তুরস্কের সৌদি কনসুলেট থেকে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। তুরস্কের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও দাবি করছে, জামাল খাশোগজিকে নিশ্চিতভাবেই কনসুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে। এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ না করলেও তুরস্ক দাবি করেছে, তাদের কাছে হত্যার ঘটনার অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিং আছে। তুরস্ক সেই অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিংয়ের প্রমাণ সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখিয়েছে বলেও বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে।
সম্ভবত সেই প্রমাণ দেখার পরেই সৌদি আরব বুঝতে পেরেছে, হত্যার ঘটনাটি অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই। অন্তত সেরকমই দাবি করেছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন। নাম প্রকাশ না করে একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন দাবি করেছে, সৌদি আরব প্রথম দিন থেকে যেরকম দাবি করে আসছিল যে, জামাল খাশোগজি কনসুলেট থেকে নিরাপদে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, সেই অবস্থান থেকে সরে এসে তারা এখন খাশোগজিকে কনসুলেটের ভেতরেই হত্যা করার ঘটনাটি স্বীকার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সিএনএনের দাবি অনুযায়ী, সৌদি আরব নিজেদের করা তদন্তের রিপোর্টে স্বীকার করবে যে, খাশোগজিকে কনসুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এর জন্য তারা দায়ী করবে দূতাবাসের অথবা গোয়েন্দা বিভাগের মাঝারি পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তাকে। তারা দাবি করবে, সৌদি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়, তথা দেশটির ডিফ্যাক্টো নেতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশের বাইরে গিয়ে ঐ কর্মকর্তারা নিজেদের উদ্যোগেই এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও একই রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডকে ‘রৌগ কিলার্স’দের কাজ বলে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু এত বড় একটি ঘটনা মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশ ছাড়াই ঘটেছে, এটা বিশ্বাস করা দিনে দিনে আরও কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ, ঘটনার দিন দুটি প্রাইভেট প্লেনে করে তুরস্কে যাওয়া যে ১৫ জন সন্দেহভাজন সৌদি নাগরিকের নাম এবং ছবি তুরস্ক প্রকাশ করেছে, তাদের অনেকেরই পরিচয় ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং মিডলইস্ট আই পৃথক পৃথকভাবে এদের মধ্য থেকে যথাক্রমে ৯ জন, ১১ জনের ৭ জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। দেখা গেছে, এদের প্রত্যেকেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা বিভাগ, সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য সরকারী মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে চাকরিরত। এদের মধ্যে অন্তত চারজনের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেছে।
মাহের আব্দুল আজিজ আল-মুতরেব
পুরাতন ব্রিটিশ ডকুমেন্টের বরাদ দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস দাবি করেছে, ১৫ জন সন্দেহভাজনের তালিকার একজন, মাহের আব্দুল আজিজ আল-মুতরেব ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডে সৌদি আরবের কূটনৈতিক পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের বর্ণনা অনুযায়ী, মুতরেব ছিলেন ইংল্যান্ডে নিযুক্ত সৌদি প্রথম সচিব, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয় ফোন ডাইরেক্টরি অ্যাপ MenoM3ay-এ নিজেকে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বলে দাবি করেছেন। তিন বছর আগে উইকিলিক্সে মুতরেবের নাম উঠে এসেছিল। সেখান থেকে জানা যায়, ২০১১ সালেও তিনি দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন এবং উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। সম্প্রতি তাকে প্যারিস, মাদ্রিদ, হিউস্টন, বোস্টন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন স্থানে মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে ভ্রমণ করতে দেখা গেছে, সম্ভবত তার বডিগার্ড হিসেবে।
মোহাম্মদ সা’দ আল-জাহরানি
১৫ জন সন্দেহভাজনের তালিকায় থাকা আরেকজন সদস্য হলেন মোহাম্মদ সা’দ আল-জাহরানি। নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট পৃথক পৃথকভাবে ফোন ডাইরেক্টরি অ্যাপ MenoM3ay এর বরাত দিয়ে দাবি করছে, অ্যাপটিতে আল-জাহরানি নিজেকে সৌদি রয়্যাল গার্ড হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ইউটিউবে তার একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের পাশেই রয়্যাল গার্ডের কালো রংয়ের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেখানে তার চেহারা এবং নেমপ্লেটে থাকা নাম উভয়ই তুরস্কের দেওয়া নাম ও ছবির সাথে মিলে যায়।
খালেদ আইয়্যাদ আল-তায়েবি
ওয়াশিংটন পোস্টের দাবি অনুযায়ী, খালেদ আইয়্যাদ আল-তায়েবি সৌদি রয়্যাল গার্ডের একজন সদস্য। গত মার্চ মাসে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের তিন দিন আগে তিনি আমেরিকা পৌঁছেন। যুবরাজের সফরের পুরো সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছিলেন। এর আগেও অন্তত দু’বার বাদশাহ সালমান এবং তার আরেক পুত্রের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ও আল-তায়েবি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন এবং তাদের সফর শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশটিতে অবস্থান করেছিলেন। পত্রিকাটি ফোন ডাইরেক্টরি অ্যাপ MenoM3ay থেকে নিশ্চিত করেছে, সেখানে আল-তায়েবি তার প্রোফাইলে নিজেকে রয়্যাল গার্ড হিসেবে পরিচয় দিয়েছিন।
সালাহ মোহাম্মদ আল-তুবাইগি
সৌদি হিট টিমের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হচ্ছেন ড. সালাহ মোহাম্মদ আল-তুবাইগি। তুরস্কের গোয়েন্দাদের কাছে থাকা খাশোগজি হত্যাকাণ্ডের অডিও রেকর্ড শুনেছে, তুরস্কের এমন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লন্ডন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম মিডলইস্ট আই এবং তুরস্কের ইয়েনি শাফাক পত্রিকা দাবি করেছে, তুবাইগিই খাশোগজিকে সরাসরি হত্যা করেছেন। খাশোগজির শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে কিছু প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার পর তিনি পুরোপুরি অসাড় হওয়ার আগেই তুবাইগি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটতে শুরু করেন।
মিডল ইস্ট আইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, সৌদি কনসাল জেনারেলের অফিসের পাশের একটি কক্ষের টেবিলের উপর রেখে তুবাইগি প্রথমে খাশোগজির হাত, এরপর মাথা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটতে শুরু করেন। এ সময় খাশোগজির চিৎকার যেন কানে না যায়, সেজন্য তিনি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে মিউজিক শুনতে থাকেন এবং অন্যদেরকেও একই কাজ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এ জাতীয় কাজের সময় তিনি সবসময়ই মিউজিক শোনেন।
নিউইয়র্ক টাইমসও উচ্চপদস্থ এক তুর্কি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এ প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। তারা আরও জানিয়েছে, তুবাইগির মূল পরিচয়, তিনি সৌদি সায়েন্টিফিক কাউন্সিল অফ ফরেনসিকের প্রধান। টুইটার অ্যাকাউন্টে তিনি নিজেও তার এ পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও তার আরো একাধিক পরিচয় আছে। তিনি নায়েফ আরব ইউনিভার্সিটি ফর সিকিউরিটি সায়েন্সের ক্রিমিনাল এভিডেন্স ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর। ময়নাতদন্তের উপর তার একাধিক প্রকাশনাও আছে।
তবে তুবাইগির আরেকটি পরিচয়, সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি তাদের বিভিন্ন অপারেশন, প্রশিক্ষণ এবং তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে থাকেন। লন্ডন ভিত্তিক সৌদি পত্রিকা শার্ক আল-আওসাতের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি ২০১৪ সালে সৌদি কর্মকর্তাদেরকে রাজি করিয়েছিলেন তাকে ২.৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি ভ্রাম্যমান ময়নাতদন্ত ল্যাব নির্মাণের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য, যেখানে তিনি মাত্র সাত মিনিটের মধ্যেই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে পারবেন। কাকতালীয়ভাবে, তুরস্কের কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী, অডিও রেকর্ড থেকে শব্দ শুনে বোঝা যায়, জামাল খাশোগজিকে হত্যা করতেও তুবাইগির সময় লেগেছিল মাত্র সাত মিনিট।
অন্যান্যরা
ওয়াশিংটন পোস্টের দাবি অনুযায়ী, ১৫ জনের হিট টিমের তালিকায় থাকা অন্যান্যদের মধ্যে আছে নায়েফ হাসান আল-আরিফি এবং সাইফ সা’দ আল-ক্বাহতানি, যারা দুইজনেই নিজেদেরকে সরাসরি যুবরাজের অফিসের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। এর বাইরেও ওয়াশিংটন পোস্ট মোট নয়জনের নাম ঐ অ্যাপে খুঁজে পেয়েছে, যারা নিজেদেরকে রয়্যাল গার্ড অথবা সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।
অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমস সৌদি রাজপরিবারের সাথে কাজ করা এক ফরাসি পেশাদার ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আব্দুল আজিজ মোহাম্মদ আল-হাওসাওই নামে তালিকার আরেকজনকে চিহ্নিত করেছে। তার দাবি অনুযায়ী, হাওসাওই সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং সে নিয়মিত মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে ভ্রমণ করে। টাইমস সৌদি সংবাদ মাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে দার গালেব আল-হারবি নামে তালিকার আরও একজনকে চিহ্নিত করেছে, যাকে গত বছর জেদ্দায় মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ রক্ষার দায়িত্ব পালনে সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
এছাড়াও মিডল ইস্ট আই দাবি করেছে, তারা সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ডকুমেন্ট থেকে নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, এই ১৫ জনের মধ্যে অন্তত ৭ জন ছিল যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দলের সদস্য। এদের মধ্যে তিনজন- আল-হারবি, ওয়ালিদ আব্দুল্লাহ শিহরি এবং আল-হাওসাওই গত মার্চ মাসে এমবিএসের সাথে যুক্তরাজ্য ভ্রমণে অংশ নিয়েছিল। এছাড়াও ঐ তালিকার আরো দুজন সদস্য মুতরিব এবং ওতাইবি গত এপ্রিলে মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে ফ্রান্স সফরে সঙ্গ দিয়েছিল।
মোহাম্মদ বিন সালমানের দায় কতটুকু?
সৌদি আরব এখনও পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের সাথে নিজেদের কোনো দায় স্বীকার করেনি। বরং ঘটনার প্রথম দিন থেকেই তারা দাবি করে আসছে, জামাল খাশোগজি কনসুলেটে প্রবেশ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সৌদি গণমাধ্যমগুলো এখনও পুরো ব্যাপারটিকে তুরস্ক, কাতার এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থান করার চেষ্টা করছে। সৌদি আরবের আল-আরাবিয়া টিভি চ্যানেল গত কয়েক দিন আগেও অভিযুক্ত ১৫ জন সৌদি নাগরিককে ট্যুরিস্ট বলে দাবি করেছে। কিন্তু একাধিক তদন্তে এখন বেরিয়ে আসছে, তারা প্রায় সবাই সৌদি সরকারের অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত।
পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, শেষপর্যন্ত যদি সৌদি আরব হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে মাঝারি পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার উপর দায় চাপায়, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারণ একজন বা দুজন না, মোহাম্মদ বিন সালমানের আশেপাশের ১৫ জন ব্যক্তিকে সৌদি আরব থেকে প্লেনে করে নিয়ে আসা, কনসুলেটের ভেতর কনসাল জেনারেলের উপস্থিতিতে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা, তুবাইগির মতো উচ্চ পর্যায়ের ফরেনসিক কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া – এতগুলো ঘটনা একা একা ঘটতে পারে না।
সৌদি আরবের মতো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মতি ছাড়া অল্প কয়েকজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তার পক্ষে এত বড় অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত এবং তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই কম। বাদশাহ সালমান হয়তো সব অপারেশনের কথা না-ও জানতে পারেন, কিন্তু অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মোহাম্মদ বিন সালমান, যিনি একইসাথে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী, তিনি এই অপারেশনের কথা জানতেন না, এটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণে শেষপর্যন্ত মোহাম্মদ বিন সালমানের হয়তো কিছুই হবে না, কিন্তু ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তার নামের পাশে এই ঘটনাটি আরেকটি কালিমা লেপন করে রাখবে।