আমাদের এই বসুন্ধরা কতই না অজানা রহস্যে ভরা। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগেও বিশ্বে এমন অনেক স্থান রয়ে গেছে, যেগুলোর দুর্ভেদ্যতা উদঘাটন করা এখনও মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তেমনি এক ভয়ঙ্কর রহস্যে ঘেরা জায়গা মায়ানমারের পাংস পার্সের এক জলাভূমি, যাকে অনেকে বলে থাকে ‘লেক অব নো রিটার্ন’।
জলাভূমিটি দৈর্ঘ্যে ১.৪ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ০.৮ কিলোমিটার। জলাশয়টি ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তে পাংস পার্স ও ‘হেল পাস’ এবং স্টিলওয়েল রোডের ২.৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। হ্রদের কাছকাছি টাঙ্গসা আদিবাসীরা বহু বছর ধরে বসবাস করে আসছে। এই হ্রদের নামকরণের ইতিহাসও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। হারম্যান পেরি নামে একজন আমেরিকান সৈন্যের জীবনকাহিনী নিয়ে ব্রানডন আই কোয়েরনার ২০০৮ সালে প্রকাশিত বইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা এই জলাভূমিকে প্রথম ‘লেক অব নো রিটার্ন’ হিসেবে অভিহিত করেন।
পাংস পার্সের রহস্যময় লেকের পাশ দিয়ে তৈরি হওয়া স্টিলওয়েল রোডটি বার্মা বা লেডো রোড নামেও খুব পরিচিত। রাস্তাটি তৈরির পেছনেও রয়েছে এক চমৎকার ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীদের প্রবল পরাক্রম কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছিলো না। চীন ও বার্মায় (বর্তমানে মায়ানমার) তাদের অপ্রতিরোধ্যতা মিত্রবাহিনীকে ভীত করে তুলছিল। পর্বতসংকুল পরিবেশে জরুরী সৈন্য-সামন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা মিত্রবাহিনীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। বার্মা রোড জাপানীরা বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ায় সৈন্য সরবরাহের একটি পথ আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে বিকল্প রাস্তা তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে থাকে। জাপানকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে রেঙ্গুন সমুদ্র বন্দর থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত বিকল্প সড়ক তৈরি আবশ্যক হয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালের ১ ডিসেম্বর মার্কিন কমান্ডার জেনারেল জোসেফ ডব্লিউ স্টিলওয়েল দায়িত্ব পেলেন সড়কটি নির্মাণের।
তার তত্ত্বাবধানে ১৯৪৩ সালের শেষদিকে আসামের লিডো থেকে অরুণাচল, মায়ানমার হয়ে চিনের ইউনান অবধি পাহাড় ও জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি শুরু হয়। মার্কিন সেনা আর ভারতীয়, আফ্রিকান ও চীনা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১,৭০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হলো মাত্র এক বছরে। জেনারেলের সম্মানে রাস্তার নামকরণ করা হয় স্টিলওয়েল রোড।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কিছুদিন রোডটি চালু থাকলেও ১৯৫৫ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দীর্ঘ ৫০ বছর পর ২০০৭ সালে রোডটি পুনরায় চালু হয়। আর সেই সাথে ফিরে আসে মুছে যাওয়া পুরনো কিছু ইতিহাস। বিশেষত, স্টিলওয়েল রোডের ধারে পাংপাস গিরিপথের পাশের একটি জলাভূমি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। একসময় এই লেকটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা কাহিনী। মুখে মুখে ফেরা সেসব কাহিনী যেন আবার জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে। আর এভাবেই রচিত হয় ‘লেক অব নো রিটার্ন’ এর রহস্যময় উপাখ্যান।
মায়ানমার সরকারের এক তথ্যমতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রহস্যময় এই জলাভূমির কাছেই রসদ, কামান ও অস্ত্রশস্ত্র সমেত মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল মিত্রবাহিনীর বেশ কয়েকটি বিমান এবং সেসব বিমানের সৈন্য-সামন্ত, যাদের কোনো অস্তিত্বই পরবর্তীতে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। উত্তর মায়ানমারের ঘন জঙ্গলেঘেরা এই লেকটির রহস্যময়তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত দিতে পারেননি। সুতরাং ব্যাপার যে গোলমেলে, তা সহজেই অনুমেয়। মায়ানমারের সেই জলাভূমিকে নিয়ে প্রচলিত আছে প্রচুর গল্পগাঁথা।
কথিত রয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানী সৈন্যদের একটি দল যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাংস পাস এলাকা দিয়ে পিছু হটতে থাকে। কিন্তু হ্রদের কাছাকাছি এসে তারা পথ হারিয়ে ফেলে। হ্রদের পাশে তারা অস্থায়ী তাঁবু গড়ে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা মৃত্যুবরণ করে। অনেকেই মনে করে থাকেন, এই ঘটনায় জলাভূমিটির ভূমিকা রয়েছে।
আরেকটি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সেনাদের একটি দল ঐ পথ অতিক্রম করছিল। কিন্তু হঠাৎই হ্রদের পাশের বালিয়াড়িতে তারা হারিয়ে যায়। কাউকে সেই বালিয়াড়ি থেকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেনাদল ঐ হ্রদটি পর্যবেক্ষণ করতে যায়। কিন্তু হ্রদের কাছাকছি এক জঙ্গলের কাছে তারাও চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়।
কথিত রয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর অনেক যুদ্ধবিমান এ এলাকায় গিয়ে নিখোঁজ হয়। যুদ্ধবিমানগুলো ঐ জলাভূমির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় রেডিও সিগন্যাল নষ্ট হয়ে যায় এবং বিমান থেকে জলাভূমির পাশে বিমান ল্যান্ডিংয়ের পর্যাপ্ত জায়গা আছে বলে পাইলটের দৃষ্টিবিভ্রম হয়। ফলে বিমান জরুরী ল্যান্ডিং করতে গিয়ে অনেক বিমান বিধ্বস্ত হয়। আবার অনেক বিমান হ্রদের গভীর জলে চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়।
আদিবাসীদের কাছ থেকে লেকটি সম্পর্কে একটি অদ্ভুত তথ্য পাওয়া যায়। তারা বিশ্বাস করে, এ জলাভূমিতে একটি বিশাল দৈত্য বাস করে। তারা নাকি রাতের বেলায় অনেকের কান্না শুনেছে সেখান থেকে। তাদের দাবি, পূর্ণিমা রাতে একটি হাত হ্রদ থেকে বের হয়ে আসে এবং সে কাউকে ডাকতে থাকে।
স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্থানীয় লোককাহিনী এই এলাকার সকলের মুখে মুখে ঘুরে। সেই কাহিনী অনুসারে, এই হ্রদের পাশে একসময় নাকি একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। গ্রামের অধিবাসীদের অনেকেই লেকের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। একদিন এক জেলের জালে এক বিশালাকার মাছ ধরা পড়লো। গ্রামবাসীরা সেই আনন্দে এক উৎসবের আয়োজন করলো। উৎসবে সকলে আমন্ত্রিত হলেও দুজন সেই উৎসবে অনুপস্থিত ছিল। সেই রাতে মানুষের বেশে হ্রদের আত্মা এসে ঐ দুজনকে এলাকা ছাড়তে বলে। সেই দুজন ছিল এক বৃদ্ধা আর তার নাতনী, তারা পরদিনই ঐ এলাকা ছেড়ে কাছাকাছি এক জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। আর তারপরেই ঐ এলাকায় আচমকা বন্যা শুরু হয়। বন্যার তোড়ে লেকের পানিতে ডুবে যায় আস্ত এক গ্রাম। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, এই লেকের মাছ বিষাক্ত।
প্রায় একই রকমই আরেকটি গল্প এই অঞ্চলে খুব জনপ্রিয়। গল্পটি অনেকটা এরকম- একবার গ্রামবাসীরা সকলে মিলে ঠিক করলো, গ্রামে একটা বড় ধরনের উৎসব করা হবে। আর তার জন্য সেই লেকের মাছ ভোজনের ব্যবস্থা করা হবে। ঘটনাচক্রে, সেই লেকে বাস করতো বৃষ্টির দেবীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত তিনটি মাছ। তাই বৃষ্টির দেবী গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিকে স্বপ্নাদেশ দিলেন যে, গ্রামবাসীরা যেন মাছ না ধরে, নাহয় তাদের অনিষ্ট হবে।
পরদিন বৃদ্ধ ব্যক্তিটি গ্রামবাসীদের স্বপ্নাদেশের কথাটি জানান। কিন্তু তারা তার কথার পাত্তা না দিয়ে মাছ ধরতে চলে যায় লেকে। লেকের সব মাছ ধরে আয়োজন করা হয় সেই উৎসব, ফলে রুষ্ট হন বৃষ্টির দেবী। ঐ রাতেই স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত বৃদ্ধ গ্রাম থেকে চলে যান। এরপর গ্রামে ঘটে যায় এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। বৃদ্ধ ব্যক্তিটি পরদিন গ্রামে এসে দেখেন, গ্রামের আর কোনো অস্তিত্ব নেই, তার পরিবর্তে আছে এক জলাভূমি।
এসব অদ্ভূতুড়ে গল্প ছড়িয়ে পড়ায় মানুষ ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমে এই জলাভূমি নিয়ে তৈরি হতে লাগলো আরো অনেক গল্পগাঁথা এবং তা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো লোকের মুখে মুখে। ফলে ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়তে লাগলো স্থানটি। কেউ যেতে সাহস করে না এই পথ দিয়ে। এমনকি ওখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা পর্যন্ত ঐ এলাকা এড়িয়ে যেতো।
এভাবে লেক অব নো রিটার্নের রহস্য সকলের কাছে অধরাই রয়ে যায়। অজানা অলৌকিক এই রহস্য তাই আজও অন্ধকারেই আবৃত রয়ে গেছে।