ঘটনা-১
গত রাতে লা লিগার জম্পেশ একটি ম্যাচ ছিলো। বন্ধুদের সাথে রাতভর খেলা দেখে হৈ-হুল্লোড় করে ঘড়ির দিকে তাকানোর কথা মনেই হয়নি আপনার। সবাই যখন একে একে ঘুমাতে গেল তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত সাড়ে তিনটা বাজে। দেখেই আপনার চোখ ছানাবড়া! সকাল সাড়ে ৭টায় না উঠতে পারলে আপনি কিছুতেই সকালের বাস ধরতে পারবেন না। এই দুশ্চিন্তায় সারারাত আপনার ঘুম হলো না। আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় আপনি সূর্যোদয় দেখতে পেলেন। চোখ জ্বালাপোড়া আর মাথাব্যথাকে সঙ্গী করে আপনি বেরিয়ে পড়লেন অফিসের উদ্দেশ্যে।
অফিসের পৌঁছানোর পর যখন চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন তখনই বুঝতে পারলেন সারা রাজ্যের ঘুম এখন আপনার চোখে ভর করেছে। কম্পিউটার স্ক্রিনে প্রতিটা লিখাই অস্পষ্ট। ফাইল খুলেও তাকিয়ে থাকতে পারছেন না আপনি। না দেখেই বুঝতে পারছেন চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। এখন উপায় কী? বাসায় চলে যাবেন? আজকের জমে থাকা কাজগুলোর কী হবে? আজ যে একটা জরুরি প্রেজেন্টেশন ছিলো! এর উপরে আপনার ইনক্রিমেন্ট নির্ভর করছে। ফলাফল, জোর করে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ঘটনা-২
রাতে বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন। অনেকদিন পর বান্ধবীটার সাথে দেখা। রাতে না খেয়ে কিছুতেই আসতে দিচ্ছে না। রাতে খেয়ে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। থেকে গেলেন বান্ধবীর বাসায়। সারা রাত চললো সুখ-দুঃখের গল্প। তারপর লক্ষ্য করলেন আজানের সুর শোনা যাচ্ছে। কাল ল্যাব অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার শেষ দিন। সাথে ৩টা ক্লাস আছে। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। পরদিন ঢুলুঢুলু চোখে ক্লাসে ঢুকলেন। স্যারের কথা কিছুই বুঝতে পারছেন না। ঘুমে চতুর্দিক শুধুই অন্ধকার হয়ে আসছে।
আপনাদের জন্যই আমাদের আজকের এই আয়োজন। চলুন দেখে নেয়া যাক এই রকম পরিস্থিতিতে ঘুমের বিরুদ্ধে জেতার উপায়গুলো কী কী।
১. রাতে যথেষ্ট ঘুমান
দিনের বেলা ঘুমের প্রবণতা কমিয়ে আনার জন্য রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। রাতে সাধারণত আপনি যত ঘণ্টা ঘুমিয়ে পরদিন চনমনে অনুভব করেন তার থেকে দুই ঘণ্টা এমনকি এক ঘণ্টা কম ঘুমালেও পরদিন দুপুর বা বিকেলের দিকে আপনার ঘুম পাবে।
২. আরামদায়ক চেয়ার পরিহার করুন
কোনো কারণে আগের রাতে যথেষ্ট ঘুম না হলে পরদিন অফিসে বা ক্লাসে তুলনামূলক শক্ত চেয়ার বেছে নিন। বাছাইয়ের সুযোগ না থাকলে আপনি পিঠ সোজা করে রেখে বসতে পারেন। চেয়ারে গা এলিয়ে বসবেন না।
৩. সময়মত খাবার গ্রহণ করুন
কাজের চাপে হয়ত সকালের নাস্তা মিস হয়ে গিয়েছে। দুপুরে তাই প্রচণ্ড ক্ষুধায় অনেকখানি খেয়ে ফেললেন। এরপর এমন ভরা পেটে আপনি আর কোনোভাবেই বসে থাকতে পারছেন না। একটু না ঘুমালে তখন মনে হবে বেঁচে থাকাই কষ্টকর। তাই কোনো বেলায় খাবার যেন মিস না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
৪. অ্যালকোহল পরিহার করুন
এটি অসময়ে ঘুমের প্রবণতা বাড়ায়। সুতরাং পরদিন সুস্থ এবং চনমনে থাকতে অ্যালকোহল পরিহার করুন।
৫. প্রচুর পানি পান করুন
পানিশূন্যতা আমাদের শরীরে অনেক রকম সমস্যা সৃষ্টি করে যা হয়ত আমরা জানি না। পানিশূন্যতার জন্য শরীরে অবসাদের পরিমাণ বাড়ে। এর জন্য ঘুম পায় বেশি।
৬. চুইংগাম চাবান
চুইংগাম খেলে ঘুম ঘুম ভাব কেটে যায়। ডিপার্টমেন্ট অফ সাইকোলজি অফ কনভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি ঘুম নিয়ে গবেষণা করে এমন ফলাফল পেয়েছে। তাদের মতে, পুদিনা পাতার স্বাদে তৈরি চুইংগাম ক্লান্তি কমিয়ে আনে। তাছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণাগারে ৩০ জন শিক্ষার্থীর উপর ১১ মিনিট ধরে গবেষণা চালিয়ে উক্ত সমাধানে একমত হয়। তাছাড়া অ্যান্ড্রিউ স্কোলে নামক একজন গবেষক তার রিপোর্টে জানান, চুইংগাম চাবালে মুখের পেশির যে ব্যায়াম হয় তা মস্তিষ্কে ঘুমের প্রবণতা কমিয়ে আনে।
৭. কাজ বা পড়াশোনার বিষয়বস্তু বদলানো
কাজ বা পড়াশোনায় একঘেয়েমির জন্য অনেক সময় ক্লান্ত লাগে বা ঘুম পায়। এজন্য কাজের বা পড়াশোনার বিষয়বস্তু সেভাবেই বাছাই করুন। সকালের প্রথম দিকেই রাখতে পারেন অপেক্ষাকৃত সৃজনশীল কাজগুলো। পরে আস্তে আস্তে চাপ কমিয়ে আনুন। যে সময়টায় ঘুম পায় সেই সময়ের জন্য আপনি রাখতে পারেন আপনার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়টি। তাহলে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইলেও ঐ বিষয়টিই আপনাকে সজাগ এবং কর্মঠ রাখবে।
৮. ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় পান করুন
মায়ো ক্লিনিক তাদের একটি গবেষণায় জানিয়েছে, ৫০০-৬০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন আপনাকে দিনে সতেজ রাখতে যথেষ্ট। তাই ভাগে ভাগে ঐটুকু পরিমাণ ক্যাফেইন গ্রহণ করতে পারেন। অতিরিক্ত ক্যাফেইন আপনাকে সাময়িকভাবে অনেক শক্তি দিলেও পরবর্তীতে আপনি ভীষণ ক্লান্ত বোধ করবেন।
৯. উঠুন, হাঁটাচলা করুন
একইভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবেন? উঠে একটু হাঁটাচলা করুন। যখন কফি বা চা পান করছেন তখন একটু জানালার কাছে কিংবা সুযোগ থাকলে বারান্দায় বেরিয়ে পড়ুন। অসহ্য লাগা শহরটাকেও তখন মনোরম মনে হবে। শুনতে পারেন পছন্দের গান। দেখতে পারেন ২/৪ মিনিটের মজার কোনো শর্ট ফিল্ম। দিনে অন্তত আধা ঘণ্টা হাতে রাখুন। ১০-১৫ মিনিট করে দুই তিন ভাগে বিরতি নিন। বাসায় প্রিয়জনের সাথে কথা বলুন। মুঠোফোনে রাখা প্রিয় মুহূর্তের কিছু ছবিতে চোখ বুলাতে পারেন। এই সবই আসলে আপনাকে শত ব্যস্ততার মাঝেও মানসিক প্রশান্তি দেবে।
১০. অনেকের সাথে কাজ করুন অথবা গ্রুপ স্টাডি করুন
আপনি যদি কর্মক্ষেত্রে থাকেন তাহলে চেষ্টা করুন অনেকের সাথে মিলে কাজ করতে। এতে করে আপনার দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং ঘুমানোর চিন্তাও আপনার মাথায় আসবে না।
ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে গ্রুপ স্টাডি করা যেতে পারে। বন্ধু-বান্ধবেরা একসাথে মিলে পড়াশোনা-আড্ডা-গল্প নির্বিঘ্নে আপনাকে জাগিয়ে রাখবে অনেকক্ষণ।
১১. পাওয়ার ন্যাপ দিন
ব্যাপারটা অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো। হালকা ঘুমিয়ে আপনি পুরো ঘুমটাকে কাটিয়ে দিতে পারেন। চেয়ারে গা এলিয়ে ১০/১৫ মিনিটের জন্য একটি ছোট ঘুম দিতে পারেন। তবে এর ফলাফল সবসময় ভালো হয় না। চেয়ারে ঠিকমত মাথা না রাখা, ঘুমের ঘোরে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়া বা টেবিলে মাথা রেখে শোয়ার সময় ঘাড় বাঁকিয়ে শোয়া থেকে মাথাব্যথা বা ঘাড় ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। তাই এসব দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
১২. কয়েকদিন কাজকে ‘না’ বলুন
যদি এমনটা প্রায় রোজই হয়ে থাকে যে খুব বেশি ক্লান্ত লাগছে আপনার তাহলে কাজ থেকে কিছুদিন বিরতি নিন। কয়েকদিন কোথাও থেকে ঘুরে আসার পর আপনি কাজ করার জন্য ফিরে আসতে পারবেন দ্বিগুণ গতিতে।
মানুষের শরীর আসলে খুব জটিল রসায়নের সমন্বয়। কখন ঘুম পাবে, কখন ক্লান্তি লাগবে, কখন ক্ষুধা পাবে এই ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা সত্যিই কঠিন। কিন্তু কিছু নিয়ম মেনে চললে হয়ত আমরাও পারব শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই নিয়ে নিতে। সুস্থ জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। তবে দুয়েকটা দিন নিজেকে ছুটি দেয়াটাও মন্দ কিছু নয়। নিয়ম ভাঙ্গার সাথে কিছু নিয়ম জুড়ে দিয়ে আপনিও হয়ে উঠুন সব জায়গাতেই পরিপূর্ণ!
ফিচার ইমেজ সোর্স: HuffPost