প্রায় এক যুগ ধরে পাকিস্তান ক্রিকেটের ব্যাটিং প্রতীক হয়েছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। ১৭ হাজারেরও বেশী রান করেছেন এই ব্যাটসম্যান। অবশ্য শুধু পাকিস্তানের নয়, বিশ্বের বিবেচনাতেই তিনি ছিলেন এক গ্রেট ব্যাটসম্যান। অবসরের পর এখনও অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করেন ক্রিকেট।
পাক প্যাশনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মোহাম্মদ ইউসুফ আধুনিক ক্রিকেট ও নব্বই-আশি দশকের ক্রিকেটের তুলনা করেছেন, বেছে নিয়েছেন এই সময়ের গ্রেট ব্যাটসম্যানকে এবং কথা বলেছেন ক্রিকেটের বিবর্তন নিয়ে।
খুব প্রচলিত একটি ধারণা হলো, আজকালকার ব্যাটসম্যানদের কাজটা আগের দিনের ব্যাটসম্যানদের চেয়ে সোজা। আপনার কী মনে হয়?
আমার মনে হয়, বিভিন্ন যুগের ক্রিকেটের তুলনা করাটা অন্যায্য কাজ। আমি প্রায়ই দেখি লোকেরা এই ২০০০ সালের পরের ব্যাটসম্যানদের সাথে নব্বই দশক বা আশির দশক বা আরও আগের ব্যাটসম্যানদের তুলনা করে। আমি স্রেফ বুঝতে পারি না যে, মানুষ কিভাবে এই তুলনাটা করে, যখন ক্রিকেটের বিভিন্ন ফরম্যাট এতো অল্প সময়ে বদলে গেছে।
আপনার বিবেচনায় এই যুগের সেরা ব্যাটসম্যান কে?
বিরাট কোহলিকে আমি খুব উঁচু মানের ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচনা করি। তিনি এই আধুনিক যুগের যেকোনো ব্যাটসম্যানের চেয়ে ভিন্ন ক্লাসের একজন খেলোয়াড়। রোহিত শর্মা, জো রুট, স্টিভ স্মিথ ও কেন উইলিয়ামসনও যথেষ্ট উঁচু মানের খেলোয়াড়। এই চার জন বাকীদের চেয়ে এগিয়ে আছে। তারপরও আমি বলবো বিরাট কোহলিই সেই ব্যাটসম্যান, সবার যাকে অনুকরণ করা উচিত।
আপনার কী মনে হয়, বিরাট কোহলি কিভাবে গ্রেট ব্যাটসম্যান হয়ে উঠলেন?
ব্যাটিংয়ের কথা বলতে গেলে, তিনি একটি পূর্নাঙ্গ প্যাকেজ। তার আক্রমণাত্মক মানসিকতার কোনো তুলনাই হয় না। আমার কাছে মনে হয়, তার ভেতর ফাস্ট বোলারের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাপার আছে; মানসিকভাবে তিনি খুবই শক্তিশালী। কিন্তু তাকে যে বিষয়টি বাকী বিশ্ব থেকে আলাদা করেছে, সেটা হলো ফিটনেস। বিরাট কোহলির ফিটনেসের যে মান, তা আমি কখনো কোনো এশিয়ান খেলোয়াড়ের মাঝে দেখিনি। তিনি বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান, সেটা তিনি নিজের যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন।
তিনি খুবই ধারাবাহিক। এই যে এত এত রান করছেন, এটা ভাগ্যের জোরে নয়; বরং প্রবল পরিশ্রম, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও নিবেদিত মন থেকে এসেছে এই রান। তার রেকর্ড আর পরিসংখ্যান দেখুন না। এসব সংখ্যা তো মিথ্যা বলবে না। তারাই নিশ্চিত করবে, তিনি কত বড় এবং বিশ্বমানের খেলোয়াড়। একই সাথে তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি মানসিকভাবে শক্তিশালী, নিজের যোগ্যতার ওপরও তার বিশ্বাস আছে। অল্প স্কোর করে আউট তিনি হয়ে গেছেন এমন ঘটনা বিরল। আর এটাই একজন গ্রেট খেলোয়াড়ের লক্ষণ।
আপনি কি মনে করেন, বিশ ওভারের খেলা ক্রিকেটারদের টেকনিককে ক্ষতিগ্রস্থ করছে?
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আপনি যদি যথেষ্ট ভালো খেলোয়াড় হন, তাহলে আপনি সব ফরম্যাটে ভালো করবেন। সেরা খেলোয়াড়রা তাদের টেকনিক ও মানসিকতা ফরম্যাট অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নেন। আমি জো রুট, স্টিভ স্মিথ ও বিরাট কোহলির কথা বলবো। তারা প্রমাণ করেছেন, তাদের টেকনিক ভালো এবং তারা যেকোনো ফরম্যাটে সাফল্য পেতে পারেন। এটাই গ্রেট খেলোয়াড়ের লক্ষণ। এরপর ধরুন রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুল ও শিখর ধাওয়ান; এদেরও তিন ফরম্যাটেই ভালো করার যোগ্যতা আছে। এটা আসলে নির্ভর করে খেলোয়াড়রা কীভাবে সেই নির্দিষ্ট ফরম্যাটে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন তার উপর।
আজকাল তো সীমিত ওভারে সব ব্যাটিং রেকর্ড সহজে ভেঙে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, আজকের দিনের খেলা খুব ব্যাটিং-বান্ধব?
হ্যাঁ। আমি সর্বান্তকরণে এই কথার সাথে একমত। আপনি এখনকার খেলা দেখলে এটা পরিষ্কার মনে হবে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দু’টো বল ব্যবহার করা হচ্ছে, ওভারপ্রতি বাউন্সার দু’টোতে সীমিত করে দেওয়া হয়েছে এবং কোথাও কোথাও হাস্যকরভাবে ছোটো ছোটো বাউন্ডারি করা হচ্ছে। এতে খেলাটা খুব ব্যাটিং-বান্ধব হয়ে গেছে। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ক্রিকেট প্রশাসকদের চিন্তা করা উচিত। আমি মনে করি, খেলাটা একেবারেই ব্যাটসম্যানদের অনুকূলে চলে এসেছে এবং এখানে বোলারদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
আপনি ব্যাটসম্যান হিসেবে গ্রেট কিছু বোলারের বিপক্ষে খেলেছেন। আজকের দিনে আপনার মতে বোলারদের মান কেমন?
আমি বিশ্বাস করি, নব্বইয়ের দশকে এবং ২০০০ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি অবধি আমরা কিছু সর্বকালের সেরা বোলারদের দেখেছি। এটা এমন একটা যুগ ছিলো, যখন কয়েকজন গ্রেট স্পিনার ছিলেন এবং অসাধারণ কিছু দ্রুতগতির বোলারও ছিলেন। যখন আমি দ্রুতগতির বোলার বলি, আমি আসলেই জেনুইন ফাস্ট বোলার বোঝাই; আজকের দিনের মিডিয়াম পেসাররা নয়, যাদেরকে পেস বোলার বলে চালানো হচ্ছে। সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় সর্বকালের সেরা আক্রমণগুলোর একটা ছিলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আক্রমণভাগটাও শক্তিশালী ছিলো। শ্রীলঙ্কায় মুত্তিয়া মুরালিধরন ও চামিন্দা ভাস ছিলেন। পাকিস্তানে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার, সাকলায়েন মুশতাক এবং আরও অনেক দুর্দান্ত বোলার ছিলো।
একইরকম দক্ষিণ আফ্রিকায় শন পোলক, অ্যালান ডোনাল্ড, ল্যান্স ক্লুজনার, জ্যাক ক্যালিস ছিলেন। এই সময়টায় কোনো দলের বোলিং আক্রমণই দুর্বল ছিলো না। মোটামুটি সব দলে কিছু উঁচু মানের স্পিনার ও বিশ্বমানের পেস বোলার ছিলো। এটা সত্য যে, আজকের যুগে আমি তেমন দেখতে পাই না। হ্যাঁ, দুয়েকজন ভালো বোলার আছেন। কিন্তু সেই বোলিং আক্রমণের সাথে তুলনা করলে আজকের আক্রমণভাগগুলো অনেক পিছিয়ে থাকবে। আমি এখন একমাত্র মিশেল স্টার্ককে দেখি সেই মানের। জেমস অ্যান্ডারসন আর আগের মতো নেই। আপনি আসলে এখন বিশ্বমানের বোলারদের হাতে গুণে ফেলতে পারবেন। শুধুমাত্র দুয়েকজন ভালো বোলার মিলে ভালো আক্রমণভাগ তৈরী করতে পারেন না।
আপনার কি মনে হয় না যে, বিশ ওভারের খেলার কারণেই বোলিং প্রতিভার এই অবস্থা?
ক্রিকেট আজকাল খুব বাণিজ্যিক হয়ে গেছে, তাই না? ওয়ানডেতে আজকাল নিয়মিত ৪০০ এর ওপরে রান হচ্ছে। এটা তো হাস্যকর। আমরা যেভাবে আইন ও কন্ডিশন ব্যাটসম্যানদের পক্ষে বানাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে মানুষ স্রেফ আরও আরও রান দেখতে খেলা দেখে। এটা সম্ভবত স্পন্সর আর টেলিভিশন স্বত্ত্ব কেনা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ।
তারা চায় আরও আরও চার-ছক্কা হোক, বলগুলো আরও নিয়মিত দর্শকের মধ্যে গিয়ে পড়ুক। আপনি যখন দেখবেন যে, ৫০ ওভারের ইনিংসে ৪৫০-এর ওপরে রান হয়েছে এবং টি-টোয়েন্টিতে কেউ ১৭২ করে ফেলেছে; বুঝবেন খেলাটা ভারসাম্য হারিয়েছে, এটা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। এখন যা ঘটছে, তাতে আরও আরও বোলাররা নিজেদের কাজের চাপ কমানো এবং শুধু শর্টার ফরম্যাট নিয়ে ভাবলে আমি অবাক হবো না। আর এতে ওদের দোষও দেওয়া যাবে না।
এই ব্যাট ও বলের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে আপনার মতে কী করা উচিত?
দেখুন, আগে এই ব্যাপারটাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। সমর্থকরা দেখতে পাচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা দেখতে পাচ্ছে, সংবাদ মাধ্যমও দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু যে শক্তিটা খেলা চালায়, তারা এই সমস্যাটাকে স্বীকার করে না নিলে কিছুই হবে না। আমি ১৯৯২ ও ১৯৯৯ বিশ্বকাপকে দেখি এমন দুটো টুর্নামেন্ট হিসাবে, যেখানে ব্যাটে-বলে দারুণ ভারসাম্য ছিলো। আর দু’টো টুর্নামেন্টই দর্শকরা খুব উপভোগ করেছেন। আজকের দিকের এই ফ্ল্যাট উইকেটের কারণে ব্যাটসম্যানদের স্কিল কমছে, খেলোয়াড়দের মান পড়তির দিকে। আমি বলবো, সমর্থকরা একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হওয়ার আগেই কতৃপক্ষের এগুলো নিয়ে ভাবতে বসা উচিত।
সামনে ২০১৯ বিশ্বকাপ। ট্রফির সেরা দাবিদার কারা?
আমার মতে, তিনটি প্রকৃত দাবিদার দল আছে। শেষ দু’টো চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ভারত ও পাকিস্তান জিতেছে। আমার ধারণা, এই দুটি দলেরই আগামী বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা আছে। আমার ধারণা স্পিনাররা এবার খুব বড় ভূমিকা রাখতে। আর ভারত ও পাকিস্তানের ভালো স্পিনার আছে। ভারতের অসাধারণ ব্যাটিং লাইনআপ আছে। কিন্তু আমি মনে করি, তাদের বোলিং, বিশেষ করে পেস বোলিং নিয়ে কিছু সংশয় আছে। যেটা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে দেখা গেলো।
এরপর স্বাগতিক ইংল্যান্ড আছে। ওরা বেশ সুবিধা পাবে। আর এই মুহুর্তে ওয়ানডে ফরম্যাটে তারা খুবই ভালো অবস্থায় আছে। তারা বিশ্বকাপে শক্তিশালী দাবিদার হবে। এর বাইরে একমাত্র সুযোগ আছে অস্ট্রেলিয়ার। তবে তারা আসলে তাদের সেরা খেলোয়াড়দের নিষেধাজ্ঞা ও ইনজুরি থেকে ফিরে তবে পারফর্ম করার দিকে চেয়ে থাকবে। হ্যাঁ, ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভ স্মিথ, মিশেল স্টার্ক, জশ হ্যাজেলউড; সবাই যদি খেলতে পারে। তাহলে ওদের একটা সুযোগ আছে।
আপনাকে যদি একটা ফেবারিট দল বেছে নিতে বলা হয়, কাকে নেবেন?
আমি মনে করি, পাকিস্তান ফেবারিট। কারণ আমি মনে করি, বিশেষ করে ফ্ল্যাট উইকেটে তাদের এখন সেরা বোলিং আক্রমণ আছে। আমি ‘সেরা’ বললাম কারণ তাদের বোলিং সেরা ভারসাম্যপূর্ণ। পাকিস্তানের আরেকটা বড় সুবিধা হলো, তাদের পার্ট টাইম বোলারদের ওপর খুব একটা ভরসা করতে হবে না। তাদের দলে ৬-৭ জন নিয়মিত বোলার আছে।
পাকিস্তান ক্রিকেটে এখন বেশ কয়েকজন তরুণ তারকা নিয়মিত ভালো পারফর্ম করছেন। এটি কি বড় একটি ইতিবাচক ব্যাপার নয়?
পাকিস্তান ক্রিকেটে এখন যে সুবাতাস বইছে, তার একটা বড় কৃতিত্ব অবশ্যই এই তরুণ ক্রিকেটারদের। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে এখন অবধি তরুণদের কাছ থেকে দারুন কিছু পারফরম্যান্স দেখা গেছে। সাথে আমি বলবো, মোহাম্মদ আমিরের অনেক কৃতিত্ব প্রাপ্য।