মন্দিরের ভিতর তখন আবছা অন্ধকার। চারপাশে নিস্তব্ধতা। এর মধ্যেই মন্দিরের ভেতরের এক কক্ষে প্রবেশ করলেন একজন মহিলা। শান্ত চেহারায় তার ফুটে উঠেছে গাম্ভীর্য, চোখেমুখে বিজ্ঞতার ছাপ। কক্ষে প্রবেশ করে তিনি বসে পড়লেন একটি তেপায়া আসনে। তার পায়ের কাছেই মাটিতে বিশাল এক ফাঁটল। আর সেই ফাঁটল দিয়ে গল গল করে বেরিয়ে আসছে অপার্থিব ধোয়ার কুণ্ডলী। তিনি সেই ধোয়ায় নাক ডুবিয়ে বুক ভরে ধোয়া টেনে নিলেন ভিতরে। তার একটু পরেই দেখা গেলো এক মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় চলে গিয়েছেন তিনি। চোখ দুটো আধবোজা। সেই সাথে বিড়বিড় করে চলেছেন এমন এক ভাষায় যা সাধারণ মানুষের দুর্বোধ্য। তার চারপাশে খুব মনোযোগ দিয়ে তার সেই দুর্বোধ্য শব্দগুলো শুনছেন মন্দিরের একদল পূজারী। এই দুর্বোধ্য শব্দগুলোই বলে দেবে আসন্ন দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে কিংবা কোন যুদ্ধে বিজয়ী হবেন কে!
পুরো ব্যাপারটাই অতিপ্রাকৃত কিংবা অদ্ভুত মনে হলেও এটি কিন্তু মোটেই কাল্পনিক কোনো গল্প নয়। ঠিক এভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হতো প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত অ্যাপোলোর মন্দির থেকে। প্রায় ২,৭০০ বছর পুরনো অ্যাপোলোর সেই মন্দির বর্তমানে পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। তবে দু’হাজার বছর আগেও এই মন্দিরটির ছিল জাঁকজমকপূর্ণ চেহারা। পার্নাসার পর্বতের পশ্চিম ঢালে অবস্থিত এই মন্দিরটি সে সময় পরিচিত ছিল ‘ডেলফির ওরাকল’ নামে। এটিই ছিল ডেলফির বিখ্যাত সন্ন্যাসিনী পিথিয়ার আবাসস্থল।
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে, কয়েকশ বছর ধরে এই পর্বতটিকে পাহারা দিয়ে আসছিল বিশাল আকৃতির এক অজগর সাপ। এই সাপটি ছিল গ্রিক পুরাণে বর্ণিত পৃথিবীদেবী ‘গাইয়া’র পূজারী। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো সেই সাপটিকে মেরে ফেলে ডেলফিকে নিজের উপাসনাস্থল হিসেবে ঘোষণা দেন। কিংবদন্তীর এই কাল্পনিক ঘটনার সাথে ইতিহাসেরও কিছুটা মিল পাওয়া যায়।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মাইসেনিয়ান সময়কালে ডেলফির এই স্থানে পৃথিবীদেবী গাইয়ার পূজারী একদল মানুষের উপনিবেশ ছিল। এরপর খ্রিস্টপূর্ব একাদশ থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এখানে দেবতা অ্যাপোলোর উপাসনা শুরু হয়। আর খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর মধ্যেই ডেলফি এখানকার সন্ন্যাসিনী পিথিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য জগতজুড়ে খ্যাতি লাভ করে। এর পরের এক দশক জুড়ে বিভিন্ন গ্রিক শহরগুলিতে রাজ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ডেলফির ওরাকল হয়ে উঠে অন্যতম প্রধান স্থান।
ডেলফির ওরাকলের দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণীটি ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের কাছে রাজা ক্রোয়েসাসের পরাজয়ের ঘটনাটি। ইতিহাসবিদ হোরাডোটাসের মতে, লিডিয়ানের রাজা ক্রোয়েসাস সেসময় সদ্য জেগে ওঠা পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার আগে তিনি এই আক্রমণ করা ঠিক হবে কি না জানার জন্য ডেলফির ওরাকলের কাছে খোঁজ পাঠান। ডেলফির ওরাকলের কাছ থেকে উত্তর আসে- ক্রোয়েসাস যদি পারস্য আক্রমণ করেন তবে বিশাল এক সাম্রাজ্যের পতন ঘটবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীতে খুশি হন ক্রোয়েসাস এবং পারস্য আক্রমণের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন তিনি।
সবই ঠিক ছিল, কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণীর ছোট্ট একটা বিষয় ভুল বুঝেছিলেন তিনি। আর সেটি হলো ‘বিশাল সাম্রাজ্য’ বলতে ডেলফির ওরাকল পারস্যকে বোঝায়নি, বরং এটি দিয়ে ক্রোয়েসাসের নিজের সাম্রাজ্যকেই বোঝানো হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো, ধ্বংস হয়ে গেলো ক্রোয়েসাসের সাম্রাজ্য। এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে নানা সন্দেহ থাকলেও ডেলফির ওরাকল যে সত্যিই ছিল তা নিয়ে কিন্তু সন্দেহের অবকাশ নেই। আর ডেলফির এই মন্দিরের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন মন্দিরের সন্ন্যাসিনী পিথিয়া।
পিথিয়া কিন্তু নির্দিষ্ট কারো নাম নয়। অ্যাপোলোর মন্দিরের প্রধান সন্ন্যাসিনীর নামকরণ করা হতো পিথিয়া হিসাবে। পিথিয়া (Pythia) শব্দটির অর্থ সাপ। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর হাতে নিহত সেই পাইথন বা অজগরের নাম থেকেই পিথিয়া নামের উৎপত্তি। নানা ইতিহাসবিদের মতে, প্রথমদিকে উচ্চবংশীয় কোনো কুমারী মেয়েকেই পিথিয়া হিসাবে নির্বাচিত করা হতো। কিন্তু একবার এক সুন্দরী পিথিয়া ধর্ষণের শিকার হন। এবং এই দুঃখজনক ঘটনার পর থেকেই পিথিয়া নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়।
ডেলফিবাসী ঠিক করে এর পর থেকে শুধুমাত্র পঞ্চাশের বেশি বয়সী মহিলাদেরকে পিথিয়া হিসেবে নির্বাচিত করা হবে। তবে পূর্বের কুমারী পিথিয়ারা ঠিক যেমন পোশাক পরতেন, নতুন পিথিয়াকেও ঠিক তেমন সাদা পোশাক পরতে হবে। পিথিয়াকে হতে হবে ডেলফির স্থানীয় অধিবাসী। সে উঁচু কিংবা নিচু যেকোনো শ্রেণীর যেকোনো বংশের হতে পারবে। তবে তার অবশ্যই একজন ভালো মা, ভালো স্ত্রী, সর্বোপরি একজন ভালো নারী হিসেবে সুনাম থাকতে হবে।
এ তো গেলো পিথিয়া কিভাবে নির্বাচিত হতো তার কথা। তবে পিথিয়ার আসল কাজ কী ছিল, কিভাবেই বা তিনি তা করতেন চলুন এবার জেনে নিই সে সম্পর্কে।
পিথিয়ার প্রধান কাজ ছিল ভবিষ্যদ্বাণী করা। তিনি একাধারে ভবিষ্যদ্বাণী ও জাদুবিদ্যায় পারদর্শী হতেন। পিথিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পিথিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী কখনো কখনো হতো খুবই সঠিক ও কাজের। আবার কখনো তা হতো অর্থহীন কিছু বুলি। তবে এটি সম্পূর্ণভাবে যে বা যারা ভবিষ্যদ্বাণী জানতে এসেছে তাদের উপর নির্ভর করতো। পিথিয়া সাহায্য করতে চাইলে তাকে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী জানাতেন। তবে তার সব ভবিষ্যদ্বাণীই হতো হেয়ালিপূর্ণ। উপরের রাজা ক্রোয়েসাসের ঘটনার মাধ্যমেই এটি বোঝা যায়।
প্রাচীন গ্রিসে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষই ভবিষ্যদ্বাণীর উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে পিথিয়া প্রতি মাসে শুধুমাত্র একটি দিনেই ভবিষ্যদ্বাণী জানাতেন। ডেলফির এই মন্দিরে যারা ভবিষ্যদ্বাণী জানতে আসতো তাদের সবাইকেই পিথিয়ার কাছে যাওয়ার আগে নিজেকে পবিত্র করে নেওয়ার এক আচার পালন করতে হতো। তবে সবার আগে মন্দিরের পাশের ক্যাস্টালিন ঝর্ণা থেকে পিথিয়া নিজেই নিজেকে পবিত্র করে নিতেন। এরপর তিনি অ্যাপোলোকে খুশি করার জন্য একটি বিশেষ গুল্ম ও যব দিয়ে প্রস্তুত একটি খাবার গ্রহণ করতেন।
সকল পবিত্রতার শেষে ভবিষ্যদ্বাণী জানতে আসা ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হতো। ডেলফির ওরাকল ও ভবিষ্যদ্বাণী জানতে আসা ব্যক্তির মধ্যে লিখিত চুক্তির কয়েকটি রসিদ খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। সাধারণত কোনো রাজ্যের পক্ষ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী জানার জন্য ৭ ড্রাকমা ও ২ ওবল পরিশোধ করা লাগতো। অপরদিক একজন ব্যক্তিগতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী জানতে চাইলে তাকে ৪ ওবল খরচ করতে হতো। এখানের উল্লেখিত ড্রাকমা ও ওবল হলো তৎকালীন গ্রিসে প্রচলিত মুদ্রা।
সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে ভবিষ্যদ্বাণী জানতে আসা ব্যক্তিকে মন্দিরের নিচের একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। পিথিয়া আগে থেকেই মন্দিরের ভেতরের একটি কক্ষে অপেক্ষা করতেন। আর মন্দিরের বাইরে উৎসুক জনতা নানা প্রশ্ন ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতো। মন্দিরের ভেতরের সেই কক্ষে পিথিয়া উঠে দাঁড়িয়ে একটি তেপায়া আসনে বসতেন। সেসময় এই কক্ষে পিথিয়া ছাড়া অন্য কারো প্রবেশের অনুমতি থাকতো না।
পিথিয়ার এই তেপায়া আসনের নিচেই ছিল একটি ফাঁটল। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, দেবতা অ্যাপোলো ও অজগরের মধ্যে লড়াইয়ের সময় এই ফাটলের সৃষ্টি হয়েছিল। এই ফাটল দিয়েই বেরিয়ে আসতো মিষ্টি গন্ধযুক্ত ধোয়া। মন্দিরের কর্মরত একজনের থেকে জানা যায়, পিথিয়া সেই তেপায়া আসনে বসে ধোঁয়া গ্রহণ করতেন এবং মোহাচ্ছন্ন এক অবস্থায় চলে যেতেন। এ সময় তিনি দুর্বোধ্য ভাষায় ভবিষদ্বাণী করতেন।
এরপর ভবিষ্যদ্বাণী জানতে আসা ব্যক্তির কাছে মন্দিরের অন্যান্য পূজারীরা ভবিষ্যদ্বাণী জানিয়ে দিতেন। উক্ত ব্যক্তির কোনো প্রশ্ন থাকলে তা লিখিতভাবে পিথিয়াকে জানানো হতো এবং লিখিতভাবে তার উত্তর আবার উক্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। তবে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী জানতে আসা ব্যক্তি পিথিয়ার সেই অন্দর কক্ষে অবস্থান করার অনুমতি লাভ করতেন এবং স্বচক্ষে পিথিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী জানানোর প্রক্রিয়া দেখতে পারতেন। এভাবেই পিথিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী জানানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো।
ইতিহাসের বহু স্থানেই ডেলফির এই ওরাকলের কথা উল্লেখ রয়েছে। বহু বিখ্যাত গ্রিক সাহিত্যেও উঠে এসেছে এর কথা। প্রথমদিকে বিজ্ঞানীরা পিথিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর এই ঘটনাকে কাল্পনিক মনে করলেও পরবর্তী গবেষণায় এই ঘটনার বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। গবেষকরা ডেলফির মন্দিরের সেই ধ্বংসাবশেষে খোঁজ পেয়েছেন ইথিলিনি সহ হেলুসিনেসন বা ভ্রম সৃষ্টিকারী গ্যাসের চিহ্ন। ধারণা করা হয়, এই গ্যাস গ্রহণের ফলেই মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় চলে যেতেন পিথিয়া। তবে সে যা-ই হোক, সেসময় ডেলফির ওরাকলের ভবিষ্যদ্বাণী বদলে দিয়েছিল বহু ঘটনার মোড়। তাই আজও গবেষক ও ইতিহাসবিদদের কাছে পিথিয়া এক রহস্যময় চরিত্র।
ফিচার ইমেজ – ichef.bbci.co.uk