © The Daily Sun

Related Articles