ভারতে বেশ কয়েক বছর ধরেই গাঁজার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার ব্যাপারে বেশ শোর উঠেছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় ও সামাজিক-রাজনৈতিক অনেক ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক সাড়ায় বৈধকরণের প্রশ্নটি নতুনভাবে প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। তবে কি ভারতে বৈধ হতে যাচ্ছে গাঁজা? কেনই বা সেখানে গাঁজার পক্ষে গড়ে উঠছে জনমত? সে উত্তর খুঁজতেই আজকের লেখা।
গাঁজার জন্য পদযাত্রা!
গাঁজা বৈধকরণের পক্ষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ভারতে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় অভিনব গণপদযাত্রার। এই পদযাত্রার ডাক দিয়েছিল ‘দ্য গ্রেট লিগালাইজেশন মুভমেন্ট- ইন্ডিয়া’ নামক একটি আন্দোলনকারী গোষ্ঠী। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, পুনে, তিরুবনন্তপুরমে এ পদযাত্রায় অংশ নেয় চোখে পড়ার মতো মানুষ।
আন্দোলনকারীদের মতে, গাঁজা হচ্ছে ‘গ্রেটেস্ট প্ল্যান্ট অন দ্য আর্থ’। একসময়ের এই ‘বিলিয়ন-ডলার ক্রপ’ দীর্ঘ ৩১ বছর যাবত ভারতে নিষিদ্ধ। এমন নয় যে ভারতে গাঁজা দুর্লভ; বরং এতই সহজলভ্য যে আপনি ভাবতেই পারেন, গাঁজা নিষিদ্ধ করে তাহলে হলোটা কী! বিষয়টি হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞা ব্যবহারিকভাবে বলবৎ কেবল প্রকাশ্যে উৎপাদন ও কেনাবেচার ক্ষেত্রেই। আন্দোলনকারীরা মূলত শুধু এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেই নন, তারা চান ভেষজ কারণে, আধ্যাত্মিক চর্চায় কিংবা অবসাদমুক্তির জন্য গাঁজা ব্যবহারের স্বাধীনতা এবং বিগত ৩১ বছরে গাঁজা কেনাবেচার দায়ে সাজা পাওয়া বা আটক সকলের মুক্তি।
প্রথমবারের মতো গাঁজা চাষের লাইসেন্স ইস্যুকরণ
গত বছরের জুলাইয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু মন্ত্রী মানেকা গান্ধী গাঁজা বৈধকরণের পক্ষে বিবৃতি দেন। সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের তরফে এটিই ছিল সর্বপ্রথম সবুজ সংকেত। এরই পথ ধরে এক মাস বাদেই ভারত সরকার প্রথমবারের মতো গাঁজা উৎপাদন ও ব্যবহারের লাইসেন্স ইস্যু করে। তবে এই লাইসেন্সটি কেবল দেওয়া হয় কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক এন্ড মেডিকেল রিসার্চ (CSMR) ও বোম্বে হেম্প কোম্পানি (BHC)-কে; উদ্দেশ্য- উভয় প্রতিষ্ঠান মিলে গাঁজার ভেষজ গুণের ওপর গবেষণা চালানো। এই গবেষণাকার্য চালানোর জন্য চাষক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয় জম্মু ও কাশ্মীরকে। একে গাঁজার বৈধকরণের পথে ভারতের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই মনে করছেন অনেকে।
ওদিকে, দ্য গ্রেট লিগালাইজেশন মুভমেন্ট- ইন্ডিয়ার সাবেক সদস্য ও অ্যাক্টিভিস্ট প্রিয়া মিশ্র সরকারি এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও উল্লেখ করতে ভোলেননি যে, ২০-এর অধিক দেশে এই গবেষণাকার্য ইতোমধ্যে শেষ এবং সেসব দেশে গাঁজার ভেষজ ব্যবহার বৈধ। এ কারণে তিনি মনে করেন, ভারত সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেও তা গ্রহণে অন্তত দশটি বছর সময় বেশি নিয়েছে! তিনি বলেন, “এই গবেষণাটি শেষ হতে ৬ মাস থেকে ১ বছর লেগে যাবে। ততদিন পর্যন্ত সাধারণ রোগীরা এ উদ্ভিদ ব্যবহার করতে পারবেন না, এটিই চিন্তার বিষয়।”
গাঁজার ঔষধি গুণের স্বীকৃতি দিয়েছে WHO
গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফেও আসে এক যুগান্তকারী বিবৃতি। মৃগীরোগজনিত হৃদজটিলতাসহ কাছাকাছি ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় গাঁজার ঔষধি গুণাগুণ বেশ কার্যকর এবং ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার অন্যান্য গঞ্জিকাদ্রব্যের প্রতি নির্ভরতা বা নেশা তৈরি করে না, এমনটাই জানানো হয়েছে উক্ত বিবৃতিতে। গাঁজার এ গুণ মূলত তার যে উপাদানটিতে রয়েছে, তা হলো ক্যানাবিডিওল (CBD)। ওদিকে গাঁজার যে উপাদানটি মূলত সেবনকারীকে ‘হাই’ করে বা ‘আচ্ছন্ন’ করে, সেটি হলো টেট্রা হাইড্রো ক্যানাবিনল (THC)। কিন্তু CBD‘র প্রভাবে কেউ ‘হাই’ হন না এবং তা ব্যবহারে তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য সংস্থার সেই গবেষণা; বরং মৃগী, পার্কিনসন্স, হান্টিংটন রোগ, বাইপোলার ডিজঅর্ডারসহ অনেক রোগের প্রতিষেধী গুণ বিদ্যমান CBD-তে। তাই CBD-কে বৈধ করবার পক্ষে রায় দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মূলত এই রায়টির পর আরো জোরদার হয়েছিলো ভারতের ‘গ্রেটেস্ট লিগালাইজেশন মুভমেন্ট’।
আইনসভায় আইনবদলের ডাক!
২০১৭ এর ২০ নভেম্বরে পাঞ্জাবের পটিয়ালার সাংসদ ধরমবীর গান্ধী প্রথমবারের মতো আইনসভায় গাঁজার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার প্রস্তাব করেন। তার উত্থাপিত এই বিলটির সমর্থনে ছিলেন প্রয়াত অভিনেতা গুরদাসপুরের বিজেপি সাংসদ বিনোদ খান্নাসহ অনেক সহকর্মী। উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালের ‘চেতনানাশক ওষুধ ও নেশাজাতীয় বস্তু সম্পর্কিত আইন (NDPS)’-এ গাঁজার উৎপাদন ও কেনাবেচা ও ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভারতে। জাতিসংঘের তৎকালীন মাদকবিরোধী নীতিগত অবস্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার অন ড্রাগস’-এর প্রতি আনুগত্য থেকেই আইনটি করা হয়েছিল। ধরমবীরের মতে, উক্ত আইনের সংস্কারের প্রয়োজন, কেননা এই আইনে কোকেইন, হেরোইনের সাথে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক দ্রব্য গাঁজাকেও গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, যার রয়েছে কিছু ভেষজ গুণও। এই বিলটি শীতকালীন অধিবেশনে পাস হওয়ার কথা ছিল, সেটি হলে সংশোধনী আনা হতো NDPS আইনে, বৈধ হতো অন্তত গাঁজার ভেষজ ব্যবহার। কিন্তু সেটি হয়নি।
পক্ষে সরব সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা
বিল পাস না হলেও উক্ত বিল প্রস্তাবনার প্রভাব পড়েছে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে। পক্ষে-বিপক্ষে সরব হচ্ছেন আমজনতা ও বিশিষ্ট জনেরা। এ বছরের জানুয়ারিতে পঞ্চকুলায় টেডএক্সের একটি অনুষ্ঠানে ‘বিতর্কিত’ যোগগুরু রামদেবের ব্র্যান্ড ‘পতঞ্জলি’র সিইও আচার্য বালাকৃষ্ণন গাঁজা বৈধকরণের পক্ষে এবং এ সম্পর্কিত আইনে ফৌজদারি শাস্তিবিধানের বিপক্ষে মত দেন। তার মতে, গাঁজা বেদ অনুযায়ী একটি পবিত্র ও ঔষধি গুণাগুণসমৃদ্ধ উদ্ভিদ। ক্ষতিকর উপাদান THC-কে বাদ দিয়ে ক্যানাবিস তেল বাজারজাতকরণে বৈধতা চান তিনি।
মানেকা গান্ধী বা ধরমবীর গান্ধীই কেবল নয়, ভারতের অনেক নামি রাজনীতিকই সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন গাঁজা বৈধকরণের পক্ষে। এদের একজন হলেন ওড়িশার বিজু জনতা দলের সাংসদ তথাগত সৎপতি। গত বছর লোকসভা অধিবেশনে গাঁজা তন্তুর তৈরি জামা পরে উপস্থিত হয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ওড়িশায় চা-পানি পানের মতো ‘ছিলম’ (গাঁজা) সেবনও অত্যন্ত স্বাভাবিক-নৈমিত্তিক ব্যাপার। তার মতে, নেশাটা যাতে চড়ে বসে সর্বগ্রাসী রূপ নিতে না পারে, কেবল এটুকু খেয়াল রাখাই যথেষ্ট। পাশাপাশি গাঁজা উৎপাদন ও সেবনকে ফৌজদারি অপরাধ বানিয়ে দেবার আইনটিকে ‘অভিজাততন্ত্র-দুষ্ট’ বলে মনে করেন তিনি। তার সোজাসাপটা প্রশ্ন, “আপনি কি ওয়াইন হাতে নিয়ে বসে থাকা কোনো বড়লোককে গ্রেফতার করছেন?”
ধরমবীর গান্ধী মূলত গাঁজার ভেষজ ব্যবহারের অবমুক্তি চাইলেও সামগ্রিক ব্যবহারের বৈধতাতেও কিছু যুক্তি দিয়েছেন। হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “ভাং (গাঁজামিশ্রিত পানীয়), আফিম, ভুক্কি (পপি উদ্ভিদের খোসা) ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী সস্তা অথচ কম ক্ষতিকর মাদককে বৈধতা দেওয়া হলে দামী এবং অধিক ক্ষতিকর মাদকের প্রতি তরুণদের ঝোঁকার হারটা কমে আসবে।” একটি দালিলিক তথ্য আবার ধরমবীরের বক্তব্যের যথার্থতাও প্রমাণ করে- অ্যালকোহলে আসক্তির হার যেখান শতকরা ১৬ ভাগ, সেখানে গাঁজায় আসক্তের পরিমাণ তুলনামূলক বেশ কম, ৯ ভাগ!
ভারতে সাধু-সন্ন্যাসীদের একটি বিরাট অংশের কাছে গাঁজা অপরিহার্য একটি অনুষঙ্গ। ভগবান শিবই কেবল গাঁজাভক্ত ছিলেন তা-ই নয়, বেদেও গাঁজার ঔষধি গুণের কথা বলা হয়েছে। এ কারণে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকদের একটি বড় অংশ গাঁজা বৈধকরণের কথা বলছেন। কিন্তু শুধু তারাই নন, প্রগতিশীল রাজনীতিকদেরও একটা অংশ বৈধকরণের পক্ষে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নামটি হলো কংগ্রেস নেতা ও সুবক্তা শশী তারুরের। ভাতিজা যুক্তরাজ্যের ড্রাগ চ্যারিটি রিলিজের পলিসি এন্ড কমিউনিকেশন অফিসার অবিনাশ তারুরকে নিয়ে সম্প্রতি ‘দ্য প্রিন্ট’ পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন তিনি। লেখাটির সারমর্ম ছিলো এমন-
টিএইচসির কারণে গাঁজাকে মোটেও ‘হার্মলেস’ বলা যাবে না। কিন্তু একজন মদ্যপায়ীর যেমন ১২% অ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার বা ৪০% অ্যালকোহলযুক্ত হুইস্কির মধ্য থেকে খুশিমত একটি বেছে নেবার অধিকার রয়েছে, তেমনি গাঁজা সেবনের ক্ষেত্রে ঠিক কতটুকু নিজের ‘ক্ষতি’ করবেন বা ‘হাই’ হবেন, সেই ‘চয়েজ’টি সেবনকারীকে দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আইন কেবল অনুমোদিত উৎপাদনকারীর থেকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে গাঁজার বাজারজাতকরণ তদারক করতে পারে। অন্যদিকে, গাঁজা উৎপাদন ও বিপণন বৈধ করা হলে তাতে আরোপিত রাজস্ব জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। সেই অর্থ আবার শিক্ষাসহ গাঁজা সেবন নিরুৎসাহিতামূলক প্রচারকাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমনটা হচ্ছে সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্য বা অ্যালকোহলের ক্ষেত্রে। সেইসাথে গাঁজা বৈধকরণে ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহারকারীরা তো উপকৃত হবেনই।
ভারতে গাঁজা বৈধ হবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বর্তমান বলছে, গাঁজা বৈধকরণের পক্ষ-বিপক্ষের মেরুকরণ দেশটিতে ভালোই জমে উঠেছে।
Featured Image Source: The Great Legalization Movement