একসময় ইডার এবং ওবারস্টাইন নামের দুটি আলাদা শহর ছিল। ১৯৩৩ সালে শহর দুটি একত্রিত করে ইডারওবারস্টাইন নামকরণ করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির হুনস্রুক পর্বতমালার কাছেই শহরটি অবস্থিত। শহরটির এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। ইউরাপের সবচেয়ে পুরনো হিরের খনিটি আছে এখানে। প্রায় ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানকার খনি থেকে উত্তোলিত হতো নানা হিরে মণিমুক্তো তৈরির পাথর। পরে সেই খনির গভীরে গড়ে তোলা হয়েছে হিরে এবং মণিমুক্তোর অবাক করা এক জাদুঘর, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হিরে গবেষণাকেন্দ্র ও আরো অনেক কিছু। আছে আসল ও নকল মণিমুক্তো বিক্রির অজস্র শো-রুম।
বহুকাল ধরেই ইডারওবারস্টাইনের হীরের খনি পৃথিবী বিখ্যাত। অষ্টদশ শতকে এই অঞ্চলটি মূলবান পাথরের উৎসভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৮২৭ সাল নাগাদ ইডারওবারস্টাইনেরই কিছু স্থানীয় বাসিন্দা কুপারসেল নামের এক স্থানে এই হিরের খনির সন্ধান পান। খনিতে নানা ধরনের দামী রত্ন পাথরের খোঁজ পান তারা। সে সময় খনি থেকে হিরে তুলে আনার খরচও ছিল অপেক্ষাকৃত কম। কম বেতনের শ্রমিক এবং কম পরিশ্রমে রত্ন পাথর পাওয়া যাওয়ায় এলাকাটি ধীরে ধীরে বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। এলাকায় গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি নামকরা রত্ন তৈরির কারখানা। শহরের পাশে বয়ে যাওয়া নাহি নদীর পানি এই কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত হতো। এসব কারখানায় খনি থেকে আনা রত্ন পাথর কেটে একটি আকৃতিতে নিয়ে আসা হতো এবং তা নানা রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দামী জুয়েলারিতে রুপান্তর করা হতো। ফলে শহরটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে।
তামাম ইউরোপের সর্বপ্রাচীন এবং বিখ্যাত মণিমুক্তোর এই হীরের খনিতে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে খনিকেন্দ্রিক জাদুঘরের এক বিশাল সংগ্রহশালা। খনিটির অবস্থান অবশ্য কিছুটা দুর্গম জায়গায়। জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের মাঝে ঐ খনি দেখতে ভিড় জমায় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক। এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তারা এই হীরের খনির জাদুঘরের প্রতি আকৃষ্ট হন। হীরের খনিতে প্রবেশ করতে হলে গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ি পথে অনেকটা হেঁটে যেতে হয়।
আর পাঁচটা খনির মতো এর গহ্বরে যেতেও মাথায় বিশেষ ধরনের হেলমেট পরে নিতে হয়। বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই খনি এখন নিছকই বিখ্যাত একটি দ্রষ্টব্য স্থান। কারণ, ১৪৫৪ সাল থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত টানা ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই খনি থেকে কোটি কোটি ডয়েচ মার্কের হীরা-জহরত উত্তোলন করা হয়েছে। বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হওয়ায় ইডারওবারস্টাইনের খনিটির সঞ্চয় কমে এসেছিল।
এভাবেই বর্তমানের পাতা থেকে সেটি চলে যায় অতীতের ইতিহাসের খাতায়। তারপর থেকে বেশ কিছুদিন খনিটি পড়ে থাকে পরিত্যক্ত অবস্থায়। পরবর্তীতে খনিটিকে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়। ৮১ বছর ধরে এই জাদুঘরের সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ হয়েছে। এই জাদুঘরের মাধ্যমে পর্যটকেরা যেমন বিভিন্ন হীরে, মণি-মুক্তোর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন, ঠিক তেমনি ইডারওবারস্টাইন শহরটির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও নানা তথ্য জানতে পারবেন।
খনির অসাধারণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা ভেতরের আলোর খেলা দেখবার মতো। জার্মান গাইড খনিগর্ভে সুরঙ্গের পর সুরঙ্গ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান কোথা থেকে কীভাবে কোন আকারের রত্ন নিষ্কাশিত হয়েছে।
খনিগর্ভে একটি কাঁচের ঘরে বিভিন্ন সময়ে সেখানে পাওয়া রত্নের নানা রকম নিদর্শন সাজানো আছে। স্কুলের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদেরও ওই খনিতে নিয়ে আসা হয় শিক্ষামূলক সফরে। বিশাল রত্ন জাদুঘর দেখতে বেশ সময় লাগে। প্রায় ৯৪০ ফুট স্থানে পরিমিত ৫৬টি শো কেসে সাত হাজারেরও বেশি মূল্যবান রত্ন দিয়ে সাজানো হয়েছে ওই জাদুঘর। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আনা হয়েছে বিভিন্ন আকারের মূল্যবান রত্ন বা মূল্যবান পাথরের খোদাই করা শিল্পকর্ম।
খোদাই করা বিখ্যাত মানুষদের মূর্তিও রয়েছে শো-কেসে। এই জাদুঘরে রয়েছে একটি ক্রিস্টাল হল রয়েছে যেখানে ঐতিহাসিক সব হীরার রেপ্লিকা আছে। জাদুঘরে আরো আছে মোজেক ও ক্রিস্টালের নানা অপরূপ কীর্তি, আলো ঠিকরে পড়ছে এসব শিল্পকর্মের গা থেকে। পৃথিবীর কোথায় কোথায় হীরে বা মণিমুক্তোর খনি আছে, তা জানানোর জন্য আছে তথ্যজ্ঞাপক বোর্ড ও দুর্দান্ত সব ছবি। রত্ন খোদাই করা প্রাচীন পানপাত্র, মূর্তি প্রভৃতি দেখার সুযোগ পাওয়া যায় ওই জাদুঘরে। এর সাথে উপরি পাওনা হিসেবে পর্যটকেরা এই খনির ৪০০ মিলিয়ন আগের বিভিন্ন প্রাণীর জীবাশ্মের দেখা পাবেন।
রনিরল্যান্ড-প্যালাতিন্ট রাজ্যের অন্যান্য শহরগুলোর থেকে ইডারওবাস্টাইন শহরটি সম্পূর্ণ আলাদা। শহরটি বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার। চাকচিক্য তেমন না থাকলে পুরনো দিনের শহর হিসেবে একধরনের ফ্লেভার নেয়ার লোভ সামলাতে পারেন না অনেক পর্যটকই। তাই শুধু খনির জাদুঘর দেখেই তারা সন্তুষ্ট হন না, ঘুরে দেখেন শহর জুড়ে থাকা নানা দর্শনীয় স্থান। যেমন, বিশ্বখ্যাত ফেলসেনকার্চ গির্জা, পাহাড়ে ঘেরা ওবারস্টাইন ক্যাসল, আরবেশকোপ মাউন্টেন- এ সবই পর্যটকদের দারুণ আকর্ষণ করে।
আবার অনেকে শহরের বার্জ ওবারস্টাইন অঞ্চলে থাকা জনপ্রিয় ক্রিসমাস মার্কেটেও সময় কাটাতে পছন্দ করেন। এখানে রয়েছে বেশ প্রাচীন এক থিয়েটার হল। এখানে নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অনেকে সেসব স্থানীয় অনুষ্ঠান দেখতেও ভিড় করেনে এই থিয়েটার হলে।
ফেলসেনকার্চ চার্চ
শহরটিকে ঘিরে রয়েছে পঞ্চদশ শতকের তৈরি ফেলসেনকার্চ চার্চ। পাহাড়ের উপর সাদা রঙের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি তৈরি করেন সম্রাট চতুর্থ ওয়ারিরিচ। গির্জার অভ্যন্তরে অসাধারণ সব চিত্রকর্ম রয়েছে। গির্জার শান্ত, নির্মল পরিবশে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চান অনেক পর্যটকই।
কিংবদন্তী রয়েছে, এক রাজার দুই ছেলে একই রাজকন্যাকে পছন্দ করতেন। এক রাজপুত্রের ভালবাসার কথা সকলে জানতেন আর একজন গোপনে সেই ভালবাসা প্রকাশ করতেন। এক যুদ্ধে দুই রাজপুত্রই যুদ্ধ করতে বের হন। এ সময় বড় ভাই জানতে পারেন তার ছোট ভাইয়ের ভালবাসার কথা। ছোট ভাইয়ের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ভাইকে হত্যা করেন। পরে যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বড় ভাই বেশ অনুতপ্ত হন। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। তখন ছোট ভাইয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ওই গির্জাটি নির্মাণ করেন। গির্জাটি নির্মিত হওয়ার পর সেখানের একটি স্থান থেকে বুদবুদ আকারে পানি উঠতে থাকে, যা আজও একইভাবে সেই স্থান থেকে নির্গত হচ্ছে।
ওবারস্টাইন ক্যাসল
ওবারস্টাইন ক্যাসলটি সপ্তদশ শতকে তৈরি। সেসময় এটি ওবারস্টাইন শহরের প্রধান প্রশাসকের (কাউন্ট ডন ওবারস্টাইনের) বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে এটি প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্গটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে দুর্গটি পুনর্নির্মাণ করা হয়।
দুর্গটিতে ভ্রমণার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটি রুমে বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একটি রুমে রাখা আছে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত নানা অস্ত্রের সম্ভার, আরেকটি বিশাল হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অন্য একটি ছোট রুমে আছে একটি গ্যালারি। এই গ্যালারিতে বিভিন্ন সময়ের স্থানীয় নানা নির্দশন রাখা আছে।
আরবেশকোপ মাউন্টেন
আরবেশকোপ নামের পাহাড়টি রনিরল্যান্ড-প্যালাতিন্ট রাজ্যের মধ্যে উচ্চতম শৃঙ্গ। অনেক পর্যটকই হাইকিংয়ের জন্য ২৬৭৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই পাহাড়টিকে বেছে নেন। গরমকালে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে তারা যেমন পছন্দ করেন, ঠিক তেমনি শীতকালে বরফের চাদরে ঢেকে যাওয়া পাহাড়েটিকে স্কি করার জন্য বেছে নেন। তাই এখানে নিত্য পর্যটকদের যাতায়াত লেগে থাকে।
হানস্রুক পবর্ত
ইদারওবারস্টাইন শহরের আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো ৪১০ কি.মি দীর্ঘ হানস্রুক থেকে সারল্যান্ড রাজ্যে পৌঁছানোর জন্য একটি হাঁটার পথ। অনেকেই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে তৈরি দীর্ঘ একটি সেতু দিয়ে হাঁটতে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করেন।
খনির জাদুঘর আর নানা স্থানীয় ঐতিহ্য আর জার্মানির ইতিহাসে সমৃদ্ধ ইডারওবারস্টাইন শহরটি দেখতে তাই প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক পর্যটকের নিয়মিত আনাগোনা দেখতে পাওয়া যায়।
ফিচার ইমেজ-wikimedia commons