এজবাস্টন বুঁদ হয়ে ছিলো বিরাট কোহলির নামে।
কোহলি ভালো খেললেনও। দুই ইনিংসেই ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করলেন, ইংল্যান্ডের মাটিতে নিজের রানখরা ঘোচালেন, র্যাংকিংয়ে এক নম্বরে উঠে এলেন। কিন্তু কোহলিকে নিয়ে এই হইচইয়ের মধ্যে আসল কাজটা করে ফেললেন ২০ বছর বয়সী এক তরুণ।
ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেন ‘ছোট্ট’ স্যাম কুরান।
ম্যাচশেষে কথা বলতে গিয়ে একটু ধরে আসা গলায় বললেন, এই দিনটা অবধি আসতে অনেক দুঃস্বপ্ন আর স্বপ্নের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। তিনি বললেন, এই সময়টার জন্য বাবার কাছে কৃতজ্ঞ তিনি। সকলের একসাথে মনে পড়ে গেলো ছোট্ট এই কুরানের গল্প। ভালো করে বললে বলা যায়, কুরান পরিবারের ট্রাজেডি আর সফলতার গল্প।
স্যাম কুরান হলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। বড় দুই ভাই টম কুরান ও বেন কুরান। টম ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ২টি টেস্ট, ৮টি ওয়ানডে ও ৬টি টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলেছেন। এই টেস্টে তিনি ছিলেন না বলে দুই ভাইয়ের একসাথে খেলা হয়নি। মেজো ভাই বেন কুরান কাউন্টি খেলছেন। অনেকেই মনে করেন, খুব দ্রুত তিনিও জাতীয় দলে চলে আসবেন।
কিন্তু শুধু এটুকু কথা দিয়ে তো গল্প হয় না। এমন তিন ভাইয়ের গল্প ক্রিকেটে ভুরি ভুরি আছে। কুরানদের বিশেষত্ব কী?
তাহলে আরেকটু বলা যাক।
তিন ভাই কুরানের বাবা ছিলেন কেভিন ম্যালকম কুরান। জিম্বাবুয়ের সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার এবং দলটির সাবেক প্রধান কোচ।
এটাও গল্পের জন্য যথেষ্ট নতুন কিছু না। জিওফ মার্শরা তো রয়েছেনই। বাবা সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ এবং দুই ছেলে জাতীয় দলের খেলোয়াড়; এমন গল্পও আছে। তাহলে কুরানদের গল্পটা কোথায়?
কুরানদের গল্প জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে স্যাম কুরানের দাদা কেভিন প্যাট্রিক কুরানের আমলে।
প্যাট্রিক কুরান ছিলেন তৎকালীন রোডেশিয়ার নাম করা এক ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়নি। কিন্তু সে সময় চুটিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতেন তিনি। ৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচও খেলেছেন এই প্যাট্রিক কুরান। ক্রিকেটের বাইরে তিনি ছিলেন বিশাল এক খামার বাড়ির মালিক।
হারারে শহর থেকে ঘন্টা দেড়েকের দূরত্বে, মোজাম্বিক সীমান্তের কাছে রুসাপে নামে এলাকায় ছিলো বিশাল এই খামারবাড়ি। মোটামুটি এক জমিদারই বলা যায় প্যাট্রিক কুরানকে। আর এই বাড়িতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা কেভিন কুরানের।
কেভিন ক্রিকেটের দিক থেকে বাবাকে ছাড়িয়ে গেলেন।
জিম্বাবুয়ে জাতীয় দলের হয়ে দুটি বিশ্বকাপ খেলে ফেললেন। মোট ১১টি ওয়ানডে ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন। পাশাপাশি নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে খেলতেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট। একজন প্রচন্ড পরিশ্রমী ও ফিট ক্রিকেটার হিসেবে সেসময় সতীর্থদের কাছে দারুণ পছন্দের এক চরিত্র ছিলেন। খেলা শেষ করে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য তার ছোটাছুটি এখনও বন্ধুদের কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে আছে।
১৯৯৯ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেষ খেলেছেন ১৯৮৭ সালে। মাঝের এই সময়টাতে ইংল্যান্ডে ঘরবসতি গড়ে ফেলেছিলেন। বিয়ে করেছেন বেশ আগেই। কিছুদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন। সেখানে বড় ছেলে টম কুরানের জন্ম। বাকি দুই ছেলে বেন ও স্যামের জন্ম ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ড ছিলো কেভিন কুরানের ‘দ্বিতীয় ঘর’।
কিন্তু অবসর নেওয়ার পর কেভিন আবার জিম্বাবুয়ে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট বোর্ড থেকে বড় দায়িত্বের ডাক পেলেন। হলেন জিম্বাবুয়ে জাতীয় দলের কোচ।
পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে এলেন হারারেতে। বেশ সুখে কাটছিলো সময়টা। পরিবার থাকে নিজেদের সেই বিশাল খামার বাড়িতে। সেখানেই আস্তে আস্তে ছেলেগুলো ক্রিকেট শিখে উঠতে থাকে। আর কেভিন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটারদের শেখাতে থাকেন ক্রিকেট। কেভিন তখন জাতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্ব ছেড়ে ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান। সুখের সময়।
কিন্তু সুখের সময় কপালে বেশি দিন সইলো না।
রবার্ট মুগাবে সরকার এলো ক্ষমতায়। সাম্য ব্যবস্থা কায়েম করতে মুগাবে সরকার বেশি জমির মালিকদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে শুরু করলো সম্পদ ও জমি। সেই কর্মসূচীতে কাটা পড়লো কেভিন কুরানের খামার বাড়িও। একদিন সকালে হঠাৎ করেই পরিবারসহ এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো কুরান পরিবারকে।
এখন কোথায় গিয়ে উঠবে এই পরিবার?
এ সময় কুরানদের পাশে এসে দাঁড়ালো ক্রিকেটের আরেক বিখ্যাত পরিবার- মার্শ পরিবার। বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার জিওফ মার্শ তখন সপরিবারে জিম্বাবুয়েতে থাকেন। কারণ, তখন তিনি জিম্বাবুয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটার। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে পাওয়া বাড়িতে এনে তুললেন তিনি কুরান পরিবারকে।
এখানে একটা ক্রিকেটের ভবিষ্যত ও পুরোনো প্রজন্মের দারুন মেলবন্ধন হলো।
জিওফ মার্শের দুই ছেলে মিশেল মার্শ ও শন মার্শ ছিলেন সেখানে। এর সঙ্গে কেভিন কুরানের তিন ছেলে টম, বেন ও স্যাম কুরান। আর পাশের বাড়িতেই থাকতেন জিম্বাবুয়ের সাবেক ক্রিকেটার ম্যালকম জার্ভিস। তার ছেলে কাইল জার্ভিসও ছিলেন এদের খেলার সাথী। এবার হিসাব করুন, এই যে ছয়টি ছেলে একসাথে তখন খেলে বেড়াতেন, এর ৫ জনই ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন। বাকি আছেন কেবল বেন কুরান।
কেভিন অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে নিজে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ফেললেন।
সেখানে চলছিলো সবার ক্রিকেট। টম কুরানকে দিয়ে দেওয়া হলো দক্ষিণ আফ্রিকার এক বোর্ডিং স্কুলে। সেখানেও সে ক্রিকেট খেলতো। এখনও সময়টাকে শান্তির সময় বলেই বলা যায়। কিন্তু এই সময় হঠাৎ করেই বজ্রপাত হলো কুরান পরিবারে।
সালটা ২০১২; অক্টোবরের ১০ তারিখ। জিম্বাবুয়ে অ্যাকাডেমির প্রধান কেভিন কুরান রোজ সকালের মতো ঘুম থেকে উঠে হালকা দৌড়াচ্ছিলেন। তখনই হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতালে নিতে নিতেই মারা গেলেন কেভিন।
সংসারটা একেবারে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো। পরিবারের একমাত্র আয়ক্ষম মানুষটা চলে গেলো; এদিকে জিম্বাবুয়েতে থাকার নিজেদের কোনো বাড়ি নেই। এক ছেলে দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেই ছেলের খরচ জোগাবে কে? আর বাকি দুই ছেলেকে নিয়ে এখন কোথায় যাবেন কেভিনের স্ত্রী সারা?
এই সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে এলো ক্রিকেট।
টম নিজের পথ নিজে করে নিলেন। তিনি তখন ডারবানে হিল্টন কলেজেন হয়ে খেলছেন। সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিলো অস্ট্রেলিয়ার একটি কলেজ দল। এই দলের কোচ ছিলেন ইয়ান গ্রেগ। হ্যাঁ, টনি গ্রেগের ভাই। ইয়ানের সাথে সারে দলের ছিলো দারুণ সম্পর্ক। তিনি এই ম্যাচে টমের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে সারেতে খবর পাঠালেন। ইংল্যান্ডের কাউন্টি দলটা তখন লুফে নিলো টম কুরানকে।
ওই সারেতেই টম কুরানকে দেখে আরও মুগ্ধ হলেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট। আর ওখানে আগে থেকেই ছিলেন কেভিন কুরানের বন্ধু ইয়ান ল্যাম্ব। ল্যাম্বের চেষ্টায় জিম্বাবুয়ে থেকে বাকি দুই ছেলেকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে এলেন কুরান ভাইয়েদের মা সারা।
ল্যাম্ব তিনটি ছেলের জন্যই সারে থেকে একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। খেলার পাশাপাশি ওদের পড়াশোনার খরচও চলতে থাকলো এই বৃত্তি থেকে। বলা চলে, ক্রিকেট ও কুরান পরিবারের বন্ধুরা টিকিয়ে রাখলো এই তিন ছেলেকে।
এর পরের কাহিনী তো ইতিহাস। সারের হয়ে টম ও স্যাম রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়া পারফরম্যান্স শুরু করলেন। বেন খেলতে লাগলেন বাবার ক্লাব নটিংহ্যামের হয়ে। এর মধ্যে টমের অভিষেক হয়ে গেলো। লোকেরা স্বপ্ন দেখতে লাগলো, একদিন তিন ভাই একসাথে জাতীয় দলে খেলবে।
তা এখনও হয়নি। তবে টমের পর স্যামও চলে এসেছেন জাতীয় দলে। সেখানে নিজের ছাপও রেখে ফেলেছেন এর মধ্যে।
এজবাস্টন টেস্ট ইংল্যান্ডকে জেতানোর পর নিজের শেকড়টা ভুলে যাননি। সেই ধরে আসা গলায় বলছিলেন,
‘খুব কঠিন একটা সময় পার করে এসেছি আমরা। যখন বাবা মারা গেলেন, আমি খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু আমাদের পরিবার খুব শক্ত ছিলো। আমার দুই ভাই আমার খুব কাছের ছিলো, এখনও আছে। মা আমাদের ক্রিকেটে সবসময় খুব সমর্থন দিয়েছেন। আমার ধারণা, ওসব ঘটনা আমাদের মানুষ হিসেবে, পরিবার হিসেবে আরও শক্ত করে তুলেছে।’