২০১৮ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের ৪৮টি ম্যাচ শেষে ১৬টি দলের বিদায় ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। টিকে আছে বাকি ১৬টি দল। এই ১৬ দলকে নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে নকআউট পর্ব। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ৪৮টি ম্যাচে যত উত্তেজনা দেখা যায়, তার চেয়ে দিগুণ উত্তেজনা উপহার দেয় নকআউট পর্বের ১৬টি ম্যাচ! তবে এবার অবশ্য আগের তুলনায় গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। সেই ধারা বজায় থাকলে নকআউট পর্বের ম্যাচগুলো আরো বেশি জমজমাট হওয়ার কথা।
তা, নকআউট পর্বে দলগুলোর সম্ভাব্য রাস্তা কীরকম হতে পারে? কোন দলের রাস্তাটা কিছুটা সহজ হয়েছে কিংবা কোন দলের পথ কিছুটা বন্ধুর? চলুন সেই ব্যাপারেই কিছুটা ধারণা নেওয়া যাক।
বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে মোট চারটি ধাপ থাকে। ধাপ চারটি হচ্ছে রাউন্ড অফ সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনাল। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ১৬টি দল তো ঠিক হয়েই গিয়েছে। এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক রাউন্ড অফ সিক্সটিনে কোন দলগুলো একে অপরের মুখোমুখি হবে।
নকআউট পর্বে কোন দলগুলো একে অপরের মুখোমুখি হবে তা উপরের ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে। পাঠকরা হয়তো খেয়াল করেছেন, ছবিতে ১৬টি দলকে সমান দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ছবিটা দেখলে যে কেউ বলে উঠবে যে, বাঁপাশে পরাশক্তি দলগুলোর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এখানে ব্রাজিল, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, পর্তুগাল, বেলজিয়ামের মতো দলগুলো ফাইনালের একটি দল হওয়ার জন্য লড়বে। অন্যদিকে ডানপাশে সেই অর্থে ইংল্যান্ড আর স্পেনই বড় পরাশক্তি। ক্রোয়েশিয়া, কলম্বিয়াকে মোটেও খাটো করে দেখা হচ্ছে না। কিন্তু এটা তো সত্যি, বড় মঞ্চে বড় দলের তকমাটা বেশ বড় প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবের সত্যতা যাচাই করার জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ৮৮ বছরের বিশ্বকাপ ইতিহাসে মাত্র আটটি দেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে- এই একটি পরিসংখ্যানই অনেক কিছু প্রমাণ করে দেয়।
পাঠকরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন কেন বেলজিয়াম বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচে দুই দলই জয়ের ব্যাপারে এতটা অনীহা প্রকাশ করেছে! বেলজিয়াম গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে জাপানের মতো অপেক্ষাকৃত সহজ প্রতিপক্ষ পেয়েছে এ কথা সত্যি। কিন্তু তাদের ফাইনালে যেতে হলে ব্রাজিল, ফ্রান্স কিংবা আর্জেন্টিনার মতো কঠিন প্রতিপক্ষের বাঁধা পার হতে হবে এ কথাও সত্য। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের ফাইনালে যাওয়ার পথে একমাত্র বড় দল হিসেবে রয়েছে স্পেন। এ কারণেই গ্রুপ রানার্স আপ হয়েও ইংলিশরা খুব একটা অখুশি হয়নি। তবে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে এরকমটা হতো না! আর্জেন্টিনা যদি তাদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হতো আর জার্মানি যদি বিদায় না নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নকআউট পর্বে যেত, তাহলে স্পেন, ইংল্যান্ডের সাথে ডানপাশে আর্জেন্টিনা, জার্মানির মতো পরাশক্তিও থাকতো। সেক্ষেত্রে দুই অংশই বেশ ভারসাম্যপূর্ণ হতো।
কিন্তু এই অঘটনের বিশ্বকাপে এমন অনেক কিছুই হয়েছে যা আগে কেউ ভাবেনি। সে যা-ই হোক, এখন নকআউট পর্বের ম্যাচগুলোতে কোন দলগুলোর জয়ের পাল্লা ভারি আর কোন দুটি দলের ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা বেশি সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই বাঁপাশের দলগুলোর ম্যাচগুলোর দিকে লক্ষ্য করা যাক। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে দুই পরাশক্তি ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা। নিঃসন্দেহে রাউন্ড অফ সিক্সটিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচ হতে যাচ্ছে এটি। এত তাড়াতাড়ি এমন দুটি পরাশক্তির মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু গ্রুপ পর্বে বাজে পারফর্মেন্সের কারণে আর্জেন্টিনা গ্রুপ রানার্স আপ হওয়ায় অনেক হিসাব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ফ্রান্স সি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন, নামের ভারে এই বিশ্বকাপের অন্যতম ভারসাম্যপূর্ণ দল। তবে নামের সাথে এই ফ্রান্স দলের পারফর্মেন্স ঠিক মানানসই নয়! এমবাপে, দেমবেলে, গ্রিজম্যান, জিরুদের মতো ফরোয়ার্ড থাকা সত্ত্বেও গ্রুপপর্বে মাত্র তিন গোল করেছে ফ্রান্স।
তবুও ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনার এই লড়াইয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবে ফ্রান্স। কিন্তু শক্তিমত্তার দিক থেকে ফ্রান্স যতোই এগিয়ে থাকুক, আর্জেন্টিনা দলে একজন লিওনেল মেসি আছেন। মেসি জ্বলে উঠলে শক্তির এই ব্যবধান যেকোনো সময়ে ঘুচে যেতে পারে! মোটামুটি একই কথা উরুগুয়ে বনাম পর্তুগালের ম্যাচটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গ্রুপপর্বের প্রতিটি ম্যাচে জিতে এসেছে উরুগুয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, উরুগুয়ের ডিফেন্স এখন পর্যন্ত একটি গোলও হজম করেনি! অন্যদিকে গ্রুপপর্বে এক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছাড়া আর কোনো পর্তুগিজ তারকাই নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। এখানে শক্তির বিচারে উরুগুয়ে এগিয়ে থাকলেও এক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সব হিসাব এলোমেলো করে দিতে পারেন।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে শক্তিমত্তার বিচারে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স আর উরুগুয়ের দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু মেসি আর রোনালদো নিজেদের দলের হয়ে জ্বলে উঠলে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স বনাম উরুগুয়ের বদলে আর্জেন্টিনা বনাম পর্তুগালের ম্যাচটিও হতে পারে! বিশ্বমঞ্চে মেসি বনাম রোনালদোর আরেকটা দ্বৈরথ দেখার জন্য নিশ্চয়ই অনেক ফুটবলপ্রেমী মুখিয়ে আছেন। আবার হিসাব একটু অন্যরকম হলে ফ্রান্স বনাম পর্তুগালের কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা হতে পারে। সেটা হলে ইউরো ২০১৬ ফাইনালের পুনর্মঞ্চায়ন হবে। আরেকটু অন্যভাবে ভাবলে আর্জেন্টিনা বনাম উরুগুয়ের অল লাতিন দ্বৈরথও কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা যেতে পারে। এই চার দলের মধ্যকার হিসাব এতটাই গোলমেলে যে এদের মধ্যে কোন দলটি সেমিফাইনালে যাবে সেটা বলা খুবই কঠিন কাজ।
এর চেয়ে বাঁপাশের নিচের চার দলের হিসেবটা একটু সহজ। ব্রাজিল বনাম মেক্সিকোর মধ্যকার রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচে ব্রাজিল বেশ এগিয়েই আছে। তবে নিজেদের দিনে মেক্সিকো ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর সেটা তো জার্মানির বিপক্ষে মেক্সিকোর জয়ের ম্যাচেই সবাই টের পেয়েছে। তবুও এ ম্যাচে ব্রাজিল ফেভারিট এটা বলাই যায়। আরেক ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে বড় কোনো অঘটন না ঘটলে বেলজিয়ামের জয় পাওয়াটাও মোটামুটি নিশ্চিত। অর্থাৎ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ব্রাজিল আর বেলজিয়ামের কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।
কাগজে কলমে এবারের বেলজিয়াম দলটা বেশ ভারসাম্যপূর্ণ, তবে বড়মঞ্চে গিয়ে খেই হারানোর অভ্যাসটা বেলজিয়ামের জন্য বড় দুশ্চিন্তা। তাছাড়া কোচ হিসেবে রবার্তো মার্টিনেজ এখনো সবার আস্থা অর্জন করতে পারেননি। এসব কারণে ব্রাজিল বনাম বেলজিয়ামের কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা হলে বেলজিয়ামের চেয়ে ব্রাজিল কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবে। তবে গত তিন আসরে নকআউট পর্বে ইউরোপের দলগুলোর বিপক্ষে ব্রাজিলের ভয়াবহ রেকর্ড বেলজিয়ামের আশার ফানুসে জ্বালানি দিতে পারে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাঁপাশের সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইটা অনিশ্চয়তার মোড়কে ঠাসা। সম্ভাব্যতা বিচারে ফ্রান্স বনাম ব্রাজিলের সেমিফাইনালে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কিঞ্চিৎ বেশি। কিন্তু ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার স্বপ্নের সেমিফাইনালের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিংবা বেলজিয়াম বনাম ফ্রান্স অথবা বেলজিয়াম বনাম পর্তুগাল অল ইউরোপিয়ান সেমিফাইনালও হতে পারে। আবার সম্ভাবনার বিচারে উরুগুয়ে বনাম ব্রাজিলের দেখাও হয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ ১৯৫০ সালের মারাকানাজোর পুনর্মঞ্চায়নও হতেই পারে। সব মিলিয়ে বাঁপাশটা সত্যিই বড্ড অনিশ্চিত।
এতক্ষণের আলোচনা সংশয়ের বেড়াজালে ঢাকা ছিল। এবার আসুন ডানপাশের কিছুটা সহজ সমীকরণ মেলানো যাক। এখানে স্পেন বনাম রাশিয়ার রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচে স্পেনেরই জয় পাওয়ার কথা। যদিও গ্রুপপর্বে স্পেনের পারফর্মেন্স সন্তোষজনক ছিল না। শেষমুহুর্তে কোচ লোপেতেগিকে হারানোর ক্ষতটা এখনো পুরোপুরি যায়নি। তা-ও স্পেনকে হারাতে হলে স্বাগতিক রাশিয়াকে ২০০২ বিশ্বকাপের দক্ষিণ কোরিয়ার মতোই অলৌকিক কিছু ঘটাতে হবে।
অন্য ম্যাচে এরিকসেনের ডেনমার্কের বিপক্ষে জয় পেতে রাকিটিচ, মড্রিচের ক্রোয়েশিয়াকে খুব একটা কষ্ট করতে হবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে স্পেন আর ক্রোয়েশিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা হবে। এমনটা হলে স্পেন কিছুটা এগিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক ফর্ম আর দলগত শক্তির কারণে ক্রোয়েশিয়া দলটাকে একদম উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া ক্রোয়েশিয়ার সোনালী প্রজন্মের এটাই শেষ বিশ্বকাপ। সুতরাং নিজেদের শেষটা অন্য আলোয় রঙিন করার সব চেষ্টাই ক্রোয়াটরা করবে। তবুও বলতেই হচ্ছে, এখান থেকে স্পেনের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার সম্ভাবনাই বেশি।
ডানপাশের নিচের ধাপে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে মুখোমুখি হবে সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। শক্তির বিচারে দুই দলই মধ্যম মানের, তবে শেষ ম্যাচে সুইডিশরা যেভাবে মেক্সিকোকে উড়িয়ে দিলো, তাতে সুইজারল্যান্ডকে কিছুটা পিছিয়ে রাখতেই হচ্ছে। আর ইংল্যান্ড বনাম কলম্বিয়ার ম্যাচেও ফেভারিট ইংলিশরাই। যদিও টানা দুই ম্যাচ জিতে কলম্বিয়া বেশ আত্মবিশ্বাসী, তবুও ইউরোপের মাঠে ইংলিশদের সাথে হয়তো কলম্বিয়ানরা পেরে উঠবে না। এমনটা হলে কোয়ার্টার ফাইনালে সুইডেন আর ইংল্যান্ডের দেখা হবে। হ্যারি কেইন, রাহিম স্টার্লিং, জন স্টোন্সদের নিয়ে গড়া তরুণ ইংল্যান্ড দলটি সুইডেনের বিপক্ষে ফেভারিট হিসেবেই নামবে।
অর্থাৎ সব হিসাব ঠিক থাকলে স্পেন আর ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে দেখা হবে। শক্তির বিচারে স্পেন কিছুটা হলেও ইংলিশদের চেয়ে এগিয়ে, তাছাড়া ইংলিশরা দীর্ঘদিন বড়মঞ্চে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। তাই গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ড যদি সেমিফাইনালে উঠেও যায়, তবে ইংলিশ মিডিয়ার চাপ আর নিজেদের অতীত ইতিহাসের ভূতের কারণে স্পেনের সাথে ঠিক কতটা পেরে উঠবে সেটা নিয়ে বেশ বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। তাই ফাইনালে স্পেনকে দেখতে পাওয়ার বেশ জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য ইতিহাস পরিবর্তনে কেইন, স্টার্লিংরা নিজেদের সেরাটা দিয়ে দিলে ৫২ বছর পর ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ ফাইনালে দেখলে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না।
সুতরাং নকআউট পর্বে উত্তীর্ণ ১৬টি দলের মধ্যে কাগজে কলমের হিসেবে স্পেনের ফাইনালে খেলার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। বাঁপাশের হিসাবটা বড্ড বেশি জটিল। তাই এত তাড়াতাড়ি উত্তর বলাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও ফ্রান্স অথবা ব্রাজিলকে আরেক ফাইনালিস্ট বলা হয়তো কিছুটা কম ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কাগজ-কলমের হিসেবে তো আর ফুটবলটা হয় না, ফুটবলের সব উত্তর পাওয়া যায় খেলার মাঠেই। সেই খেলার মাঠ নাটকের চেয়ে বেশি নাটকীয়, কখন যে কী ঘটে যায় তা আগেভাগে আন্দাজ করা খুব মুশকিল।
তাই ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে মস্কোয় কোন দুটি দল খেলবে সেটা জানতে হলে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। গ্রুপপর্বের মতো নকআউট পর্বের ম্যাচগুলোও দুর্দান্ত হবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিক থেকে আগের সব আসরকে ছাড়িয়ে যাবে এই বিশ্বকাপ- সেই প্রত্যাশাই রইলো।
ফিচার ইমেজ: BBC