কিছুদিন আগে প্রথম কোম্পানি হিসেবে ১ ট্রিলিয়ন বাজার মূল্য পেরিয়ে যায় বিখ্যাত কোম্পানি অ্যাপল। আইফোনের বিক্রয় হঠাৎ করেই ৪১.৩ মিলিয়ন বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির মূল্য ৯৬০ বিলিয়ন ডলার থেকে এক লাফে ১.২৯ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। অন্যদিকে সৌদি আরবের তেল উত্তোলনকারী আরামকো প্রাইভেট ও মনোপলি কোম্পানি হওয়ায় এর বাজারমূল্য অনেকটা ধারণাকৃত। তবে এই কোম্পানির বাজার মূল্য যে ট্রিলিয়ন ডলারের উপরে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একইসাথে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর লাভজনক কোম্পানি হিসেবে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে এই সৌদি তেল উত্তোলনকারী কোম্পানি। চলুন দেখে আসা যাক এই দুই ট্রিলিয়ন কোম্পানির হালচাল।
লাভ
প্রথমেই আসি এই দুই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের লাভের কথায়। গত মাসেই আরামকোর ২০১৬ সালের অর্থ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে রয়টার্স। রয়টার্সের মতে, ২০১৬ সালে তেলের দাম তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হওয়ায় আরামকোর লাভ সেই বছর কিছুটা কম হয়। বিগত ১২ বছরের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম সবচেয়ে কমে যায় ২০১৬ সালে। ব্যারেল প্রতি তেলের দাম পড়ে মাত্র ২৭.১০ ডলার। তারপরও ২০১৬ সালে আরামকোর মোট লাভ হয় ১৩.৩ বিলিয়ন ডলার, যা কি না আগের বছরের তুলনায় ২০% কম ছিলো।
তবে এক্সন মোবিল কিংবা রয়্যাল ডাচ শেলের মতো অন্যান্য স্বনামধন্য তেল কোম্পানির তুলনায় আরামকোর লাভ ছিলো অনেক গুণ বেশি। যেখানে এক্সন মোবিল এবং রয়্যাল ডাচ শেলের আয় সেই বছর কমে যায় যথাক্রমে ৫১ শতাংশ এবং ৩৭ শতাংশ, সেখানে আরামকোর আয় কমে মাত্র ২১ শতাংশ।
২০১৭ অর্থবছরে তেলের দাম আবার কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় আরামকোর কোষাগার গত বছর ফুলে ফেঁপে উঠে। ২০১৭ সালে এই কোম্পানির মোট আয় হয় ৩৩.৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এত আয়ের জন্য মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, গত বছরে হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া। আর দ্বিতীয়ত, ট্যাক্সের ব্যাপারে সৌদি সরকারের কিছুটা শিথিল হওয়া। গত বছর সৌদি সরকার এই কোম্পানির ক্ষেত্রে ইনকাম ট্যাক্স ৮৫% থেকে কমিয়ে মাত্র ৫০% এ নিয়ে আসে। ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছরে আগের আয় করা অর্থকেও এতদিনে ছাড়িয়ে গেছে আরামকো।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, আরামকোর এক ব্যারেল তেল উত্তোলনের জন্য খরচ পড়ে প্রায় ২-১০ ডলার। সৌদি আরবে তেলের খনির প্রাচুর্যতার কারণে এত কম খরচেই প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করে আরামকো। অনেকের মতে, উত্তোলনের খরচ কখনো কখনো ব্যারেলপ্রতি ১ ডলারও হয়। অন্যদিকে রাশিয়ায় প্রতি ব্যারেল তেল উত্তোলনে খরচ পড়ে প্রায় ২০-৩০ ডলার। প্রতিদিন আরামকো প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। কিছু তেল নিজেরাই পরিশোধিত করে নিজ দেশে বিক্রি করে। তবে বেশিরভাগ অপরিশোধিত তেল বাইরে রপ্তানি করা হয়। আর তাতে করে প্রতিদিন প্রায় ৬০০-৬৮০ মিলিয়ন ডলার আয় হয় তাদের।
অন্যদিকে অ্যাপল চলতি বছরে আয় করেছে ১১.৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরে যা কি না ছিলো ৮.৭ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছরে পণ্য বিক্রয় বেড়েছে আগের তুলনায় ১৭ শতাংশ, যা প্রায় ৫৩.৩ বিলিয়ন ডলার। আরমাকোর মতোই অ্যাপল তাদের পণ্যগুলো বৃহত্তর বাজারে প্রচুর বিক্রয় করে থাকে। এই বছর ম্যাকবুক বিক্রয়ের সংখ্যা ৩.৭ মিলিয়ন কমে গেলেও আইপ্যাড ও ট্যাবলেটের বিক্রয় বেড়েছে ১১.৬ মিলিয়ন। কম্পিউটার, ট্যাবলেট, ঘড়ি সহ নানা ধরনের ডিভাইস বিক্রয় করলেও অ্যাপলের আয়ের বেশিরভাগই আসে আইফোন থেকে। মূলত আইফোনের মতো প্রযুক্তি দানবই অ্যাপলকে করেছে ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি।
সম্পদ
আরামকো মূলত একটি প্রাইভেট কোম্পানি। আর তাদের উত্তোলিত তেল পুরোটাই সৌদি সরকারের মালিকানাধীন। কিন্তু আরামকো সরকারের সাথে একচেটিয়াভাবে এই তেল উত্তোলন নিয়ে একটি চুক্তি করেছে। চুক্তি মোতাবেক সৌদি আরবের যেকোনো জায়গা থেকে তেল উত্তোলনের অনুমতি রয়েছে আরামকোর। গত বছর এই কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, সৌদি আরবের মাটির নিচে প্রায় ২৬০ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে। তবে অনেকের মতে, এর চেয়ে আরো বেশি অপরিশোধিত তেল মজুত আছে সৌদি আরবে। সেই হিসাব অনুযায়ী, আরামকো আগামী ৭০ বছর ধরে এই তেল উত্তোলন করে যেতে পারবে।
অন্যদিকে অ্যাপলের সবচেয়ে দামি সম্পদ হলো এর বুদ্ধিগত সম্পদ এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু। প্রযুক্তিগত পরাক্রমশীলতা এবং মার্কেটিং ট্যালেন্টের জন্য দ্রুতই প্রসার হচ্ছে এই কোম্পানির। তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তাদের প্রতিনিয়তই নতুন নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতার মাধ্যমে ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এদিকে আরামকোর হয়তো একটা সময়ে তেলের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। তবে ধীরে ধীরে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম যে বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাতে করে কোম্পানির মূল্যও বেড়ে যাবে ততদিনে। তবে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বিকল্প পথের চিন্তাও করে রেখেছে এই কোম্পানি। ভবিষ্যতে হয়তো এই কোম্পানিকে অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তি খাতে ব্যয় করতে দেখা যাবে।
তহবিল
দুটি কোম্পানিই বিশাল নগদ অর্থের মালিক। অ্যাপলের রয়েছে প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলার নগদ অর্থ। অর্থাৎ কোম্পানির ১ ট্রিলিয়ন বাজারমূল্যের এক-চতুর্থাংশ জমা আছে ক্যাশ হিসেবেই। এই বছরেই কোম্পানির স্টক ভ্যালু বৃদ্ধির জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বাইব্যাক প্রোগ্রাম কেনার ঘোষণা দিয়েছেন কোম্পানির কর্মকর্তারা। পাশাপাশি ১৬% লভ্যাংশ বৃদ্ধি করবে বলে জানিয়েছে তারা। অ্যাপল জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখবে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে আরামকো একটি প্রাইভেট কোম্পানি হওয়ায় এর নগদ অর্থের পরিমাণ অজানা। তবে ১৯৮০ সালের পর বিগত বিশ বছর ধরে আরামকো তাদের জমাকৃত বিশাল অর্থ খরচ করেছে কোম্পানির প্রসার ও বিস্তৃতির পেছনে। এশিয়া, উত্তর আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে তারা। আরামকো প্রাইভেট কোম্পানি বিধায় স্টক ভ্যালুর দিকে তাদের মনোযোগ কম। বরং তাদের মূল পরিকল্পনা অর্থের বিনিময়ে কোম্পানির প্রসার ও নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া।
অপারেটিং সিস্টেম
অপারেটিং সিস্টেমের ক্ষেত্রে আরামকো থেকে অ্যাপল অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনগত সিস্টেমের আওতায় থাকা কোম্পানিটি সরকার থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছে। অ্যাপল বিনিয়োগকারীদের থেকেও সুবিধা পাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এই কোম্পানির ভ্যালু সম্পর্কে অবগত এবং কোম্পানির তারিফও ছড়িয়ে পড়েছে বৈশ্বিকভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অপারেটিং সিস্টেমের জন্য বিনিয়োগকারীরাও ভালোই সুবিধা ভোগ করে।
অন্যদিকে আরামকো মূলত সৌদি আরবের অপারেটিং সিস্টেমের অনুগত হয়ে কাজ করে। সেক্ষেত্রে কিছুটা ঝামেলায়ও পড়তে হয় তাদের। কারণ সৌদি অপারেটিং সিস্টেম অনেকটা উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল। ২০১৬ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ দাবি করেন, তিনি বিশ্বাস করেন সেই সময়ে আরামকোর বাজারমূল্য প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ সেই সময়ে তেলের দাম ছিলো একেবারে পড়তির দিকে। সেই হিসেবে বলা যায়, তাঁর দাবিটি ছিলো পুরোপুরি অযৌক্তিক। তাই অনেকাংশেই বিনিয়োগকারীরা সৌদি অপারেটিং সিস্টেমে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।