২০১৪ সালটি ছিল মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন্সের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক একটি বছর। সে বছর ৪ মার্চ এয়ারলাইন্সটির এমএইচ৩৭০ ফ্লাইটের একটি বোয়িং বিমান ২২৭ জন যাত্রী ও ১২ জন ক্রু সমেত রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। ঐ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৭ জুলাই এয়ারলাইন্সটির আরেকটি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর যাওয়ার পথে ইউক্রেনের আকাশে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ১৭ এর বোয়িং ৭৭৭ বিমানটি একটি মিসাইলের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হয় এর ২৮৩ জন যাত্রী এবং ১৫ জন ক্রুর সকলে।
২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়েছিল রাশিয়ার নির্মিত বাক (BUK) মিসাইলের আক্রমণে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে প্রকাশিত ভিন্ন একটি কমিটির আংশিক রিপোর্টে ঘটনার পেছনে রাশিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটি এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঐ আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেছে। রাশিয়াকে দায়ী করে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছে নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়াও। কিন্তু বরাবরের মতোই রাশিয়া হামলার সাথে তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে। ফলে চার বছর আগে সংঘটিত ঐ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন জটিলতা।
কী ঘটেছিল এমএইচ১৭ এর ভাগ্যে?
Factfile on the Malaysia Airlines MH17 disaster, which was shot down by a Russian-made BUK missile, according to the Dutch Safety Board pic.twitter.com/B9xVlXJKXZ
— AFP news agency (@AFP) May 27, 2018
ফ্লাইট এমএইচ১৭ এর দুর্ঘটনাটি যে সময় ঘটে, সে সময় ঐ এলাকায় ইউক্রেনের সরকারী বাহিনী এবং রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। প্লেনটি যখন রাশিয়া সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল, তখনই এর সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্লেনটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রাশিয়া সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে, বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের মধ্যে ১৯৩ জন ছিলেন ডাচ নাগরিক, ৪৩ জন মালয়েশিয়ান এবং ২৭ জন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। এছাড়া অন্যান্য নিহতরা ছিলেন ইন্দোনেশিয়া, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, জার্মানী ও ফিলিপিন্সের নাগরিক।
তদন্ত কমিটির ফলাফলে কী উঠে এসেছে?
গত বৃহস্পতিবার ডাচ নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম (JIT) নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে তদন্তে উঠে আসা বিভিন্ন ছবি, ভিডিও, স্যাটেলাইট থেকে ধারণকৃত ছবি দেখিয়ে দাবি করা হয়, কমিটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ পেয়েছে যে, ফ্লাইট এমএইচ১৭ বিধস্তের পেছনে রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী সরাসরি জড়িত। তাদের দাবি অনুযায়ী, মিসাইল সিস্টেমটি আনা হয়েছিল রাশিয়ার কার্স্কে অবস্থিত ৫৩তম অ্যান্টি এয়ারক্রাফট ব্রিগেড থেকে। এবং আনা নেওয়ার সাথে জড়িত সকলেই ছিল রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনীর নিয়মিত সদস্য।
কোন পক্ষ কী বলছে?
Foreign Minister @JulieBishopMP spoke to @Dan_Bourchier @fauziah_ibrahim on @BreakfastNews. Ms Bishop says she holds Russia legally responsible for the downing of Malaysia flight MH17. pic.twitter.com/umt8BIGKbl
— ABC News (@abcnews) May 26, 2018
বৃহস্পতিবারের তদন্ত কমিটির ফলাফল প্রকাশের পর ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বলেছেন, তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রচেষ্টার বিন্দুমাত্র ঘাটতি রাখবেন না। অন্যদিকে ডাচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টেফ ব্লক এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমের তদন্তের প্রেক্ষিতে নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়া এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে যে, এমএইচ১৭ প্লেনটি বিধ্বস্ত করার জন্য যে বাক মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি রাশিয়াই নিয়োগ করেছিল। তিনি আরো বলেন, তার সরকার এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপও একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমরা এখন কেবলমাত্র একটি উপসংহারেই উপনীত হতে পারি। তা হচ্ছে, এমএইচ১৭ প্লেনটি বিধ্বস্ত করার ব্যাপারে রাশিয়া সরাসরিই জড়িত ছিল।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর পক্ষ থেকেও রাশিয়াকে দায়ী করে তাদের দায় স্বীকার করে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে রাশিয়া বরাবরের মতোই বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ডাচ তদন্ত কমিটির ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে কখনোই একটা মিসাইল সিস্টেমও ইউক্রেনে প্রবেশ করেনি।
ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে?
NEWS The Netherlands and Australia will hold Russia legally responsible for its role in the downing of Malaysia Airlines Flight #MH17 in July 2014 which caused the deaths of all 298 people on board. pic.twitter.com/YcZCHwRKRk
— Air Disasters (@AirCrashMayday) May 25, 2018
নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিলেও বাস্তবে তাদের আসলে খুব বেশি কিছু করার নেই। নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টেফ ব্লকও তার বক্তব্যে এ কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করার জন্য সরাসরি কোনো রাষ্ট্রকে দায়ী করা এবং সে অভিযোগ প্রমাণ করা অন্তত জটিল একটি আইনি প্রক্রিয়া। তাই তিনি সে পথে যাওয়ার আগে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, রাশিয়া যেন তাদের দায় স্বীকার করে নেয়, তদন্ত কার্যক্রমে পূর্ণ সহযোগিতা করে, অপারধীদেরকে আইনের হাতে তুলে দেয় এবং নিহতদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়।
রাশিয়া যদি এই আহ্বানে সাড়া দেয়, তাহলে এটিই হতে পারে বর্তমান সংকটের সবচেয়ে সুন্দর এবং সহজ সমাধান। অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং ইউক্রেনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রও হয়তো প্রাথমিকভাবে রাশিয়াকে তাদের দায় স্বীকারের জন্য চাপ দেবে। কিন্তু রাশিয়া দীর্ঘ চার বছর ধরে এ ঘটনার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এসেছে। শুধু তাই না, রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পক্ষকে দাবি করে পাল্টা অভিযোগের তীরও ছোঁড়া হয়েছে। এখন হঠাৎ করে তাদের পক্ষে নিজেদের দায় স্বীকার করে নেওয়া একটি কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হবে। তাছাড়া রাশিয়া এই হামলার দায় স্বীকার করলে ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের ভূমিকা নতুন করে আন্তর্জাতিক বিতর্কের সৃষ্টি করবে। ফলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রাশিয়া নিজেদের দায় স্বীকার করবে না।
The Netherlands and Australia announce that Russia is directly responsible for the downing of flight MH17 on July 17, 2014 — killing all 298 people onboard. https://t.co/yZScWePYWm
— Michael Carpenter (@mikercarpenter) May 27, 2018
নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়ার জন্য দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কিছু প্রমাণ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বড়জোর মিসাইল নিক্ষেপের সাথে সরাসরি জড়িত কিছু ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও রাশিয়া তার সামরিক কর্মকর্তাদেরকে বিচারের জন্য হস্তান্তর করবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, রাশিয়া ইতোমধ্যেই তদন্ত কমিটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। এই ঘটনার সমাধান হয়তো তাই শেষপর্যন্ত কূটনৈতিকভাবেই হবে, যেখানে রাশিয়া সরাসরি নিজেদের দায় স্বীকার না করলেও অন্য কোনোভাবে হয়তো নেদারল্যান্ডস ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে সমঝোতায় যাবে।
Featured Image Source: Dutch Safety Board