২০১৮ সালের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদ শিরোনাম ছিল সিঙ্গাপুরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের সাক্ষাৎকার। এই শতাব্দীর একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার বলা যেতে পারে একে। কারণ দুই দেশের মধ্যে এতদিন তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এই দুটি দেশের মধ্যে একে অন্যকে কটাক্ষ করা, বিরোধী মন্তব্য করা, কাদা ছোড়াছুড়ি ইত্যাদি লেগেই ছিল। এমতাবস্থায় দুই দেশের প্রধান নেতার একসাথে বসতে চাওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনাই বটে। কিম জং উনের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়া থেকে অগণিতবার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এমনকি জাপানের উপর দিয়ে দুই-দুইবার পারমাণবিক মিসাইল উৎক্ষেপণ পরীক্ষা করার মতো বেপরোয়া কাজও করেছে উত্তর কোরিয়া। যুক্তরাষ্ট্রকে গুড়িয়ে দিতে চাওয়া, নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয় কিম জং উনের পক্ষ থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও উত্তর কোরিয়াকে বিভিন্ন সময় হুমকি দেয়া হচ্ছিলো। কিন্তু সিঙ্গাপুরে দুই দেশের প্রধানদের বৈঠকে বসার পর তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটাই ছিল দেখার বিষয়। উত্তর কোরিয়া আশ্বাস দেয় যে, তারা তাদের সকল নিউক্লিয়ার কর্মসূচি স্থগিত করবে, নিউক্লিয়ার আইনের আওতায় তাদের দেশ কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের কর্মসূচি তাদের দেশ থেকে নেয়া হবে না।
কিন্তু উত্তর কোরিয়ার এমন বক্তব্য কতটুকু সত্য সেটার উপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে তাদের বৈরি সম্পর্ক সেটা আদৌ ঠিক হবে কি না তা নিয়েও আগেভাগে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে উত্তর কোরিয়ার কিছু কর্মকাণ্ডে সন্দেহ হচ্ছে যে তারা তাদের নিউক্লিয়ার কর্মসূচি গোপনে চালিয়েই যাচ্ছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে অনেকবার উত্তর কোরিয়া নিউক্লিয়ার কর্মসূচি নিয়ে তাদের স্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ করেছে। ২০১২ সালে এই দেশ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে তারা তাদের দেশকে একটি নিউক্লিয়ার দেশ হিসেবে তৈরি করবে। এমনকি ২০১৮ সালেও কিম জং উন ঘোষণা দেন যে, পিয়ংইয়ং থেকে নিউক্লিয়ার কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এছাড়া গত বছর যে কয়টি নিউক্লিয়ার পরীক্ষা তারা চালিয়েছে সেগুলোর মধ্যে একটি পরীক্ষা হাইড্রোজেন বোমার উপর ছিল বলে সন্দেহ করা হয় এবং বেশ কয়েকটি শক্তিশালী মিসাইল পরীক্ষাও তারা চালায়। এমনকি এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কিম নিজে সকল পার্টি সদস্যদের ডেকে এনে খোলাখুলিভাবেই ঘোষণা দেন যে বাইরের কোনো শক্তির কাছে উত্তর কোরিয়া মাথা নত করবে না এবং কোনোভাবেই নিউক্লিয়ার কর্মসূচি নিয়ে তারা আপোস করবে না।
এই কয়েকটি বক্তব্য থেকে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। এমনকি মার্চ মাসেও তাদের কাছ থেকে নিউক্লিয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়। কিম জং উনের সরাসরি নির্দেশ যে নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মাধ্যমেই তার দেশ শক্তিশালী হিসেবে গড়ে উঠবে। নিজের দেশের নিরাপত্তার জন্য বাইরের দেশকে তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ক্ষমতা এবং সামর্থ্যকে প্রকাশ করতেই হবে। কিমের উত্তর কোরিয়াতে নিউক্লিয়ার কর্মসূচী একটি বৈধ কর্মসূচী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে যেটার পেছনে কাজ করছে তার দেশ এবং সেখানকার মানুষের নিরাপত্তা। কিম জং উন যেখানে এতবার নিউক্লিয়ার কর্মসূচী নিয়ে তার নিজের বক্তব্য দিয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী তার দেশ কাজও করছে, সেখানে শুধুমাত্র এককথায় তারা তাদের কর্মসূচির সমাপ্তির ঘোষণা করবে এটা ভেবে নেয়া বোকামি। যদিওবা আমরা ধরে নেই যে, ছয় বছর আগে নেয়া কাগজ-কলমের সিদ্ধান্তকে কিম তার ক্ষমতা ব্যবহার করে বদলে ফেলতে পারেন, কিন্তু এই কর্মসূচি বন্ধ করতে হলে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে সেটা কি তিনি খরচ করতে চাইবেন? এখানে আরও ভয় আছে। উত্তর কোরিয়া যত অর্থ খরচ করে এই কর্মসূচী দাঁড় করিয়েছিল সেটা যদি হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে কিমের সরকারকে জনগণের ক্ষোভের শিকার তো হতেই হবে, এছাড়া উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর রোষানলেও পড়তে হতে পারে কিমকে।
উত্তর কোরিয়ার এখনকার কর্মকাণ্ডও সন্দেহজনক। এ বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখতে পান যে উত্তর কোরিয়ার উত্তর দিকের একটি শহরে সন্দেহজনক কারখানা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে যে এখানে নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশেষ ধরনের গ্রাফাইট তৈরি করা হচ্ছে যা উত্তর কোরিয়া থেকে অন্যান্য দেশে রপ্তানি হচ্ছে। পিয়ংইয়ং তাদের তৈরি এসব গ্রাফাইট ক্রয় করার জন্য অন্যান্য দেশে প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। অনেকে এটাও সন্দেহ করছে যে যুক্তরাষ্ট্র যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির জন্য টেনিসির পাহাড়ে গোপনে কাজ করেছিলো, ঠিক তেমনি উত্তর কোরিয়ার চ্যাং প্রদেশকেও সেরকম ভাবা হচ্ছে। সম্ভবত তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্রগুলো গোপনে মজুদ করার জন্য এই প্রদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এরকম মনে করার কারণ হচ্ছে এই প্রদেশে সাধারণ শ্রমিকরা কাজ করতে পারছে না। অনেক বেশি নিরাপত্তার বলয়ে ঢাকা হয়েছে এই অঞ্চলকে। এই প্রদেশে স্থানীয় সরকার তাদের নিরাপত্তা এবং সেখানকার বসবাসকারী নাগরিকদের নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রাখছে। এমনকি উত্তর কোরিয়া তাদের অনধিকার চর্চার অভ্যাসকে সংযত করবে বলে কথা দিলেও তারা আদৌ তা করছে না। দক্ষিণ কোরিয়াতে পিয়ংইয়ং থেকে সাইবার আক্রমণ করা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সামিট বলে ভুয়া মেইল পাঠানো হচ্ছে।
অন্য দেশের চোখে ধুলো দেয়ার ব্যবস্থাও করেছে উত্তর কোরিয়া। তারা তাদের মাটির নিচে অবস্থিত একটি নিউক্লিয়ার টেস্ট সাইট থেকে সব ধরনের যন্ত্রপাতি ধংস করবে বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু তাদের দেশ থেকেই একটি সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, তারা আগেই সেই জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলো বের করে ফেলে এবং সাংবাদিকদের সামনে অন্যান্য যন্ত্রগুলোকে বের করে। সাংবাদিকদের মধ্যে কেউই নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ ছিল না, তাই কেউ তাদের এই কর্মকাণ্ডকে হাতেনাতে ধরতে পারেনি।
উত্তর কোরিয়া আদৌ তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিশ্চিহ্ন করছে কি না সেটা যাচাইবাছাইয়ের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ দলকে সেখানে যেতে হবে। তারা সেখানে নিজেরা পর্যবেক্ষণ করবে এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিবে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া তাদের অস্ত্র নিশ্চিহ্ন করা নিয়ে কোনো যাচাইবাছাই করতে রাজি না। এটা হাস্যকর। কারণ যেকোনো দেশ সত্যি সত্যি যে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ করছে সেটার একটি প্রমাণ থাকতে হবে, না হলে শুধু মুখে মুখে অঙ্গীকার করলে সেটার কোনো মূল্য থাকে না।
উপরের আলোচনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, উত্তর কোরিয়া মুখে আশ্বাস দিলেও তাদের তৈরি নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি কোনদিকে এগোচ্ছে তা নিয়ে আসলে আগে থেকেই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে দিনশেষে একটি শান্তিময় ধরণীই এর শান্তিকামী সন্তানদের কাম্য।