Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য ম্যাগপাই ইফেক্ট: চাকচিক্যপূর্ণ বিলাসদ্রব্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ

মাস শেষে টিউশনের টাকা পেয়ে শপিং মলে এসেছে রাতুল। এখানে ঢোকার আগে সে পই পই করে নিজেকে সাবধান করেছে, “সাবধান রাতুল, একদম অহেতুক টাকা নষ্ট করবি না! সামান্য ক’টা টাকা, এ দিয়েই তোকে সারা মাস চলতে হবে।” তার ইচ্ছে ছিল, শুধু প্রিয় ফুটবল ক্লাবের নতুন মৌসুমের জার্সিটা কিনবে, অন্য কিছুর দিকে ফিরেও তাকাবে না।

কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তা আর হলো না। অন্য আর পাঁচটা গড়পড়তা মানুষের মতোই, রাতুলেরও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ে তার মনই সব সময় জিতে যায়, গো-হারা হেরে বসে তার মস্তিষ্ক। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। যখনই একেকটা আকর্ষণীয় গেমের ডিস্ক, মোবাইলের কভার, জুতো, পারফিউম ইত্যাদির উপর তার চোখ পড়তে লাগল, নিজের লোভ আর সামলাতে পারল না সে।

অন্য দিন না হয় পকেটে টাকা নেই ভেবে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারত। কিন্তু আজ যেহেতু পকেটে কড়কড়ে দশটা এক হাজার টাকার নোট, তাই কোনোভাবেই সে নিজের মনকে বশে রাখতে পারল না।

বিলাসদ্রব্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন; Image Source: ABC

বাসায় ফিরে রাতুল আবিষ্কার করল, সকল শপথ, সকল অঙ্গীকারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, নিজের কাছে থাকা মোট টাকার দুই-তৃতীয়াংশই সে খরচ করে ফেলেছে। তা-ও আবার এমন সব জিনিসের পেছনে, যেগুলো নেহাতই বিলাসদ্রব্য; কেনার আগপর্যন্ত সেগুলো অনেক লোভনীয় ছিল বটে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে: এগুলো কেনার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল!

সত্যিই তা-ই। রাতুল লোভে পড়ে এমন সব জিনিস কিনেছে, যেগুলোর বাস্তব কার্যকারিতা খুবই কম। গেমের ডিস্ক, মোবাইলের কভার, জুতো, পারফিউম থেকে শুরু করে আর যা যা সে কিনেছে, তার কোনোটিই তার জন্য অপরিহার্য ছিল না। এই মুহূর্তে সেগুলোর মালিকানা লাভ না করলেও তার একদমই ক্ষতি হয়ে যেত না। কিন্তু হায়, কয়েক মুহূর্তের লোভে পড়ে সে নিজের রক্ত জল করা উপার্জনের সিংহভাগই জলাঞ্জলী দিল। এখন বাকি সারাটা মাস তাকে প্রচণ্ড কষ্টে দিনাতিপাত করতে হবে, প্রতিটা টাকা গুনে গুনে খরচ করতে হবে।

উদ্দীপকের এই রাতুল সম্ভবত আপনি, আমি, আমরা সকলেই। আমাদের ভিতর এমন মানুষ খুব কমই আছে, যারা মুহূর্তের জন্য নিজেদের হিতাহিত জ্ঞান ভুলে, কোনো আকর্ষণীয় জিনিসের প্রলোভনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করি না। আজকাল অনলাইনেই বিভিন্ন পণ্য অর্ডারের সুযোগ তৈরি হওয়ায় এমন কাজের হার তো আরো বেড়েছে। এই যে আমাদের খুবই ক্ষতিকর ও আত্মবিনাশী প্রবণতা, এটির কিন্তু বেশ গালভরা একটি নামও আছে। তা হলো: দ্য ম্যাগপাই ইফেক্ট।

হয়তো মনে মনে ভাবছেন, এত কিছু থাকতে ম্যাগপাইয়ের নামে নাম হলো কেন! কারণ আছে। ম্যাগপাই বা দোয়েল পাখির মধ্যেও যে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কোনো চকচকে বা আকর্ষণীয় বস্তুর উপর চোখ পড়লেই তার অনেক লোভ হয়। যদি সম্ভব হয় তো সেই বস্তুটিকে নিজের বাসা পর্যন্তও নিয়ে যায় সে। এতে যদি তার অনেক পরিশ্রম বা কষ্ট হয়, সেদিকে একদমই ভ্রুক্ষেপ করে না। ওই মুহূর্তে চকচকে বস্তুটিকে নিজের করে পাওয়াই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান।

চাকচিক্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকে ম্যাগপাইয়ের; Image Source: White Door Consulting

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ম্যাগপাই ইফেক্ট নামকরণের কার্যকারণ। এ টার্মটির বেশ চলনসই একটি সংজ্ঞাও রয়েছে: “স্রেফ বাহ্যিক চাকচিক্যের উপর ভিত্তি করে কোনো দ্রব্য ক্রয়ের প্রতি একজন মানুষের দুর্বার আকর্ষণ, বাস্তবিক যে দ্রব্যটির হয়তো কোনো বিশেষ উপযোগই তার কাছে নেই, কিংবা দ্রব্যটির মূল্য তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।”

এখান থেকে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রব্যটির দাম অবশ্যই অনেক বেশি হবে, এবং দ্রব্যটি নিশ্চয়ই কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নয়, বরং বিলাসদ্রব্য হবে।

নারী কিংবা পুরুষ, কোনো বিশেষ লিঙ্গের উপরই ম্যাগপাই ইফেক্টের একক দোষ চাপিয়ে দেয়ার অবকাশ নেই। কেননা নারীরা যেমন জুতো, ব্যাগ, জামাকাপড়, সাজের সরঞ্জাম প্রভৃতির প্রতি দুর্বল হয়ে থাকে, তেমনই পুরুষেরাও কিন্তু গাড়ি, ঘড়ি, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ অনুভব করে। এবং উভয় ক্ষেত্রেই, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে তথাকথিত শখ মেটাতে নিজেদের ক্রয়ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি অর্থ খরচ করে ফেলে।

মনোবিজ্ঞানীদের কাছেও এমন প্রবণতার নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে। তারা একে অভিহিত করে থাকেন কম্পালসিভ বায়িং ডিসঅর্ডার হিসেবে। তাদের মতে এটি এমন একটি কন্ডিশন, যা মানুষকে বাধ্য করে নিজেদের মালিকানাধীন বস্তু বা দ্রব্যের মতো করে নিজেদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে। আজকাল আপনি যা পরবেন, যে গ্যাজেট বহন করবেন, যে বাড়িতে থাকবেন কিংবা যে গাড়ি চালাবেন, এগুলোই অন্যদের কাছে আপনার ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি তার সাথে আপনার প্রকৃত আবেগীয় বৈশিষ্ট্য কিংবা মানুষ হিসেবে আসলে আপনি কেমন তার কোনো সাদৃশ্য না থাকলেও।

এক্ষেত্রে আইফোনের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আইফোনকে মনে করা হয় আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। যারা আইফোন ব্যবহার করে, তাদেরকে সমাজে অনেকেই একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে, খুব হোমড়াচোমড়া কেউ বলে মনে করে। শুরুতে এর নেপথ্যে কারণ ছিল আইফোনের উচ্চমূল্য। হাতে একটি আইফোন থাকলেই সমাজে নিজের ‘স্ট্যাটাস’ বেড়ে যায় বলে, অনেকেই আগ্রহী হতো আইফোন কেনার জন্য। আইফোন কিনেই যেন তারা সমাজে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যেত। এখন অবশ্য আইফোনের থেকেও দামি অনেক মোবাইল বাজারে রয়েছে। কিন্তু তবু অধিকাংশ মানুষ সেসব মোবাইলের কথা জানে না বলে, এখনো সেসব দামি মোবাইলের চেয়ে একজন আইফোনের মালিককেই তারা বেশি অভিজাত শ্রেণীর বলে মনে করে।

অনেকের চোখেই আভিজাত্যের প্রতীক আইফোন; Image Source: Cnet

এভাবে একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজের অন্যান্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দিতে পারে, তেমনটা আজকাল পরিলক্ষিত হয় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। মনে করুন, আপনি খুব দামি কোনো দোকান থেকে, অনেক টাকা খরচ করে, অনেক ভালো মানের একটি পাঞ্জাবি কিনেছেন। অপর দিকে আপনার এক বন্ধু দেশের সবচেয়ে নামকরা ব্যান্ডের পাঞ্জাবি কিনেছে। সেটি হয়তো গুণগত মানের দিক থেকে আপনার পাঞ্জাবির ধারেকাছেও নেই। কিন্তু তবু আপনারা দুজন পাঞ্জাবি পরে লোকসম্মুখে গেলে, বেশিরভাগ মানুষ আপনার বন্ধুর পাঞ্জাবিকেই বাহবা দেবে। কারণ সেটিতে যে একটি নামকরা ব্র্যান্ডের সিল রয়েছে।

“নামকরা ব্র্যান্ড” বিষয়টি এভাবেই আমাদের সমাজে তার প্রভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ নামকরা ব্র্যান্ডের প্রতি এতটাই ঝুঁকে পড়েছে যে, সকল ক্ষেত্রেই তারা একে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলে। আর সেই সুযোগটি লুটতে পিছপা হয় না নামকরা ব্র্যান্ডগুলো। তারা জানে, তাদের পণ্যের মানের চেয়ে নাম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা চাইলেই একটি পণ্যের গায়ে দুই হাজার টাকা মূল্যমানের প্রাইস ট্যাগ সেঁটে দিতে পারে, অন্য কোনো দোকান থেকে যেটি কিনতে হয়তো এত টাকা লাগত না।

এমন পরিস্থিতির পেছনেও ম্যাগপাই ইফেক্টের অনেক বড় দায় রয়েছে। আগে মানুষ কোনো পণ্যের গুণগতমান কতটা তা বিবেচনা করত। কিন্তু এখন তারা পণ্যটির বাহ্যিক চাকচিক্যকে প্রাধান্য দেয়, এবং কোনো নামকরা ব্র্যান্ডের সিল কিন্তু ওই বাহ্যিক চাকচিক্যেরই একটি অংশ। এর ফলে তারা প্রয়োজনের তুলনায় বহুগুণ বেশি অর্থ খরচ করে হলেও ব্র্যান্ডের জিনিসটির পেছনে ছোটে। আর তাই বাজার ব্যবস্থায় অসাম্যের সৃষ্টি হয়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রায় সমান খরচ করেও একটি সাধারণ ব্র্যান্ড যে পরিমাণ লাভ করে, একটি নামকরা ব্র্যান্ড তার থেকে অনেক বেশি লাভ করে। কারণ দ্বিতীয়টির রয়েছে “ব্র্যান্ড ভ্যালু”। এর ফলে সাধারণ ব্র্যান্ডটি ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে, এবং একসময় সে প্রতিযোগিতা থেকে হাল ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয়। এভাবে নামকরা ব্র্যান্ডের আধিপত্যের কারণে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না সাধারণ ব্র্যান্ডগুলো।

নামকরা ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ড ভ্যালুর কাছে হার মানে অন্যরা; Image Source: Visibility Magazine

নামকরা ব্র্যান্ডগুলো যে তাদের পণ্য কমানোর বদলে ক্রমাগত বাড়াতে থাকে, এর পেছনেও কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণ বিদ্যমান। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থরস্টেইন ভেবলেন। তার তত্ত্ব হলো, বিলাসদ্রব্যের দাম যদি কমানো হয়, এবং সেগুলো যদি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে চলে আসে, তাহলে সেগুলো আর “এক্সক্লুসিভ” থাকে না, ধনশালীরা নিজেদের “স্ট্যাটাস” প্রদর্শনের জন্য আর সেগুলো কিনতে উৎসাহী হয় না।

এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। ধনীদের হাতে অঢেল টাকা আছে, তারা তাদের “স্ট্যাটাস” প্রদর্শনের জন্য দুই হাতে সে টাকা ওড়াবে, এতে আমাদের কী বলার আছে! কিন্তু সমস্যাটা করে দিয়েছে ম্যাগপাই ইফেক্ট। এর কারণে যাদের সামর্থ্য নেই, তারাও চায় বেশি বেশি টাকা খরচ করে কোনো নামকরা ব্র্যান্ডের বিলাসদ্রব্য কিনে নিজেদের “স্ট্যাটাস” জাহির করতে। ফলে যে মানুষটি হয়তো ঈদ উপলক্ষ্যে তার ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী নিউ মার্কেট থেকেই খুব ভালো ভালো জামাকাপড় কিনতে পারত, “স্ট্যাটাস”-এর সন্ধানে সে চলে যায় বড় বড় ব্র্যান্ডের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শো-রুমে, আর সেখানে মূল দামের কয়েকগুণ বেশি দিয়ে একেকটা জামাকাপড় কিনে সে আদতে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ালটি মারে।

এখন প্রশ্ন হলো, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও যখন নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর ক্রেতা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর কি তাদের পণ্যের দাম কমানোর কোনো সম্ভাবনা রয়েছে? না, নেই। আজ থেকে প্রায় শত বছর পূর্বে, ১৯২০ সালেই ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ আর এইচ টনি তার “The Acquisitive Society” নামক বইয়ে সে সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে গেছেন। তার মতে, যতদিন সমাজের গুটিকতক মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকবে এবং তারা তুচ্ছাতিতুচ্ছ দ্রব্যাদি কিনতে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করবে, ততদিন এ অসাম্য দূর হবার নয়।

ধনী-গরিবের অসাম্য খুব শীঘ্রই দূর হবার নয়; Image Source: NWC Creative Aging

সুতরাং আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোই এমন যে, আগামী কয়েক দশকেও বাজারে নিতান্ত মামুলি বিলাসদ্রব্যও মূল দামের দশ-পনেরো-বিশ এমনকি একশো গুণ বেশি দামেও বিক্রি হওয়া বন্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং ধনবানদের জন্য সাজিয়ে বসা সেসব পণ্যের পসরায় যখন সামর্থ্যহীন মধ্যবিত্তদের চোখ পড়বে, সেটি হবে ম্যাগপাই ইফেক্ট, কিংবা সহজ বাংলায়: গরিবের ঘোড়া রোগ!

অর্থনীতির চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

 

This article is in Bengali language. It is about the Magpie Effect. Necessary references have been hyperlinked inside. 

Featured Image © Getty Images

Related Articles