কেউ অপরাধ করলে তার সাজা হবে, এই ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিক। তবে শাস্তির গভীরতা কিংবা গুরুত্ব সব জায়গায় বা কালে এক নয়, এর ভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে মাথা কেটে শাস্তি দেওয়াকে সবাই নিষ্ঠুরতা বলে, আবার পশ্চিমে খুনের আসামীকে ফাঁসিতে ঝোলানোকে বর্বরতা ভাবা হয়।
অপরাধের শাস্তির এই ধারণাটি যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। কিন্তু অনেককাল আগে পৌরাণিক যুগে অন্যায় করলে মানুষ, এমনকি দেবতারাও সম্মুখীন হতো কঠোর শাস্তির। এই শাস্তি তারা বয়ে বেড়াতো বাকি জীবন, যতদিন না তাদের পাপ মোচন হতো। গ্রিক পুরাণের এমনই কয়েকটি ভয়ঙ্কর শাস্তি নিয়ে আজকের এই লেখা।
প্রমিথিউসের যকৃৎ
গ্রিক পুরাণ অনুসারে প্রমিথিউস ছিলেন অমর টাইটানদের মধ্যে একজন। দেবতা ও টাইটানদের মাঝে একবার ভীষণ এক যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে প্রমিথিউসরা দুই ভাই দেবতাদের হয়ে যুদ্ধ করেন। এতে দুজনই দেবতার রাজা জিউসের সুদৃষ্টি লাভ করেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধালেন প্রমিথিউস।
প্রমিথিউসকে বলা হয় মানুষের স্রষ্টা, অন্যান্য দেবতারা যখন পৃথিবীর আর সব কিছু সৃষ্টি করতে ব্যস্ত, সেসময়ে প্রমিথিউস বেশ যত্ন করে গড়লেন মানুষকে। জিউস বরাবরই মানুষের প্রতি প্রমিথিউসের এই ভালবাসাকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখতেন। তখন মানুষ ছিল আঁঁধারের প্রাণী, কেননা তারা তখনও আগুন চিনতো না। দিনের শেষে রাত নামলেই মানুষ হয়ে যেত অসহায়, আগুন যে তখনও দেবতাদের সম্পদ!
তো প্রমিথিউস করলেন কী, অলিম্পাস পর্বত থেকে খানিকটা আগুন চুরি করে নিয়ে গেলেন মানুষের জন্য। তবে মতান্তরে এটাও বলা হয় যে, আগুন বলতে শুধু তাপ আর আলোর উৎস বোঝানো হয়নি পুরাণে। আগুন বলতে জ্ঞান-বুদ্ধি ও মননকে বোঝানো হয়েছে, যা প্রমিথিউস মানুষকে দিতে আসেন। এতে জিউস প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হন তার উপর, আর তাকে দেন এক ভয়াবহ শাস্তি।
জিউস প্রমিথিউসকে বিশাল পর্বতের উপরে একটি পাথরের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলেন। এরপর একটি ঈগলকে নির্দেশ দেন যেন সেটি প্রমিথিউসের শরীরের মাংস খুবলে তার যকৃৎ খেয়ে ফেলে। শাস্তিটি ছিল অনন্তকালের জন্য। কারণ খেয়ে ফেলা যকৃৎটি রাতে পুনরায় নতুন করে গজিয়ে উঠতো যেন পরদিন সকালে ঈগলটি সেটি আবার খেয়ে ফেলতে পারে। এভাবে অনন্তকাল ধরে প্রমিথিউসকে নারকীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন জিউস।
জ্বলন্ত চাকায় ইক্সিয়ন
ইক্সিয়ন ছিলেন থেসালি রাজ্যের সবচাইতে পুরনো গোত্র ল্যাপিথসের রাজা। ইউনিয়াসের কন্যা ডায়াকে তিনি বিয়ে করেন। বিনিময়ে ইউনিয়াসকে মূল্যবান কিছু উপহার দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু শেষমেশ তিনি কথা রাখতে পারেননি। এতে ইউনিয়াস রাগ করে ইক্সিয়নের ঘোড়াশাল থেকে গোটাকয়েক শক্তিশালী ঘোড়া চুরি করে বসেন। শ্বশুরের এহেন ব্যবহারে ইক্সিয়ন ভারি ক্ষুব্ধ হন, কিন্তু খুব সাবধানে সেই রাগ লুকিয়ে রেখে ইউনিয়াসকে তিনি দাওয়াত দেন নিজের বাড়িতে। আর তারপর রাগ মেটাতে তাকে জ্বলন্ত কয়লায় এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে হত্যা করেন। কিন্তু নিজের এমন হীন কার্যকলাপে নিজেই অনুতাপে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন ইক্সিয়ন, এমনকি তার শুদ্ধিকরণে কেউ এগিয়েও আসে না সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
এমন এক সময়ে দেবরাজ জিউস ত্রাতা রূপে আবির্ভূত হন, যদিও খানিক পরেই ত্রাতা থেকে পাল্টে যান শাস্তিদাতায়! জিউস ইক্সিয়নের এ অবস্থা দেখে মায়াবশত তাকে অলিম্পাস পাহাড়ে দাওয়াত দেন। ইক্সিয়ন সেখানে অতিথি হিসেবে বেশ কিছুদিন ধরেই অবস্থান করেন। কিন্তু কথায় বলে, চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। একদিন সকল দেব-দেবীর সাথে একসঙ্গে খেতে বসে ইক্সিয়নের চোখ পড়ে জিউসের স্ত্রী দেবী হেরার ওপর।
দেবী আফ্রোদিতির পর হেরাই ছিলেন সবচেয়ে সুন্দরী। তাই চোখে পড়া অস্বাভাবিক কিছুই না। কিন্তু ইক্সিয়ন জিউস এবং হেরার দাম্পত্য জীবনের একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিলেন হেরার সঙ্গে গায়ে পড়ে খাতির করতে গিয়ে। সেখানেই থেমে থাকলেন না, হেরাকে তিনি অনবরত প্রেমের প্রস্তাব দিতে থাকলেন। হেরা চাইলে নিজেই ব্যাপারটি চুপচাপ সমাধান করে ফেলতে পারতেন, কিন্তু তাতে তো আর ব্যাপারটি ঠিক জমে না। তিনি জিউসের কাছে গিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে এলেন।
জিউসও কম যান না। সব শুনে ইক্সিয়নকে মজা চাখাতে তিনি মেঘপুঞ্জ দিয়ে অবিকল হেরার মতো একটি প্রতিকৃতি তৈরি করেন। ইক্সিয়ন তো এত কিছু বোঝেন না, বোকাচণ্ডীর মতো মেঘের সাথেই ভালবাসার কথা বলতে থাকলেন। এমনকি দিনকতক পর মেঘের তৈরি হেরার সঙ্গে ভালবাসাবাসিও করে ফেললেন (এর ফলাফল হিসেবে তাদের নাকি আবার একটি ছেলেও হয়েছিল!)।
জিউস তো এ সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইক্সিয়নকে তিনি ধরে ফেললেন, বজ্রের আঘাতে ইক্সিয়নকে নির্বাসিত করলেন অলিম্পাস থেকে। হারমিসকে হুকুম দিলেন, ইক্সিয়নকে যেন চিরকাল ধরে জ্বলতে থাকা একটি চাকার সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। অতঃপর রাজা ইক্সিয়নের পরিণতি হলো করুণ। অনন্তকাল ধরে জ্বলন্ত চাকার সাথে আটকে থেকে চাকার সঙ্গে ঘুরতে থাকলেন তিনি। অরফিয়াস যখন তার বীণা বাজান তখন কিছুক্ষণের জন্য চাকার ঘূর্ণন থামে।
সিসিফাসের পাথর গড়ানো
করিন্থের রাজা সিসিফাস ছিলেন প্রচণ্ড নিষ্ঠুর, দয়ামায়ার ছিটেফোঁটাও তার মাঝে ছিল না। রাজ্যের পথিক কিংবা নতুন আসা ভ্রমণকারী পথচারীদের হত্যা করে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। দিনের পর দিন তার অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছিল বৈ কমছিল না। হয়তো বাকি সময়টাও এভাবেই কেটে যেত, যদি না তিনি দেবরাজ জিউসের ক্ষতি করে বসতেন।
গ্রিক উপাখ্যানের বেশিরভাগ অভিশাপ আর শাস্তির পেছনে জিউসের হাত ছিল। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুরাণে সিসিফাসের অপরাধ হিসেবে অনেক রকম ঘটনার বর্ণনা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার উল্লেখ আছে যে, সিসিফাস নাকি জিউসের কোনো এক জলকুমারীর গোপন অবস্থান সবার কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। আবার অনেকে এটাও বলে থাকেন যে, জিউস নাকি পৃথিবী থেকে এজিনা নামের একটি মেয়েকে অপহরণ করে নিয়েছিলেন। এই ঘটনা আবার সিসিফাস দেখে ফেলেন। তিনি তখন এজিনার বাবা অ্যাসোপাসের কাছে নিজ রাজ্য করিন্থে একটি সুমিষ্ট পানির ঝর্ণার বিনিময়ে এই তথ্যটি পাচার করে দেন। দেবতারা এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
জিউস তখন সিসিফাসকে পাতালের কারাগার টারটারাসে পাঠিয়ে দেন চিরবন্দী হিসেবে, সেখানে একটি মসৃণ খাড়া পাহাড়ের সাথে তাকে শেকল দিয়ে আটকে রাখেন। সিসিফাসকে তিনি এক কঠিন শাস্তি দেন। আর তা হলো, একটি ভারি পাথরকে তার গড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের একেবারে চূড়া পর্যন্ত। কিন্তু চূড়ায় পৌঁছানোমাত্র পাথরটি দেবতার অভিশাপে আবার পাহাড়ের তলদেশে পড়ে যায়। সিসিফাস তখন আবার সেটিকে গড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেন। এভাবে তিনি চিরকাল ধরে একটি কঠিন পরিশ্রমের অথচ নিরাশায় ভরা একটি কাজ করে যাচ্ছেন। আর তাই পরিশ্রমলব্ধ যেকোনো কাজকে এখনও ‘সিসিফিয়ান’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
আক্টেয়ানের মৃত্যু
গ্রিক পুরাণের ১২ জন প্রধান অলিম্পিয়ান দেবতা আর দেবীদের মধ্যে আর্টেমিস হলেন একজন। তিনি ছিলেন জিউসের মেয়ে আর অ্যাপোলোর যমজ বোন, শিকারের দেবী হিসেবে সবাই তার উপাসনা করতো।
যাকে নিয়ে এবারের ঘটনা, তার নাম আক্টেয়ান, অটোনোইর ছেলে। আক্টেয়ান ছিলেন তরুণ রাজপুত্র। তবে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি সুবিধার ছিল না। তবুও তিনি মোটামুটি ভাল পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন। আক্টেয়ান ছিলেন খুব দক্ষ এক শিকারি। বিখ্যাত সেন্টর কায়রনের কাছ থেকে তিনি শিকারবিদ্যা রপ্ত করেছিলেন। একজন সাধারণ গ্রিকের মতো তিনিও শিকারের দেবী আর্টেমিসের ভক্ত ছিলেন।
একদিন আক্টেয়ান তার শিকারী হাউন্ড কুকুরের দল নিয়ে জঙ্গলে শিকারে বের হলেন। তিনি অবশ্য তখনও জানতেন না, আর কিছুক্ষণ পরই তার ভাগ্য তার সাথে কী পরিহাসটাই না করবে! সেই একই জঙ্গলে সেদিন শিকারে বেরিয়েছিলেন দেবী আর্টেমিস স্বয়ং। অনেকক্ষণ একটানা শিকারের পর আর্টেমিসের মনে হলো তিনি জঙ্গলের ভেতরের পরিষ্কার জলাশয়ে আরামদায়ক একটি গোসল সেরে নেবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ, জলপরীদের নিয়ে তিনি গোসল করতে শুরু করলেন।
আক্টেয়ান তখনও শিকারের সন্ধানে তার হাউন্ডদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন সময় তার কানে এলো পানির শব্দ। তিনি শব্দের অনুসন্ধান করতে করতে হঠাৎ করে যা দেখলেন, তাতে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। অপরূপ সুন্দরী দেবী সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় গোসল করছেন, এমন দৃশ্য দেখে কারোই স্থির থাকতে পারার কথা নয়। আক্টেয়ানের উচিত ছিল দেখামাত্রই সেখান থেকে বিদায় হয়ে যাওয়া, কিন্তু তা না করে তিনি আরেকটু ভাল করে দেখার জন্য সামনে এগিয়ে গেলেন। ঠিক এ সময়ে আর্টেমিস খেয়াল করলেন আক্টেয়ান তার গোসল করার দৃশ্য খুব মন দিয়ে দেখছে।
ব্যস, আর যায় কোথায়! আর্টেমিস রেগেমেগে একেবারে টং হয়ে গেলেন। হাতের কাছে প্রিয় ধনুকটি ছিল না, কিন্তু তাতে কী? জাদুবিদ্যায় তিনি ছিলেন পারদর্শী, হাতের এক ইশারায় বেচারা আক্টেয়ানকে চোখের পলকে হরিণ বানিয়ে দিলেন। এরপর শিস বাজিয়ে তার কুকুরদের ডাকলেন তিনি। কুকুরগুলো হরিণরূপী আক্টেয়ানকে দেখামাত্র চারদিক থেকে ঘিরে ধরল, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল তাকে। এভাবে অসহায় আক্টেয়ান নিজের পোষা কুকুরদের হাতেই বরণ করে নিলো করুণ মৃত্যু।
ফিচার ইমেজ: Yinyumin