সুকর্ণ, ইন্দোনেশিয়ার এই জাতির পিতা দুটি কারণে সারাবিশ্বে পরিচিত। প্রথমত, তিনি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি। দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উত্থানকালের প্রধান সারির নেতা। তবে নিজ দেশে তার শাসনামলে তিনি পরিচিত ছিলেন অন্য এক পরিচয়ে, স্বৈরাচারী একনায়ক। এই একনায়ক দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে ছিলেন। মর্জিমতো দেশ শাসন করেছেন, সেনাবাহিনীর উপর ভর করে জনমতের তোয়াক্কা না করে নিজেকে ঘৃণিত করেছেন। কিন্তু কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল ঠিকই বেঁধে যায়।
প্রতিনিয়ত ক্ষমতা আর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়ে অজেয় হয়ে উঠতে থাকা সুকর্ণের জন্য যুগপৎ তৈরি হতে থাকে বিদায়ের মঞ্চও। যে সেনাবাহিনীর হাত ধরে নিজেকে অজেয় ভাবতে শুরু করেছিলেন সুকর্ণ, সেই সেনাবাহিনীই হলো সেই মঞ্চের কারিগর! ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসের কোনো এক রোদ ঝলমলে সকালে সুকর্ণ যখন ঘুম থেকেও জেগে ওঠেননি, ততক্ষণে খুন হয়ে গেছে তার অনুগত সেনাবাহিনীর প্রধান ৬ জেনারেল। আকস্মিক এক সামরিক ক্যুতে পরাক্রমশালী সুকর্ণের পতন হবে, তা কি তিনি ভাবতে পেরেছিলেন?
১৯০১ সালের ৬ জুন, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) সম্ভ্রান্ত মুসলমান শিক্ষক রাদেন সুকেমি ও তার ব্রাহ্মণ স্ত্রী নাইয়োমান রাইয়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন কুসনো সস্রোদিহার্জো নামের এক শিশু।
জন্মের পরই এই শিশুর নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়, অসুখ ঘর বাঁধে দেহে। একপর্যায়ে সবাই আশা ছেড়ে দিলেও শেষপর্যন্ত সুস্থ হয়ে ওঠে শিশুটি। আর তাতে স্থানীয় রীতি মেনে শিশুটির নাম বদলে রাখা হয় ‘সুকর্ণ’। কে জানে, শৈশবেই ম এ শিশু তার ভবিষ্যৎ জীবনের প্রজ্ঞা আর প্রভাবেরই ইঙ্গিত দিয়েছিল হয়তো। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন অতটা উজ্জ্বল না হলেও ইংরেজি, ফরাসি, আরবি, ইন্দোনেশিয়ান, জার্মান, জাপানি সহ ৯টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে রীতিমতো সকলকে তাক লাগিয়ে দেন বালক সুকর্ণ।
সুকর্ণের প্রেমের জীবন বিস্তৃত এবং বিচিত্র। কৈশোরে নিজেদের বাড়ির বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে প্রেম করেন এবং বিয়েও করেন। কিন্তু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বান্দুং গিয়ে সেখানে নতুন করে প্রেমে পড়েন। এই মেয়েটিও তার বাড়িওয়ালারই মেয়ে! প্রথম বিয়ের তিন বছরের মাথায় ইনগিতি নাম্নী নিজের দ্বিতীয় প্রেমিকাকেও বিয়ে করেন সুকর্ণ। এই বিয়ে ২০ বছর টিকে থাকলেও কোনো সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হন এ দম্পতি।
মূলত সন্তানের জন্যই ইনগিতির সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান সুকর্ণ। এর কয়েকমাসের মধ্যেই ফাতেমাওয়াতি নামক এক কিশোরীর প্রেমে পড়েন চল্লিশোর্ধ সুকর্ণ। দ্রুতই তারা বিয়ে করে ফেলেন। ফাতেমাওয়াতির ঘরে জন্ম নেয়া পাঁচ সন্তানের মধ্যে মেগাওয়াতি সুকর্ণপুত্রি ইন্দোনেশিয়ার প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি হবার গৌরব অর্জন করেছিলেন। ফাতেমাওয়াতির প্রতি সুকর্ণের মোহ কাটতে বেশি দিন লাগেনি। প্রেসিডেন্ট হবার পর তিনি একে একে আরো ৬ জন নারীর সাথে প্রেম করেন এবং প্রত্যেককেই বিয়ে করেন!
বান্দুংয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে সুকর্ণ তার জীবনের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ হিসেবে মৌলিক ইসলাম ও সাম্যবাদকে গ্রহণ করেন। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রাথমিক ভাগে ইসলামিক রাষ্ট্রের কথাও তিনি ভেবেছিলেন। তথাপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে তিনি কামাল আতাতুর্কের পথ ধরে সংস্কার এবং উদারনীতি গ্রহণ করেন। ফলে রক্ষণশীলদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারান শুরুতেই।
তবে তার রাজনৈতিক আদর্শের কেন্দ্রে আছে ‘মারহেনিজম’ নামক তত্ত্ব, যা তিনি নিজেই তৈরি করেন। ‘মারহেন’ শব্দটির অর্থ সাধারণ মানুষ। মার্ক্সিজমের সর্বহারাদের সুকর্ণ প্রতিস্থাপিত করেন এই সাধারণ মানুষ তত্ত্ব দিয়ে। জাতীয়তাবাদ, ইসলাম আর মার্ক্সিজমের উপর এক দীর্ঘ প্রবন্ধও তিনি রচনা করেছিলেন। সে প্রবন্ধে নিজের তত্ত্বের সাথে জাতীয়তাবাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন। অবশ্য সুকর্ণ যে জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন সেটি গতানুগতিক জাতীয়তাবাদ নয়। সেটি মৌলিক ইসলাম আর মার্ক্সবাদের মাঝামাঝি অবস্থান করে। তার মারহেনিজমের মূল কথাই হচ্ছে স্বাধীনতা আর সার্বোভৌমত্বের লড়াই এবং স্বকীয়তার উপলব্ধি থেকে জাতীয়তাবাদের সিদ্ধি।
সুকর্ণের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ মূলত তার কলেজ জীবনেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই তিনি ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ তথা ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার কথা ভাবতেন। একদিকে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করে সন্তুষ্ট বোধ করতেন, অন্যদিকে মার্ক্সবাদের পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ সম্পর্কে জেনে শিউরে উঠতেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন পড়ে তিনি ইসলাম আর সাম্যবাদের মাঝামাঝি নিজের মতো করে নিজের অঞ্চলের জন্য উপযোগী এক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।
উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সাথে সাথেই নিজের সম রাজনৈতিক ভাবাদর্শের শিক্ষার্থীদের সাথে মিশতে শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলজামিন স্টাডিক্লাব’ নামে একটি পাঠচক্র। এই পাঠচক্রের মাধ্যমে সুকর্ণ একটি বড় সংখ্যক মানুষের কাছে স্বাধীনতার ডাক পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়লে পাঠচক্রটি নাম পরিবর্তন করে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একই পতাকাতলে আনার উদ্দেশ্য সামনে রেখে পথচলা শুরু হয় ‘পারতাই ন্যাশনাল ইন্দোনেশিয়া’ তথা পিএনআইয়ের।
পিএনআইয়ের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিষয়ক কাজকর্ম পুরোটাই ছিল গোপন। কিন্তু দ্রুতই ডাচ গোয়েন্দাদের নিকট এ তথ্য চলে যায়। ফলে গ্রেফতার হন সুকর্ণ। বিচারকার্যে সুকর্ণ স্বপক্ষের যুক্তিতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশাল এক জ্বালাময়ী আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দেন। বিচারে তাকে ৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলেও তার রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায় তার এই বক্তৃতা। পত্রপত্রিকায় এই বক্তৃতা এত বেশি প্রাধান্য পায় যে, পুরো ডাচ কলোনি আর নেদারল্যান্ড জুড়ে সুকর্ণের পক্ষে উদারপন্থীদের জনমত তৈরি, সরকারের উপর বাড়তে থাকে চাপ। ফলে এক বছরের মাথায়ই মুক্তি পান সুকর্ণ।
অবশ্য সুকর্ণের মুক্তির আগেই পিএনআই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক দল সহিংস আন্দোলন করে দ্রুত ফলাফল আনার পক্ষে ছিল। অন্য দলটির সিদ্ধান্ত ছিল ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে মুক্তির বোধ সৃষ্টি করে স্বাধীনতা আনা। মুক্তির পর সুকর্ণ প্রথম দলটির প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং মাত্র ৬ মাসের মাথায় পুনরায় গ্রেফতার হন।
এবার জেল থেকে ছাড়া পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। সুকর্ণের ভাগ্য খোলে ১৯৪২ সালে জাপানি সেনাবাহিনীর ডাচ কলোনি আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ডাচরা জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সুকর্ণকে মুক্তি দেয়। এদিকে জাপানিদের প্রতি সুকর্ণের শ্রদ্ধাবোধ ছিল আগে থেকেই। জাপানি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিতোশি ইমামুরা সুকর্ণকে প্রধান করে ইন্দোনেশিয়ানদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সুকর্ণ সানন্দে এই প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই জাপানিদের বন্ধুত্বের কারণ উদঘাটন করতে সক্ষম হন সুকর্ণ। দেখা গেল, জাপানি সৈন্যরা ইন্দোনেশিয়ার লাখো মানুষকে জোর করে অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করাতে শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধে নিয়োজিত সৈন্যদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহেই ইন্দোনেশিয়ান উৎপাদনের সিংহভাগ চলে যাচ্ছিল। ফলে সাধারণ জনগণের মাঝে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আর সুকর্ণও জাপানিদের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। ঘোষণা করেন তার বিখ্যাত ৫ দফা দাবি।
- পরম করুণাময় আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং অন্য ধর্মের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।
- আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং মানবতাবাদ।
- সকল ইন্দোনেশিয়ানদের (তৎকালীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের জনগণকে বোঝানো হয়েছে) ঐক্য।
- গণতন্ত্র।
- ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার।
সুকর্ণ যখন ৫ দফা প্রচার করছিলেন, ততদিনে জাপানও অবশ্য কোণঠাসা হয়ে এসেছে। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেও ইন্দোনেশিয়ায় রয়ে যাওয়া জাপানি সৈন্যদের ভয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে সময় নিচ্ছিলেন সুকর্ণ। কিন্তু তার দলীয় সমর্থকদের চাপের মুখে ১৮ আগস্টেই নিজ বাড়ির সামনে একটি ছোটখাড় শ্রোতাসমষ্টির সামনে স্বাধীন ‘ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেন সুকর্ণ। সাথে সাথে নিজেকে রাষ্ট্রপতি এবং বন্ধু মোহাম্মদ হাত্তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। কয়েক মাসের মধ্যে পূর্বে ঘোষণা করা ৫ দফাকে যুক্ত করে নতুন সংবিধানও প্রণয়ন করেন সুকর্ণ। তবে জাভা আর সুমাত্রা ছাড়া আশেপাশের অঞ্চলগুলো তখনো জাপান আর ডাচদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুকর্ণের জন্য এটা ছিল বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
মূল বিপত্তির শুরু হয় ব্রিটিশদের আগমনের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশরা প্রথমে ইন্দোনেশিয়ায় বন্দি হওয়া ৭০ হাজার জাপানি সৈন্যকে দেশে ফেরত পাঠায়। এরপর ডাচদের সেখানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইন্দোনেশিয়াকে আবারো ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ’ হিসেবে নামকরণ করে। ব্রিটিশদের সহযোগীতায় ডাচরা আবারো ইন্দোনেশিয়া কব্জা করার সুযোগ পায়। এদিকে জাপানিদের সাথে কাজ করার অভিযোগে সুকর্ণের বিচার করার ইচ্ছা ছিল ব্রিটিশদের, যদিও তার তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে তারা তা করতে পারেনি। তবে ব্রিটিশদের চাপে রাষ্ট্রপতির সমান ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে বাধ্য হন সুকর্ণ।
অন্যদিকে বিতাড়িত ডাচরা দ্বিতীয়বার ক্ষমতার বলয়ে ফিরে আসতে পেরে পূর্বের চেয়ে আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তারা অত্যাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে সাধারণের সাথে প্রতিনিয়ত তাদের কলহ বাঁধতে থাকে, জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীও। বিশৃঙ্খলা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছালে তা দাঙ্গায় রূপ নেয়, শত শত ইন্দোনেশীয় মারা যায়, নিহত হয় ৩ শতাধিক ব্রিটিশ সৈন্য। এ ঘটনার পর ব্রিটিশরা দ্রুত তল্পিতল্পা গুটিয়ে ডাচদের ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ত্যাগ করে।
স্বাধীনতাকামী ইন্দোনেশীয় জনগণকে বশে রাখতে সামরিক পদক্ষেপই গ্রহণ করে ডাচরা। রক্তপাত বন্ধে দেশীয়দের পরামর্শ উপেক্ষা করে ডাচদের সাথে একটি সন্ধি করেন সুকর্ণ, যেখানে কেবল জাভা আর সুমাত্রার শাসনক্ষমতা সুকর্ণের সরকারকে দেয়া হয়। অন্য সকল দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ থেকে যায় ডাচদের হাতেই। এই চুক্তিও বেশিদিন টেকেনি। সুকর্ণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া আক্রমণ করে ডাচরা।
‘অপারেটি প্রোডাক্ট’ নামক সেই সামরিক অভিযানে ডাচরা জাভা সহ সুমাত্রার কৃষি জমির একটা বড় অংশই দখল করে নেয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অভিযান বন্ধ করলেও এক বছরের মাথায় ‘অপারেটি ক্রাই’ শুরু করে ডাচরা। এ অভিযানে সমগ্র ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয় তারা, গ্রেফতার করে সুকর্ণ, হাত্তা সহ দেশের প্রথম সারির নেতাদের। তবে এখান থেকেই ডাচদের পতনের শুরু।
তাদের এই সামরিক অভিযানে বিশ্বনেতারা সরব হয়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সার্বিক সহযোগীতা বন্ধের হুমকি দেয়, জাতিসংঘও চালাতে থাকে নানান প্রয়াস আর ইন্দোনেশিয়ায় যুগপৎ চলতে থাকে সুকর্ণের অনুসারী স্বাধীনতাকামীদের গেরিলা আক্রমণ। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানামুখী চাপের মুখে ১৯৪৯ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চলে যাবার ঘোষণা দেয় ডাচরা।
১৯৫০ সালে আগস্টের মাঝে ইন্দোনেশিয়া পুরোপুরি ডাচমুক্ত হয়ে যায়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে সুকর্ণের কাজকর্ম নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। তবে জাতির পিতা হিসেবে যথেষ্টই প্রভাব খাটানোর সুযোগ ছিল তার। খুব দ্রুতই দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। শাসন কাঠামোয় ক্ষমতার বৈষম্য নিয়ে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ, সাম্প্রদায়িকতা আর স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয় সংঘাত। প্রভাবহীন হতে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্র। হিন্দু, মুসলিম আর খ্রিস্টানদের মধ্যে বিভেদ চরমে ওঠে। পৌত্তলিক চীনা আর স্বদেশিদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। প্রগতিশীল আর নাস্তিকদের উপর খড়গহস্ত হতে শুরু করে উগ্রপন্থীরা।
এসব সমস্যা ছাপিয়ে যায় দেশের পুলিশ প্রশাসন আর সেনাবাহিনীতে স্বাধীনতাকামী গেরিলা আর জাপানিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত সৈন্যদের মধ্যকার বিভেদ! বিভেদ আর দাঙ্গার চূড়ান্ত পর্যায়ে সাবেক গেরিলারা একত্রিত হয়ে সুসজ্জিত ট্যাংক আর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুকর্ণের বাড়ি ঘেরাও করে এবং জাতির পিতাকে দেশের ক্রান্তিকালে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়। সুকর্ণ একাকী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। সেদিন হাজার খানেক অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যকে ব্যারাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল তার মুখনিঃসৃত কিছু কথা!
দেশের পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হতে থাকলে সুকর্ণ অনুধাবন করলেন, গণতন্ত্র ইন্দোনেশিয়ায় ফলানো সম্ভব নয়। তিনি তাই ‘গাইডেড ডেমোক্রেসি’ নামে গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্রের পরিকল্পনা করলেন। ‘গাইড’ বা পরিচালক হিসেবে রাষ্ট্রপতির আসনে থাকবেন সুকর্ণ, আর দেশ চলবে লোক দেখানো গণতান্ত্রিক পন্থায়। এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাত্তা। আবার হাত্তাকে পুনর্বহালের দাবিতে সামরিক অভ্যুত্থান করে বসে সুমাত্রা ও সুলাওয়েসির দুজন কমান্ডার। কিন্তু এসবে কর্ণপাত না করে ১৯৫৭ সালের মার্চে সুকর্ণ ‘গাইডেড ডেমোক্রেসি’ ঘোষণা করেন। আর যতদিন পর্যন্ত দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ না হয়, ততদিন পর্যন্ত সামরিক আইন জারি করেন!
অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হাতে নিয়েই কঠোর হতে শুরু করেন সুকর্ণ। এক বছরের মধ্যে তাকে দুবার হত্যাচেষ্টা চালানো হলে তিনি তার বিরোধীদের মাঝে চিরুনি অভিযান চালান এবং গণগ্রেফতারের আদেশ দেন। ডাচ আর চীনাদের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অধিক কঠোর। ১৯৬০ সালের মধ্যেই দেশ থেকে ৪০ হাজারের মতো ডাচ নাগরিককে বের করে দেয়া হয়, বাজেয়াপ্ত করা হয় তাদের যাবতীয় সম্পত্তি।
অন্যদিকে চীনাদের প্রতি তার কঠোর মনোভাবে বাধ্য হয়ে লক্ষাধিক চীনা নাগরিক দেশে ফিরে যায়। আর সুমাত্রা ও সুলাওয়েসির বিদ্রোহীদের দমন করতে পূর্ণ শক্তির সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন সুকর্ণ। ১৯৬১ সালের মাঝেই বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে। বিদ্রোহীদের দমনের পর পূর্ণমাত্রায় ফ্যাসিবাদী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অসীম মাত্রায় বৃদ্ধি করেন। সংসদের অর্ধেক সদস্যকে বিনা ভোটে নিজের ইচ্ছায় নির্বাচিত করার ক্ষমতা সংক্রান্ত আইন পাস করেন!
তাছাড়া নানা ধরনের কালো আইন পাস করিয়ে বিরোধী পক্ষকে কাবু করায় তার জুড়ি ছিল না। তার সমালোচনা করায় বন্ধ করে দেয়া হয় একটি পত্রিকা, যা ছিল অন্যদের জন্য সতর্কবার্তা। এত কিছুর মাঝেও নিজেকে কেবল সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল না রাখতে কমিউনিস্টদেরও সংসদের জায়গা করে দিতে লাগলেন সুকর্ণ, যারা তাকে অন্ধের মতো সমর্থন করতো।
পতনের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে ১৯৬৩ সালে সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দেশের সকল শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে তার লেখা এবং বক্তৃতাসমূহ ছাপানো হয়। পত্রিকাগুলোকে বাধ্য করা হয় কেবল তার ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য। নিজের সম্মানে নিজেই দেশের সর্বোচ্চ চূড়ার নামকরণ করে ‘পুন্টজাক সুকর্ণ’ বা সুকর্ণ চূড়া!
এত আইন কানুন বানিয়ে সুকর্ণ ভেবেছিলেন তার প্রতিযোগী আর রইলো না দেশে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল সুকর্ণকে উৎখাত করার মতো শক্তি আসলেই হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার অগোচরে ঘটে যায় অনেক কিছুই। সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশই সুকর্ণের কমিউনিস্ট প্রীতিকে ভালো চোখে দেখেনি। আবার নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার তালে থাকা সুকর্ণ দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভাববার অবকাশই পাননি। ফলে ১৯৬৫ সালে মুদ্রাস্ফীতি ৬০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়! এতে দিনমজুর আর কৃষক শ্রেণীর জনগণ সুকর্ণের সরকারের উপর অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
১৯৬৫ সালের এপ্রিলের দিকে কমিউনিস্ট আর সেনাবাহিনীর মাঝে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় সেই বছর অক্টোবর মাসের ১ তারিখ সেনা সদস্যদের একটি গ্রুপ ৬ জন জেনারেলকে হত্যা করে। তারা প্রাথমিকভাবে দাবি করে যে, সুকর্ণের বিরুদ্ধে ভবিতব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থান রুখতেই তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছে! পাশাপাশি সংসদ ভেঙে দেয়া হয়, অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতা ও রাজনৈতিক কর্মীকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
এ সময়কার ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক বিশ্লেষকই সন্দেহ প্রকাশ করেন, এখানে ব্রিটিশ আর মার্কিনীদের হাত থাকতে পারে। যা-ই হোক, অক্টোবরের ২ তারিখ বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের গ্রুপের প্রধান সুহার্তো নিজেকে সেনা প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। আর সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েই দেশে কমিউনিস্ট আর বামপন্থী ‘নিষ্কাশনের’ মিশন হাতে নেন সুহার্তো! মাত্র এক বছরেই সমগ্র ইন্দোনেশিয়া ৫ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেন সুহার্তো, গ্রেফতার করেন কমপক্ষে ১৫ লক্ষ মানুষ!
শেষ চেষ্টা হিসেবে রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন সুকর্ণ। সুহার্তোর বিরুদ্ধে সর্বসাধারণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান তিনি। প্রাথমিকভাবে এ ভাষণ কাজেও দিয়েছিল। সুকর্ণের হাজারো সমর্থক রাস্তায় নেমেছিল। তবে ততদিনে সুকর্ণের জনপ্রিয়তা আর আগের মতো নেই। তার সমর্থনে রাস্তায় নামাদের চেয়ে সুহার্তোর সমর্থনে রাস্তায় নামাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। ফলে সুহার্তোও আর দেরি করতে চাননি।
মার্চের ১১ তারিখ বন্দুকের নলের মুখে সুকর্ণকে ‘সুপারসিমার’ নামক প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারে সই করতে বাধ্য করেন সুহার্তো, যে আদেশ বলে দেশের সমস্ত ক্ষমতা জেনারেল সুহার্তোর কাঁধে অর্পিত হয়। সুকর্ণ সুপারসিমারে বন্দুকের নলের মুখে সই করেছিলেন কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। আক্ষরিক অর্থে দেশের সর্বময় ক্ষমতা হাতে পেলেও তাৎক্ষণিকভাবে সুকর্ণকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে নামানো হয়নি।
সুহার্তোর হাতের পুতুল হয়ে আরো এক বছর রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন সুকর্ণ, যা বহির্বিশ্বের কাছে সুহার্তোর ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দেয়নি। অবশেষে ১৯৬৭ সালের মার্চে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সুকর্ণকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অভিশংসিত করে গৃহবন্দী করা হয়। অসুস্থ সুকর্ণের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেনি সুহার্তোর সামরিক সরকার। ফলে দ্রুত স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে সুকর্ণের।
১৯৭০ সালের ২১ জুন জাকার্তার সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন সুকর্ণ। পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে তার কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার নায়ক, যাকে কি না সর্ব সাধারণ জাতির পিতার আসনে বসিয়েছিল, যিনি সকল ক্ষমতা কেন্দ্রে বসে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেই সুকর্ণই শেষকালে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে গিয়ে মানুষের মনে খলনায়কের আসন পেয়েছেন, অথচ তিনি ইন্দোনেশিয়ানদের মহানায়ক হয়েই ইতিহাসে অমর হতে পারতেন!