কুমারী দেবীর প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে, তাদের একটার মতে, মল্ল বংশের রাজা ত্রিলয়া মল্ল তন্ত্রশক্তির চর্চা করত। এই শক্তির চর্চায় সে এমন সিদ্ধি লাভ করেছিল যে তালেজু দেবীর সাথে তার সরাসরি যোগাযোগ হতো। প্রতি রাতে মানুষের রূপ ধরে দেবী প্রাসাদে আসতেন। তিনি এবং রাজা পাশা খেলতেন আর দেশের মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন আলোচনা করতেন।
কিন্তু দিনের পর দিন রাজা দেবীর উপর আকৃষ্ট হয়ে উঠছিলেন। একথা বুঝতে পেরে দেবী বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হন। তিনি প্রাসাদে আসা বন্ধ করে দেন। অনুতপ্ত ত্রিলয়া বারবার দেবীর কাছে ক্ষমা চান, কঠোর সাধনা শুরু করেন। অবশেষে দেবী তালেজু ভক্তকে ক্ষমা করেন। তিনি বলে যান তার আবির্ভাব হবে ‘শাক্য’ আর ‘বজ্রাচার্য’ জাতের কুমারী মেয়ের মাঝে।
অনেক অনেক কাল আগে থেকে নেপালে জীবন্ত কুমারী পূজার প্রথা চালু আছে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী কুমারী হল তালেজু দেবীর মানুষ রূপের অবতার, নিজ ক্ষমতাবলে তিনি সবকিছুকে রক্ষা করেন। মল্ল যুগ থেকেই কুমারী দেবীদের নেপালের রক্ষাকর্তা দেবী বলে মানা হয়।
অন্যদিকে তালেজু দেবীকে নেপালের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলে ভাবেন অধিবাসীরা। রাজা হরি সিং দেব প্রথম এই প্রথা বয়ে এনেছিলেন কাঠমান্ডুর ভক্তপুরে। ১৪ শতাব্দীর প্রথম দিকে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহের তাড়া খেয়ে তিনি ভক্তপুর চলে আসেন, আর এখানে প্রতিষ্ঠা হয় এই প্রথা। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, হরি দেব সিং আসারও অনেক আগে থেকে কাঠমান্ডুতে তালেজু দেবীর পূজা হয়ে আসছে।
একসময় মল্ল রাজ্য একটাই ছিল। রাজারা ভক্তপুর দরবারে বসে কাঠমান্ডু শাসন করতেন। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা যক্ষ মল্ল নিজের ছেলেদের ভেতর রাজ্য ভাগ করে দিয়েছিলেন। একশো বছর না গড়াতেই একটা রাজ্য ভেঙে অনেকগুলো আলাদা রাজ্য হয়ে গেল। এইসময় যক্ষ মল্লের পুত্রেরা তাদের ধর্মবিশ্বাস বিভিন্ন স্থানে বয়ে নিয়ে যায়। দেখা যায়, কাঠমান্ডুর পাশাপাশি পাটনেও তালেজু দেবীর মন্দির তৈরি হচ্ছে।
তালেজু দেবীকে অর্চনা করার যে প্রথা তিনটা রাজ্য এনেছিল, তার সাথেই তিনটি প্রধান শহরে জীবন্ত কুমারী দেবীর প্রথা চালু হয়ে যায়, সেখানকার অধিবাসীরাও নিজেদের এই প্রথার সাথে বিশ্বাসী মনেই মানিয়ে নেয়। ভক্তপুর, কাঠমান্ডু আর পাটনের ভেতর সবথেকে জনপ্রিয় আর ক্ষমতাবান মানা হয় কাঠমান্ডুর কুমারী দেবীকে, যিনি কিনা একজন রাজকীয় কুমারী।
শাক্য আর বজ্রাচার্য জাত দুটিই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ এমন কোনো মেয়ে, যে কিনা বৌদ্ধ পরিবারে জন্মাবেন, তাকে হতে হবে সনাতন ধর্মের দেবী। এই প্রথা শুধু ধর্মীয়ভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও নেপালের সনাতন ধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলবন্ধনের সৃষ্টি করেছে।
এখন, শাক্য আর আর বজ্রাচার্য জাতে তো অনেক মেয়ে জন্মাচ্ছে প্রত্যেক বছরে, তাদের সবাই কি কুমারী দেবী বলে বিবেচিত হবেন? মোটেও তা নয়। দেবী হতে গেলে কুমারীর ভেতর নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা লাগবে। কাঠমান্ডুর রাজকীয় কুমারী বেছে নেওয়া হয় শাক্য থেকে। মেয়েটিকে অবশ্যই অল্প বয়সের কুমারী হওয়া লাগবে। কখনো কাঁটাছেড়া থেকে এই মেয়ের শরীরে রক্তপাত হয়নি, শরীরে কোনো রোগ, বা রোগের চিহ্ন, যেমন বসন্তের দাগ থাকা যাবে না। পরবর্তীতে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো লক্ষণও থাকা যাবেনা। তাদের ত্বক হবে ত্রুটিমুক্ত, শরীর দুর্গন্ধযুক্ত হওয়া চলবে না, সবগুলো দাঁত থাকতে হবে, কালো চোখ আর কালো চুল থাকবে, সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন হাত-পা হবে এবং অতি অবশ্যই তাদের রজঃস্বলা হওয়া চলবে না।
এছাড়াও দেবী হিসেবে যথার্থতা প্রমাণ করতে ৩২টি পরিপূর্ণতার লক্ষণ থাকতে হবে তাদের শরীরে। যেমন- শঙ্খের মতো ঘাড়, বটগাছের মতো শরীর, গরুর মতো চোখের পাঁপড়ি, সিংহের মতো বুক, হাঁসের মতো নরম অথচ পরিষ্কার বাচনভঙ্গি।
কুমারী দেবী হওয়ার প্রার্থীকে নির্ভীক অথচ শান্ত হতে হবে। তার কোষ্ঠী পরীক্ষা করে সে রাজা ও রাজ্যের জন্য মঙ্গলজনক কিনা, তার বিচার করা হবে। কুমারী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সহজ নয়। কেউ কেউ কুমারী নির্ণয়ের এই প্রক্রিয়াকে দালাই লামা বা পঞ্চেন লামা নির্বাচনের সাথে তুলনা করে থাকেন। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন পাঁচজন পূর্ণবয়স্ক বজ্রাচার্য পুরোহিত, পঞ্চবুদ্ধ, প্রধান রাজপুরোহিত, তালেজু দেবীর পুরোহিত আর রাজজ্যোতিষী। প্রার্থী নির্বাচনের পর, এদের মাঝে একজন মেয়ে যে সত্যিই দেবীর রূপ, তার প্রমাণ দিতে তাদেরকে একের পর এক কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। সবথেকে বড় পরীক্ষাটি হয় কালরাত্রিতে। তালেজু দেবীর উদ্দেশ্যে ১০৮টি মহিষ ও ছাগল উৎসর্গ করা হয়। তারপর অন্ধকার সেই রাতে কাটা মাথাগুলোতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মন্দিরের উঠোনে দেবীর প্রার্থীকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে মুখোশ পরা লোকেরা নাচে। এসব কাজের উদ্দেশ্য হল, শিশুটি সত্যই যদি দেবী হয়, তবে এরকম ভীতিকর পরিবেশেও শান্ত থাকবে। যদি একজন ভয় পেয়ে যায়, তাহলে পরের প্রার্থীকে এনে একই পরীক্ষা চালানো হয়। চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসেবে জীবন্ত দেবীকে একটি ঘরে এসব কাটা মাথার সাথে পুরো রাত কাটাতে হয়।
তার নির্ভীকতাকে দেবত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। একজন দেবত্ব ছেড়ে যাওয়ার পর অন্যজনের দেবত্ব লাভ অনেকটা পুনর্জন্মের মতো। সুতরাং, দ্বিতীয় দেবীকে অবশ্যই তার আগের দেবীর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র চিনতে পারার কথা। আগের দেবীর জিনিসগুলো একইরকম আরো অনেককিছুর সাথে মিশিয়ে তার সামনে রাখা হয়, সে যদি নির্ভুলভাবে নিজের জিনিসগুলো চিনে নিতে পারে, তার ভক্তদের আর সন্দেহ থাকে না যে সে-ই দেবী। যে সবগুলো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারে, সে-ই কুমারী দেবী হিসেবে নির্বাচিত হয়। কুমারী দেবীর শরীর তালেজুর অধিষ্ঠানের জন্য যেন শুদ্ধ হয়, সে দেখভাল করেন পুরোহিত। তারা গোপন তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেবীকে শুদ্ধ করে তোলেন।
তারপর দেবী সাদা পোশাকে কুমারীদের জন্য প্রস্তুতকৃত ‘কুমারী বহাল’ বা ‘কুমারী ঘর’ নামক মহলে বাস করতে চলে যায়। ১৭৫৭ সালে এটি তৈরি করেছিলেন জয় প্রকাশ মল্ল। রজঃস্রাব বা প্রথম কোথাও কেটে গিয়ে রক্ত ঝরলে তার দেবত্ব শেষ হয়ে যায়, এবং নতুন দেবী নির্বাচনের পালা শুরু হয়।
যদিও কুমারী নির্বাচনের যে ভয়ংকর প্রথার কথা প্রচলিত আছে, তা বিতর্কিত। অনেকের ধারণা, দেবীর মাহাত্ম্য প্রকাশে অতিরঞ্জিত সত্য প্রকাশ করা হয়। রাশমিলা শাক্য একসময় রাজকীয় কুমারী ছিলেন। দেবত্ব শেষ হওয়ার পর তার বই ‘ফ্রম গডেস টু মরটাল’ প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি দাবি করেন, দেবী নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটি আহামরি কিছু কঠিন নয়। কালরাত্রিতে তিনি তার সামনে কোনো পুরুষকে নাচতে দেখেননি। ভয়ংকর ঘরের পরীক্ষায় ১০-১২টা মাথা ছিল মাত্র। দেবীদের যে ৩২ লক্ষণ শারীরিক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাও এমন কিছু গুরুতর নয়।
কুমারীর জীবন
কুমারী তার দেবত্ব চলাকালে শেষবারের মতো মাটিতে পা রাখেন, যখন সাদা পোশাকে উঠোন দিয়ে হেঁটে কুমারী মহলে চলে যান। তার পা, তার মতোই পবিত্র জ্ঞান করা হয়। ভক্তেরা বিভিন্ন সময়ে এসে তার পাঁ ছুয়ে প্রণাম করেন। রাজাকে পর্যন্ত দেবীর সম্মানে তার পদচুম্বন করতে হয়। দেবী কখনো জুতা পরেন না। যদি নিতান্তই পা ঢাকতে হয়, তবে তা লাল মোজা দিয়ে। কোথাও যেতে হলে তার জন্য সোনার পালকি আসে।
উৎসব ছাড়া দেবী বাইরে যান না। তার পরিবারও তার দেখা খুব কমই পায়। দেবীকে দেখাশোনা করার লোকেদের বাচ্চারাই দেবীর খেলার সাথী। যদিও দেবীকে বকা দেওয়ার মতো সাহস কেউ করে না, তবু সবাই আশা করে দেবী তার দেবীসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রাখবেন। সবসময় লাল পোশাক পরিয়ে, চূড়া করে খোপা বেঁধে,কপালে লাল হলুদ আগুন চোখ এঁকে দেওয়া হয়। সাধারণভাবে কুমারীরা শিক্ষাগ্রহণ করেন না। তবে যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়েছে বলে কুমারীকেও বইখাতা নিয়ে পড়তে বসতে হয়। কাঠমান্ডুর প্রধান কুমারী যখন মহলেই শিক্ষকদের কাছে পড়াশুনা করছেন, তখন ভক্তপুরের কুমারীকে স্কুলব্যাগ আর নাস্তা নিয়ে ছুটতে হয় স্কুলের দিকে।
নেপালে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে কুমারী যাত্রা উৎসব উদযাপিত হয়। দিনক্ষণ মিলিয়ে সেখানে গেলে আপনিও হয়তো কুমারীর দেখা পাবেন।
ফিচার ইমেজ সূত্র- The Darkroom- Baltimore Sun