দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে আসলে প্রথমেই যে লোকটির চেহারা আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, তিনি অ্যাডলফ হিটলার। বিশ্বের সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিও বোধহয় তিনিই। কালের আবর্তনে জার্মান এই একনায়ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা আজগুবি কাহিনী। এর কিছু হয়তো সত্য, তবে অধিকাংশই কল্পনাপ্রবণ মানুষের মাত্রাতিরিক্ত কল্পনার ফসল।
আমাদের আজকের এই লেখায় হিটলারকে ঘিরে গড়ে ওঠা সেসব গুজব এবং এর সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের দিকেই নজর দেয়া হয়েছে।
চার্লি চ্যাপলিনকে পছন্দ করতেন বলেই হিটলার অমন গোঁফ রেখেছিলেন
অ্যাডলফ হিটলারের মুখের দিকে তাকালে যে কারো প্রথমেই নজরে পড়বে তার বিচিত্র গোঁফটি। বলা যায় এটা তার একটি ট্রেডমার্ক। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৯৪ বছর আগেকার কথা। ১৯২৩ সালে হিটলারের প্রেস সেক্রেটারি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন গোঁফটি কামিয়ে ফেলবার জন্য। তবে হিটলার সেই পরামর্শ শোনেন নি। কারণ হিসেবে বলা হয়, হিটলার নাকি চার্লি চ্যাপলিনের বেশ বড় রকমের ভক্ত ছিলেন। তাই তার মতো করেই গোঁফ রাখতে চাইতেন তিনি।
এই কথাটি পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। কারণ চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন বিশ শতকের বিশ্বখ্যাত এক পরিচালক ও অভিনেতা। বিচিত্র এ গোঁফের জন্য তিনি যতটা বিখ্যাত, ঠিক ততটাই কুখ্যাত হয়ে আছেন হিটলার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারকে ছেড়ে দিয়েছিলো এক ব্রিটিশ সেনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন, সময় ১৯১৮ সাল। প্রাইভেট হেনরি ট্যান্ডি নামে এক ব্রিটিশ সৈনিকের দায়িত্ব পড়েছিলো মার্কোনিং নামে ফ্রান্সের এক গ্রামের কাছাকাছি এলাকায়। সেখানেই ট্যান্ডি সন্ধান পেয়ে যান আহত এক জার্মান তরুণ সেনার। কিন্তু কেন যেন সেদিন সেই আহত সৈন্যটিকে ছেড়ে দেন তিনি। পরবর্তীকালে সেই জার্মান সেনাকেই সারা বিশ্ব চিনেছিলো ‘অ্যাডলফ হিটলার’ নামে!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার অংশ নিয়েছিলেন বাভারিয়ান আর্মির অংশ হিসেবে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধেই অংশ নেন তিনি, আহত হন বিভিন্ন সময়। তবে ব্রিটিশ সৈন্যের হাত থেকে এভাবে বেঁচে গিয়ে পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের সময় তার খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ব্যাপারটি অনেকের কাছেই ঠেকে গল্পের মতো। আসলে হিটলার সেদিন কোথায় ছিলেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না কোনো ইতিহাসবিদই। তাই তাকে ঘিরে এমন কাহিনীর সত্যতা যে কতটুকু তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহই আছে।
চাঁদে হিটলার গোপন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন
মানুষের কল্পনার দৌড় যে কতদূর পর্যন্ত হতে পারে তার চমৎকার নিদর্শন এই গুজবটি। ১৯৪২ সালের শুরুর দিকে ছড়িয়ে পড়া এ গুজবে দাবি করা হতে থাকে হিটলার ও তার গঠিত নাৎসি বাহিনী কেবল মহাকাশ জয়ের অভিযানই চালাচ্ছে না, পাশাপাশি চাঁদে তাদের গোপন এক সামরিক ঘাঁটিও আছে!
যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে রকেট সংক্রান্ত প্রোগ্রামগুলোতে জার্মানরাই ছিলো অগ্রগামী, তবুও হিটলার বাহিনীর এমন কিছু করার প্রমাণ আজ পর্যন্ত মেলে নি। এছাড়া যুদ্ধের পরে নাৎসি বাহিনীতে কাজ করা অনেক বিজ্ঞানীই চলে যান আমেরিকায়, যোগ দেন তাদের সাথে নানা গবেষণামূলক কাজকর্মে। নাৎসি বাহিনীর জন্য রকেট তৈরির কাজে নিয়োজিত সেসব বিজ্ঞানীদের যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মহাকাশ যাত্রার উপযোগী এয়ারক্রাফট বানাতে সময় লেগেছিলো বেশ কয়েক বছর। এ থেকেই বোঝা যায় যে, হিটলার বাহিনীর চাঁদে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের কথাটি অনুর্বর মস্তিষ্কের উর্বর কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই না।
হিটলারের ছিলো বিশাল এক ইউএফও’র বহর
এ গুজবটিও বেশ চমৎকার। কথিত আছে এন্টার্কটিকায় এক গোপন ঘাঁটিতে নাকি হিটলার ফ্লায়িং সসারের মতো দেখতে ইউএফও’র বিশাল এক বহর গড়ে তুলেছিলেন। এমনকি এগুলো বানানোর প্রযুক্তি তিনি এলিয়েন তথা ভিনগ্রহের প্রাণীদের থেকে রপ্ত করেছিলেন বলেও অনুমান করেন অনেক কনস্পিরেসি থিওরিস্ট।
এসব আজগুবি কল্পনার উৎস মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কাল, যখন নাৎসি বাহিনীর পরীক্ষামূলক নানা জেট এয়ারক্রাফটের সন্ধান পেয়ে যায় মিত্রবাহিনী। যেমন এই ছবিতে দেখানো Horton Ho 229 এর কথাই উল্লেখ করা যায়। যদিও এগুলোকে অনেকের কাছেই সাইফাই মুভিতে দেখানো ইউএফও’র মতো লাগতে পারে, তবে কাজকর্ম সম্পাদনের দিক দিয়ে এগুলো ছিলো সাধারণ এয়ারক্রাফটের মতোই।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক ছিলেন হিটলার
এ গুজবটি ডালপালা মেলেছে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে। একদল ইতিহাসবিদ দাবি করেছেন হিটলার নাকি রোগজীবাণুকে বেশ ভয় পেতেন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিলেন। রোগজীবাণুর ভয়ে বিভিন্ন মেডিকেল চেক-আপের সময় তিনি নাকি জামা-কাপড় খুলতে চাইতেন না। এমনকি শারীরিক মিলনের সময় পর্যন্ত তিনি পোশাক পরেই থাকতেন! তবে সাম্প্রতিককালে ইতিহাসবিদদের উদ্ভট এ দাবিগুলোর পেছনে তেমন শক্ত কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে নি।
হিটলারের কেবলমাত্র একটি অণ্ডকোষ ছিলো
জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারকে নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় গুজবগুলো তার জননাঙ্গকে ঘিরে আবর্তিত। এর মাঝে বেশ জনপ্রিয় একটি হলো তিনি নাকি মাত্র একটি অণ্ডকোষ নিয়ে বেঁচে ছিলেন! এ গুজব ছড়ানো ও এতে বিশ্বাসীদের দাবি হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সমের যুদ্ধে (Battle of Somme) আহত হয়েই একটি অণ্ডকোষ হারান হিটলার। তবে এর পেছনে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেন নি। অনেকে আবার বিভিন্ন মেডিকেল রেকর্ড ঘাটিয়ে দাবি করেন যে, হিটলার নাকি Undescended Testes এর সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু এ দাবিটিও বিতর্কিত।
তার জননাঙ্গ ছিলো বেশ ছোট
এবারের তীরটিও ছোড়া হয়েছে হিটলারের পুরুষত্বের দিকে লক্ষ্য করেই। তার জননাঙ্গ নিয়ে প্রচলিত দ্বিতীয় জনপ্রিয় গুজব সেটির আকারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক দাবি করে থাকেন যে, হিটলার মাইক্রোপেনিসের অধিকারী ছিলেন অর্থাৎ তার জননাঙ্গ একজন স্বাভাবিক পুরুষের জননাঙ্গের তুলনায় বেশ ছোট ছিলো। তবে এমন দাবির স্বপক্ষেও কোনো শক্ত প্রমাণ হাজির করতে পারেন নি এ তত্ত্বের প্রবক্তাগণ।
হিটলার কি ইহুদীদের বংশধর ছিলেন?
অ্যাডলফ হিটলার সম্পর্কে বেশ প্রচলিত একটি প্রশ্ন হলো- “হিটলার কিংবা তার কোনো পূর্বপুরুষ কি ইহুদী ছিলেন?” এমন প্রশ্ন উঠে আসার পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণও রয়েছে।
হিটলারের বাবার নাম অ্যালোইস। ১৮৩৭ সালে যখন তার জন্ম হয়, তখন তার বাবার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। অর্থাৎ অবৈধ সন্তান হিসেবেই তাকে চিনতে শুরু করে সবাই। এবং আজ পর্যন্ত হিটলারের দাদার সন্ধান পাওয়া যায় নি। অ্যালোইসের মা অর্থাৎ হিটলারের দাদী মারিয়া শিক্লগ্রাবার এক ধনী ইহুদী পরিবারে কাজ করতেন বলে জানা যায়। তাই অনেকে ধারণা করে থাকেন সেই পরিবারের কারও সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের ফলেই গর্ভধারণ করেন মারিয়া।
২০১০ সালে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে একটি গবেষণার ব্যাপারে উল্লেখ করা হয় যাতে হিটলারের ৩৯ জন আত্মীয়ের লালা সংগ্রহ করে তাদের ডিএনএ’র উৎপত্তিস্থল খোঁজা হয়। সেই গবেষণার ফলাফলে বলা হয় যে, ‘সম্ভবত’ হিটলারের পূর্বপুরুষ ইহুদী ছিলেন। এখানে ‘সম্ভবত’ শব্দটি এসেছে, ‘নিশ্চিত’ নয়; অর্থাৎ বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। সেই রিপোর্টে বলা হয়- “হিটলারের আত্মীয়দের নমুনায় পাওয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ E1b1b1 নামের ক্রোমোসম পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসীদের মাঝে বেশ দুর্লভ। মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়ার বর্বর জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি আশকেনাজি ও সেফ্রাডিক ইহুদীদের মাঝে এটি অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। … হ্যাপ্লোগ্রুপ E1b1b1, যা আনুমানিক ১৮-২০ ভাগ আশকেনাজি ও ৮.৬-৩০ ভাগ সেফ্রাডিক ওয়াই ক্রোমোজমের জন্য দায়ী, ইহুদীদের বংশধরদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।”
এই গবেষণা থেকেও ‘নিশ্চিত’ কথাটি আসে নি, এসেছে ‘সম্ভবত’ কথাটি। তাই কোনটি বিশ্বাস করবেন সেটি এখনো আপনার উপরই নির্ভরশীল।
আর্জেন্টিনায় পালিয়ে গিয়ে ৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন হিটলার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাই ইউরোপ ছেড়ে আর্জেন্টিনার মতো দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোতে পালিয়ে যান। ১৯৪৫ এর এপ্রিলে আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের জীবনের ইতি টানেন এই একনায়ক। তবে অনেক কনস্পিরেসি থিওরিস্টই মনে করেন যে, হিটলার আসলে আত্মহত্যা করেন নি। বরং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে তিনিও পালিয়ে যান আর্জেন্টিনায়। সেখানে ৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন তিনি। অবশ্য এ দাবির পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
অনেক জায়গাতেই স্বর্ণ লুকিয়ে রেখেছিলেন হিটলার
গুজব আছে যে হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনী নাকি বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ বিশ্বের নানা স্থানে লুকিয়ে রেখে গেছে। এর মাঝে একটি জায়গা হলো অস্ট্রিয়ান আল্পসের লেক টপ্লিট্যের তলদেশ, আরেকটি নিউ জিল্যান্ডের কোনো দ্বীপ। তবে ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর’ প্রবাদের মতোই এ গুজবগুলো কেবল এর বিশ্বাসীদের জন্যই প্রযোজ্য। এগুলোর কোনো সত্যতা যাচাই আজও সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি। ফলে বিশ্বাসী গুপ্তধন সন্ধানীরা আজও হিটলার বাহিনীর লুকিয়ে রাখা সেই স্বর্ণের স্তুপের সন্ধানে ছুটে বেড়ায় বিশ্বের নানা স্থানে।
এন্টার্কটিকাতেও ছিলো হিটলারের গোপন ঘাঁটি
বিভিন্ন এলিয়েন টেকনোলজি, অতিপ্রাকৃত জিনিসের সংগ্রহ ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ লুকিয়ে রাখতে হিটলার বেছে নিয়েছিলেন এন্টার্কটিকাকে। এমনই একটি গুজব প্রচলিত রয়েছে কনস্পিরেসি থিওরিস্টদের মাঝে। এর মূল কারণ ১৯৩৮ সালে এন্টার্কটিকায় নাৎসি বাহিনীর চালানো এক অভিযান, যা অনেকের মাঝে এমন সন্দেহের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সেখানে ব্রিটিশ সেনাদের গোপন অভিযান এ ধারণার আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেয়। তবে আসল কথা হলো এমন কোনো নাৎসি ঘাঁটি কখনোই সেখানে বানানো হয় নি।