২৬ জুন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারের পাইলট কর্তৃক ‘মারি ম্যান’ নামে পরিচিত দৈত্যাকার মানুষের রূপরেখা আবিষ্কারের ২০ বছর পূর্ণ হলো। এই চিত্রকর্মটি তৈরির সময় একটি মানুষও সাক্ষী হিসেবে না থাকাটা একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হয়ে রয়েছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগ কতটা বিচ্ছিন্ন। এমনকি কে বা কারা এটি এঁকেছে, তা খুঁজে বের করার জন্য সম্প্রতি পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসায়ী ডিক স্মিথ এই ৫ হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই রহস্যময় মারি ম্যান সম্পর্কে।
মারি ম্যানের পরিচয়
অস্ট্রেলিয়ার আডিলেড থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে মরুভূমির উপর আবিষ্কৃত এই মারি ম্যান আবিষ্কারের পর থেকেই আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। পাইলট ট্রেভর রাইট ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন প্রথমবারের মতো এটি আবিষ্কার করেন। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় শুষ্ক জমির মাঝখানে মারি ম্যান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শৈল্পিক চিত্রগুলোর একটি। শক্ত মাটিতে ১১৫ ফুট প্রশস্ত এবং ১ ফুট গভীর লাইন কেটে আঁকা বিশাল মারি ম্যান আকাশ থেকে সহজেই দৃশ্যমান। স্থানীয় মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, মারি ম্যানের রয়েছে ২৮ কিলোমিটার পরিমাপের সীমারেখা। তবে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ কিলোমিটার। স্থানীয়দের মতে, এটি উমেরা হাতে একজন আদিবাসীর চিত্র। উমেরা হলো এক ধরনের লাঠি যা আদিবাসীরা শিকারের কাজে ব্যবহার করে।
কে বা কারা এঁকেছিল রহস্যময় এ চিত্র?
আবিষ্কৃত হওয়ার ১৩ বছর পরও এর উৎপত্তি সম্পর্কে খুব সামান্যই জানা যায়। এর শিল্পীর চূড়ান্ত প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও বেশিরভাগ সংকেত নির্দেশ করে, আমেরিকানরাই এটি তৈরি করেছে। তবে রহস্যময় এই মারি ম্যানের ক্ষেত্রে কোনোকিছুই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না। এটি আবিষ্কৃত হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই কিছু বেনামী প্রেস রিলিজ পাওয়া যায়। মারি হোটেল এবং অ্যাডিলেডের দ্য অ্যাডভার্টাইজার সংবাদপত্রের কাছে পাঠানো এই প্রেস রিলিজগুলোতে বলা হয়, এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম শিল্পকর্ম। যে বা যারা চিত্রটি এঁকেছে তারাই এই প্রেস রিলিজগুলো দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
প্রেস রিলিজের ভাষা বিশ্লেষণ করে বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করে যে, মারি ম্যান আমেরিকানরাই তৈরি করেছে। কেননা, এটির বর্ণনায় ফুটের বদলে একক হিসেবে মিটার ব্যবহার করা হয়েছে এবং আদিবাসী সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত ‘রিজার্ভেশন’ শব্দটি মূলত আদিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি। তাই এটি কারা তৈরি করে থাকতে পারে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে আমেরিকানদের নামই উঠে আসে।
এতসব সূত্রের পরেও অনেকে মনে করেন, শুধুমাত্র তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করা বা দূরে সরে রাখার জন্যই এগুলো ছাপানো হয়েছিল। তবে ১৯৯৯ সালে মারি ম্যানের পায়ের কাছে একটি ফলক আবির্ভূত হলে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ফলকটি একটি আমেরিকান পতাকা, অলিম্পিক রিং এবং আদিবাসী শিকার সম্পর্কে একটি বই থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে। তবে কে এটা বানিয়েছে এ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
চূড়ান্ত অদ্ভুত সংকেতগুলি হচ্ছে সাইটটির কাছাকাছি একটি পিটে পাওয়া কয়েকটি জিনিস। এর মাঝে একটি আমেরিকান পতাকা, চিত্রটির একটি স্যাটেলাইট ছবি এবং ডেভিডিয়ান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একটি বিস্ময়কর সূত্র ছিল। এসব কিছু আমেরিকানদের দিকে নির্দেশ করলেও, অনেকে ধারণা করেন মারি ম্যান একজন অস্ট্রেলীয় শিল্পীর তৈরি যিনি ২০০২ সালে মারা গেছেন।
পেশাদারিত্বের সাথে সম্পন্ন কাজ
মারি ম্যান চিত্রকর্মটি স্থলভাগ থেকে অনেক বড় দেখা যায়। তাই এটি পর্যটন ফ্লাইটে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর দায়িত্বে থাকা ফিল টার্নারের বিশ্বাস, যিনি বা যারা এটি তৈরি করেছেন তারা পেশাদার ছিল এবং এটি তৈরিতে জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বিবিসিকে বলেন, “যে এটি তৈরি করেছে সে ছোট ছোট বাঁশের লাঠি দিয়ে এর সীমারেখা চিহ্নিত করেছে। স্থানাঙ্ক জানা না থাকলে আপনি কখনই বুঝতে পারবেন না আপনি এটির বা পায়ের পাতার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন নাকি কনুইয়ের কাছে। সেসময় জিপিএস প্রযুক্তি একদম প্রারম্ভিক অবস্থায় ছিল বলে ধরে নিলে এটিকে অসাধারণ কৃতিত্ব বলা যায়।“
বিভিন্ন মতামত
মারি ম্যান যেখানে চিত্রিত হয়েছে, সে অঞ্চলের ঐতিহ্যগত মালিক আরাবানা সম্প্রদায়। আরাবানা অ্যাবরিজিনাল কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক লরেন মারিক বলেন, ১৯৯৮ সালে এর আবির্ভাব ঘটলে কিছু আদিবাসী এটিকে তাদের ভূখণ্ডের অপবিত্রকরণ হিসেবে ধরে নিয়ে মনক্ষুণ্ণ হয়।
তবে তিনি জানান, এখন এটি নিয়ে মিশ্র মতামত দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, সেই ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের মতে মারি ম্যান এখন একটি প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, “এটি এখন সেখানে বর্তমান এবং সময়কে পেছনে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি পরিস্কার কৌশল তৈরি করা।” তিনি আরও বলেন, “হয়তো রহস্য এর আকর্ষণের একটি অংশ, কিন্তু সত্যি বলতে কী, কে এটি তৈরি করেছে এমন কোনো প্রশ্ন কেউ আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেনি।“
এখনও মারি ম্যানের সত্যিকারের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে না পারায় এটি আধুনিক দিনের রহস্যের অন্যতম একটি হয়ে রয়েছে। এলাকাটিতে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। তবে এলাকা জুড়ে উড়োজাহাজে উড়ে বেড়ানো অনুমোদিত। পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মারি ম্যান বছরের পর বছর ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু স্থানীয়রা আরাবান জনগণের অনুমোদন গ্রহণ করে যন্ত্রপাতির সাহায্যে ২০১৬ সালে এটি পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হয়। ২০১৬ সালে স্থানীয়রা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার আগে এটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
Featured Image Source: The Australian