আমাদের দেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও কৃষক এবং কৃষিকাজ নিয়ে প্রত্যেক বছর একধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়। সমস্যাটি হচ্ছে কৃষিকাজ করার জন্য পানির অভাব। আমাদের দেশে এটি একটি সত্য ঘটনা যে, বছরে খুব বেশি সময়ের জন্য জমিতে সেচ দেয়ার জন্য পানি পাওয়া যায় না। অনেক জায়গায় সারা বছরে বোরো, আমন এবং আউশ ধানের যে চাহিদা সেটা মেটানোর জন্য হিমশিম খেতে হয় কৃষকদের। অনেক জায়গায় সারা বছরে এই তিন ধরনের ধান আবাদ করা হয় না, হয়তো দুই ধরনের করা যেতে পারে। আবার পর্যাপ্ত পানির অভাবে দেখা যায় কোনো মৌসুমের ধানই চাষ করা যাচ্ছে না। আবার যদিও বা চাষ করা যাচ্ছে, কিন্তু এতে কৃষকদের খুব বেশি লাভ হচ্ছে না।
কৃষকরা যে কৃষিকাজ করে এবং তা থেকে যে লাভ তারা পায় সেটা অনেকাংশে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। কারণ যাদের জমি বেশি থাকে ধানের মৌসুমে তাদের দশ থেকে বিশ হাজার টাকা লাভ হলেও যাদের জমি কম তাদের ক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ অনেক কমে যায়। এক কাঠা জমিতে ধান চাষ করতে পুরো চার থেকে পাঁচ মাসে যে পরিমাণ খরচ হয় সেটা থেকে লাভ ওঠানো অনেক কষ্ট। সেচ কাজ করার জন্য পানির যোগান বাবদ খরচ, জমি যারা চাষ করে দেবে অর্থাৎ খাঁটি বাংলা ভাষায় যাদের কামলা বলা হয় তাদের খরচ, ফসল নিরাপদ রাখার জন্য কীটনাশক সহ অন্যান্য খরচ, পুরো ফসল হওয়ার পর সেগুলো কাটার জন্য এবং বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে গাড়ি ভাড়া করা হয় তার খরচ (গাড়ি ভাড়ার খরচ আবার ধানের বস্তা প্রতি হিসাব করা হয়) এবং সর্বশেষে বাজারে নিয়ে দামাদামি করে ধান বিক্রি ও সেখান থেকে অল্প কিছু লাভ।
এই পুরো প্রক্রিয়ার ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেচের জন্য পানির যোগান দেয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, গ্রামের সবাই মিলে একটি বা দুটি ডিপ টিউবওয়েল লাগিয়ে রাখে। সেখান থেকে চাষ উপযুক্ত পুরো জমিতে পানির যোগান দেয়া হয়। এই ডিপ টিউবওয়েল হচ্ছে ডিজেল চালিত মেশিন, যা থেকে মাটির গভীর পর্যন্ত পাইপ লাগানো থাকে এবং মাটির নিচের পানি টেনে এনে ফসলের জন্য তা সরবরাহ করে। একেকটি টিউবওয়েলের ক্ষমতা একেক রকম।
এই টিউবওয়েল নিয়ে অনেক ধরনের সমস্যায় কৃষকদের পড়তে হয়। যেমন- এসব কল সাধারণত বিদ্যুৎ দিয়ে চলে। যদি কোনো কারণে বিদ্যুৎ না পাওয়া যায়, তাহলে কল থেকে পানি সরবরাহ করা যায় না। বাংলাদেশের অনেক গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা ভালো নয়। লোডশেডিং সেখানে দৈনন্দিন সমস্যা। দেখা যায়, দশ-বারো ঘণ্টা সময় ধরে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। যখন জমিতে পানি দেয়ার সময় তখন দেয়া যায় না। যখন বিদ্যুৎ আসে তখনই একমাত্র পানি সরবরাহ করা হয়। এটা অনেক বড় সমস্যা। এসব পাম্প বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন এগুলো সারানো আরেকটি সমস্যা। আবার অনেক অঞ্চলে দেখা যায় কয়েক একর জমির জন্য একটিমাত্র পাম্পের ব্যবস্থা করা গিয়েছে। তখন পুরো এলাকায় পানির সরবরাহ করতে গেলে পাম্প নিজের কর্মদক্ষতার সীমা অতিক্রম করে কাজ করতে থাকে। সেজন্য এসব ডিপ টিউবওয়েল তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়।
আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে কোনো কোনো গ্রামে গেলে দেখা যায় দুটি গ্রামের জন্য একটি বা দুটি করে ডিপ টিউবওয়েল লাগানো হয়েছে। তখন ধানের মৌসুমে দুই গ্রামের জমিতে পানি সরবরাহ করার সময় পুরো জায়গায় তা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিছু জায়গায় সেচ দেয়া যায়, আবার কিছু জায়গায় যায় না। যে জায়গাগুলোতে যায় না, সেখানে পরেরবার ধানের মৌসুমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।
সারা বছর ঠিকভাবে পানি না পাওয়ার কারণে নিজেদের সংসার চালানোর জন্য কৃষক পরিবারের সদস্যরা শহরে চলে আসে। যে মৌসুমে তারা ধানের চাষ করতে পারছে না, সেসময়টা শহরে এসে রিকশা চালিয়ে, গার্মেন্টসে কাজ করে, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে, দারোয়ানের চাকরি করে গ্রামের সংসার চালাতে হয়। অনেকে আবার নিজেদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায় শুধুমাত্র মাসের শেষে সরকার থেকে যে একশো করে টাকা পাওয়া যায় সেটা নেয়ার জন্য।
কৃষকদের জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা। কারণ মৌসুমের শেষে কতটুকু ধান ফলবে, কতটুকু বিক্রি করা যাবে, কতটুকু লাভ হবে সেগুলোর উপর নির্ভর করছে তাদের আয়। তবুও অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেও প্রতি বছর তারা কৃষিকাজ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করছে। কিন্তু শুধুমাত্র পানি সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা যদি ঠিকভাবে করা যেত তাহলে তাদের এসব সমস্যা অনেকাংশে লাঘব করা যেতো।
এই লক্ষ্যে পৃথিবীর এক নম্বর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সমস্যার জন্য কাজ করছে। তারা তাদের কাজের জন্য ভারতকে বেছে নিয়েছে। কৃষকদের সাথে বিভিন্ন সময়ে কথা বলে তারা জানতে পেরেছেন, ধানের প্রত্যেক মৌসুমে তাদের যতটুকু লাভ হয় তার ৯০ শতাংশ চলে যায় পরের মৌসুমে ধান আবাদ করার জন্য ডিজেল বা কেরোসিন পাম্প ভাড়া করতে। আবার পানির অভাবে অনেক জমি চাষ করা হয় না বিধায় তারা শহরে গিয়ে অন্যান্য কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে।
কৃষকরা যাতে সারা বছর ফসলের জন্য পানি পেতে পারে সেজন্য এমআইটির গবেষকরা একটি কম মূল্যের Low Pressure Drip Irrigation System তৈরি নিয়ে গবেষণা করেন। বাংলাদেশে Drip Irrigation System ব্যবহার করা হয় তবে কম। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকাতে দেখা গিয়েছে Bangladesh Agricultural Research Institute (BARI)– এই কৃষিপদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে এবং এই পদ্ধতির Benefit-Cost Ratio অনেক বেশি। অর্থাৎ লাভ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যদি আমাদের দেশে এই কৃষিপদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
এটা খুবই সোজা একটি পদ্ধতি। জমিতে খুব কম কিন্তু সমান হারে পানি দিতে হবে (ঘণ্টায় ২ থেকে ২০ লিটার করে) এবং এমিটারের (Emitter) মাধ্যমে পানিগুলো শুধু সেই ফসলের জন্য ব্যবহার করা হবে, অন্য কোথাও নয়। অর্থাৎ যদি অনেকগুলো গাছের চারা লাগানো হয় তাহলে সেই গাছগুলোর গোড়াতেই কেবল পানি সরবরাহ করা হবে। অন্য কোথাও নয়। সাধারণত দেখা যায়, সেচ দেয়ার সময় পানি পুরো জমি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এতে জমির যেসব জায়গায় পানির দরকার নেই সেসব জায়গায়ও পানির ব্যবহার হচ্ছে, যা একটি অপচয়। Drip Irrigation এর মাধ্যমে পানির অপচয় কম হয়।
এমআইটির গবেষকদের পক্ষ থেকে যখন Low Pressure Drip Irrigation System তৈরি করার প্রস্তাব দেয়া হলো, তখন কৃষকরা তাদেরকে বলেছিলো যে, Drip Irrigation– পদ্ধতি ভালো। কিন্তু যদি সারা বছর পানির অভাবে কৃষিকাজই না করা যায়, তাহলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে লাভ কী হবে?
অত্যন্ত যৌক্তিক একটি প্রশ্ন এটা। তাই তারা কৃষকদের এই কথা মাথায় রেখে এমন একটি মেশিন বানায় যেটা বাজারে অবস্থিত অন্য যেকোনো পাম্প থেকে বেশি কর্মদক্ষতাপূর্ণ এবং সম্পূর্ণ সৌরচালিত। তারা মেশিনের ডিজাইন করে ভারতীয় কৃষকরা এটা সহজে যেন ব্যবহার করতে পারে সেই কথা মাথায় রেখে। তারা যে অঞ্চলের জন্য এই কাজ করছিলো তার আশেপাশে ছিল বৃহৎ গঙ্গা নদীর অববাহিকা। অর্থাৎ পানির অভাব ছিল না সেখানে। আবার মাটির নিচের পানির পরিমাণও ছিল যথেষ্ট। শুধু সেখানে দরকার ছিল কম দামী একটি যন্ত্র, যেটা যে কেউ কিনে ব্যবহার করতে পারে এবং যে মেশিনটিকে সারা বছর ধরে চালানো যাবে। তাই তারা একটি সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প তৈরি করে, যেটা সবদিক দিয়েই ব্যবহারযোগ্য।
এর কর্মদক্ষতা ছিল অন্যান্য পাম্পের থেকে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি। ডিজেল পাম্প থেকে অবশ্যই এর দক্ষতা অনেক বেশি, কারণ ডিজেলে যে তেল খরচ হয়, এমআইটির গবেষকদের তৈরি এই পাম্পের তার থেকে ২০ শতাংশ কম খরচ হয়। এরপর তারা তাদের তৈরি মেশিন নিয়ে ভারতে এসে সেই অঞ্চলের মানুষদেরকে ট্রেনিং দেয় যে কীভাবে এই পাম্প উপযুক্তভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এরকম করে তারা শেষ দুই বছরে তাদের এই নতুন পাম্প ভারতের ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশাতে পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং ভালো ফলাফল পাচ্ছেন। এখন সেখানে তারা Kethworks বলে একটি স্টার্টআপ কোম্পানিও তৈরি করেছেন, যেখানে এই পাম্প নিয়ে কাজ করা হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় এই পাম্প সরবরাহ করা হয়।
আমাদের দেশেও এ ধরনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। এটা একটি আশ্চর্য বিষয় যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে আগে কেউ সৌরচালিত ডিপ পানির কল তৈরি করার কথা চিন্তা করেনি। যদি আমাদের দেশে এ ধরনের কাজ করা যায়, তাহলে যেমন কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন করতে সহায়তা করা যাবে, ঠিক তেমনি তাদেরকে পরিবার রেখে দূরে গিয়ে কাজ করতে হবে না। এই ধরনের কাজ শুরু করার জন্য বেশি কিছু নয়, শুরুতেই শুধু ধৈর্য এবং সময় নিয়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের সাথে কথা বলে নিলে এবং তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারলে কাজ অনেকটাই এগিয়ে যায়। এতে করে ভালো স্পন্সরশিপ নিয়ে কৃষিক্ষেত্রে লাভবান কাজের সুযোগ আছে আমাদের দেশে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: cprofitenergy.com