Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাটারফ্লাই ইফেক্ট: কী এবং কেন?

‘আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’ এর ১৩৯ তম অধিবেশনে গণিতবিদ এবং আবহাওয়াবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ একটি বিশেষ প্রশ্নের উত্থাপন করেছিলেন। প্রশ্নটি ছিলো এমন যে, ব্রাজিলে যদি কোনো একটি প্রজাপতি তার ডানা ঝাপটায়, তবে সেই ডানা ঝাপটানোর সুবাদে টেক্সাসে টর্নেডো হতে পারে কি না?

প্রশ্নটি শুনে অনেকেই এডওয়ার্ড লরেঞ্জকে মানসিক বিকারগ্রস্ত সাব্যস্ত করতে পারেন। কারণ- প্রথমত, প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর কারণে আর যা-ই হোক, টর্নেডো হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যদি টর্নেডো হয়েই থাকে, তবে ব্রাজিলে না হয়ে সেটা টেক্সাসে হবে কী করে! কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর আমরা যা জানি, তা নাও তো হতে পারে। প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর কারণে টর্নেডো হতেও পারে। আসলে এই অদ্ভুত তত্ত্বকেই ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ বা প্রজাপতি প্রভাব বলা হয়ে থাকে। এই প্রজাপতি প্রভাব নিয়ে চলুন জেনে নেয়া যাক।

ব্রাজিলে প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে কি টেক্সাসে টর্নেডো হতে পারে! Image Source: vox.com

এডওয়ার্ড লরেঞ্জ এবং বাটারফ্লাই ইফেক্ট ধারণার উৎপত্তি

“সাধারণত ধারণা করা হয় যে, যেসব ঘটনা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে, সেসবের মধ্যে আছে পারমাণবিক বোমা, উন্মাদ রাজনীতিবিদ, বড়সড় ভূমিকম্প অথবা কোনো গণআন্দোলন। কিন্তু আধুনিক চিন্তাধারার কারণে মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, এসব আসলে তাদের ভুল ধারণা। Chaos Theory বা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস বা ঘটনার পরিবর্তন সমগ্র পৃথিবীর পরিবর্তন করতে পারে। একটি প্রজাপতি যখন আমাজন জঙ্গলে ডানা ঝাপটায়, তখন এর ফলে বাকি অর্ধেক ইউরোপে তখন ঝড় হতে পারে।”

–‘গুড ওমেনস’ (Good Omens)

যদিও বাটারফ্লাই ইফেক্ট সম্পর্কে বিতর্ক কম নেই, কিন্তু প্রথম এই তত্ত্বের শনাক্তকারী হিসেবে এডওয়ার্ড লরেঞ্জকে ভূষিত করা হয়। এডওয়ার্ড লরেঞ্জ ছিলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির আবহাওয়াবিদ্যার অধ্যাপক এবং একজন গণিতবিদ, যিনি সর্বপ্রথম বাটারফ্লাই ইফেক্টের কথা বলেন।

তিনি মূলত তার এই দু’টি বিভাগকে, অর্থাৎ আবহাওয়াবিদ্যা এবং গণিতকে একীভূত করেন এবং ক্যাওস থিওরি প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৫০ সালে তিনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার জন্য নতুন পদ্ধতির সন্ধান করছিলেন। কারণ সাধারণ যে মডেল ছিলো, তাতে সঠিক পূর্বাভাস দেয়া ছিল খুবই চ্যালেঞ্জের। এই সন্ধান থেকেই তিনি গণিতের সাহায্যে নতুন তত্ত্ব হিসেবে বাটারফ্লাই ইফেক্ট আবিষ্কার করেন।

প্রজাপতি প্রভাব তত্ত্বের জনক এডোয়ার্ড লরেঞ্জ; Image Source: azquotes.com

সাধারণত বিস্ময়কর, অরৈখিক এবং অনিশ্চিত ঘটনাসমূহের বিজ্ঞানকে বলা হয়ে থাকে ক্যাওস (Chaos) বা বিশৃঙ্খলার বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের অন্যসব শাখা সাধারণত সরলরৈখিক, গণিতনির্ভর এবং নির্দিষ্ট ফলাফল প্রাপ্তির ঘটনা নিয়ে কাজ করে, যেমন- তড়িৎ বিজ্ঞান, মহাকর্ষ কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়া। এসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মান কিংবা নির্দিষ্ট শর্তাবলীর জন্য যে মান পাওয়া যাবে, তা গণনা করে বের করা সম্ভব।

কিন্তু বিশৃঙ্খলা তত্ত্বে সাধারণত যেসব ঘটনার সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, সেসব ঘটনাই বর্ণনা করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শেয়ার মার্কেট, আবহাওয়া, মানুষের মনস্তত্ত্ব, ব্যবসা ইত্যাদি- যেসব সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়।

যদিও প্রজাপতির পাখা ঝাপটানো নিয়ে লরেঞ্জ তার এই প্রশ্নে আসলে এটা বোঝাতে চাননি যে, আসলেই পৃথিবীর এক স্থানে প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে আরেক স্থানে টর্নেডো হয়। বরং তিনি তার এই অদ্ভুত প্রশ্নের মাধ্যমে এটিই দেখাতে চেয়েছিলেন যে, কোনো বৃহৎ এবং জটিল সিস্টেমের ক্ষুদ্র পরিবর্তনের কারণে সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য কতখানি বদলে যেতে পারে। তিনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস গণনা করার জন্য এই নতুন তত্ত্ব কাজে লাগান।

গাণিতিক মানের সামান্য পরিবর্তন সিস্টেমের উপর বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে; Image Source: fs.blog

লরেঞ্জ আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার জন্য প্রাথমিক শর্ত হিসেবে একটি গাণিতিক মান ব্যবহার করেন, যার মান ০.৫০৬। এই মান আসলে আরো একটু বিস্তৃত ছিলো, অর্থাৎ দশমিকের পরে আরো অঙ্ক ছিলো। এর মান ছিলো ০.৫০৬১২৭। তিনি যখন দশমিকের পরে ছয় অঙ্ক নিয়ে গণনা করলেন, তখন একটি মান আসলো। কিন্তু যখন দশমিকের পরে তিন অঙ্ক নিয়ে গণনা করলেন, সেই ফলাফল ছিলো পূর্বের ফলাফলের থেকে অনেকখানি আলাদা। অথচ শুধু দশমিকের পরে কেবল তিন অঙ্কই বাদ দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু ফলাফলে দেখা গেলো অনেক পরিবর্তন।

এভাবে তিনি কম্পিউটার প্রোগ্রামে প্রায় ১২টি মান প্রদান করেন (এই মানগুলো ছিলো মূলত তাপমাত্রা, বাতাসের গতি, আর্দ্রতা ইত্যাদির)। এর থেকে লরেঞ্জ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে মানের সামান্য পরিবর্তনের জন্য এর উপর যে প্রভাব পড়ে, সেটি মোটেও সামান্য নয়, বরং ব্যাপক। এভাবেই জন্ম নিলো বাটারফ্লাই ইফেক্ট নামক বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব।

বাটারফ্লাই ইফেক্টের সাথে প্রজাপতির সম্পর্ক

এডোয়ার্ড লরেঞ্জ তার গবেষণালব্ধ ধারণাকে পেপার আকারে প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম দেন ‘ডিটারমিনিস্টিক ননপিরিয়ডিক ফ্লো’ (Deterministic Nonperiodic Flow)। এটি পরবর্তীতে পুরস্কার পায়। তার এই গবেষণাপত্রের মূলকথা ছিলো এই যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মডেলসমূহ পুরোপুরি শুদ্ধ নয়। এর কারণ সঠিকভাবে প্রাথমিক শর্ত বা অবস্থার মান পাওয়া বা সেটা নিয়ে গণনা করা সম্ভব নয়। একইসাথে সামান্য পরিবর্তনের কারণে পূর্বাভাসে বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে। এই তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করতে গিয়েই লরেঞ্জ প্রজাপতি প্রভাবের ধারণা দেন। এই ধারণাকে সিস্টেমের ‘প্রাথমিক শর্তাবলীর সংবেদনশীল নির্ভরতা’ নামেও অভিহিত করা হয়।

তবে এই প্রভাবকে ‘প্রজাপতি প্রভাব’ বলার পেছনে আরো একটি কারণ আছে। লরেঞ্জ যখন তার এই আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন আবহাওয়ার বিভিন্ন প্রভাবক যেমন তাপমাত্রা, বাতাসের গতি বা আর্দ্রতার অনেকগুলো মান ব্যবহার করেছিলেন, সেটা আগে বলা হয়েছে।

তো তিনি দেখলেন তিনি প্রতিবারই আলাদা ফলাফল পাচ্ছেন। কিছুতেই তিনি একটি নির্দিষ্ট ফলাফল আবার তৈরি করতে পারছেন না। তিনি বিভিন্ন প্রভাবকের মানও একটু হেরফের করে দেখলেন, কিন্তু প্রতিবারই ভিন্ন ফলাফল আসতে থাকে। তার ব্যবহৃত এসব মানকে গ্রাফে বসালে এমন একটি গ্রাফ পাওয়া যায়, যা দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। এ কারণেও তার এই তত্ত্বের সাথে প্রজাপতির নাম জুড়ে গেছে।

লরেঞ্জের প্রজাপতি সদৃশ গ্রাফ; Image Source: pt.wikipedia.org

বাটারফ্লাই ইফেক্ট নিয়ে প্রচলিত আছে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-

নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ

জাপানের নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার ভয়াবহতা জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে যে, মার্কিন পাইলটদের নাগাসাকিতে সেদিন পারমাণবিক বোমা ফেলার কথা ছিলো না। তাদের লক্ষ্য ছিলো জাপানের আরেকটি শহর কুরোকো। কুরোকোর সামরিক অস্ত্রঘাঁটিই ছিলো তাদের মূল লক্ষ্য।

কিন্তু যখন মার্কিন বোমারু বিমান কুরোকো শহরে বোমা ফেলার উদ্দেশ্যে উড়লো, তখন কুরোকোর আকাশে ছিলো মেঘ। পাইলটেরা এই মেঘ ভেদ করে অস্ত্রঘাঁটি কোনোভাবেই দেখতে পেলেন না। তারা তিনবার চেষ্টা করলেন টার্গেটে আঘাত হানার। কিন্তু শুধুমাত্র মেঘের কারণে সেটা সম্ভব হলো না। ফলে মার্কিন পাইলটরা সিদ্ধান্ত নিলেন নাগাসাকিতে বোমা ফেলার এবং সেটাই করা হলো।

বিধ্বস্ত নাগাসাকি শহর; Image Source: historynet.com

এই সামান্য মেঘের কারণেই কুরোকো শহর এই ভয়ংকর বোমা বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পেলো। অপরদিকে এই সামান্য মেঘের কারণে নাগাসাকি মার্কিন পাইলটদের টার্গেট না হয়েও ধ্বংস হয়ে গেলো। কুরোকো শহরকে তাই বলা হয় জাপানের সৌভাগ্যবান শহর। এই যে সামান্য মেঘের কারণে দুই শহরের অবস্থা হলো দু’রকম, অথচ এরকম হওয়ার কথা ছিলো না, এখানেও কিন্তু এই বাটারফ্লাই ইফেক্ট দেখা যাচ্ছে।

ভিয়েনা একাডেমি অফ ফাইন আর্ট কর্তৃক এ্যাডলফ হিটলারের আবেদন প্রত্যাখ্যান

এ্যাডলফ হিটলারের নাম শোনেনি বা তার সম্পর্কে জানে না এমন মানুষও আসলে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু হিটলার কখনোই হিটলার হতেন না যদি না ফাইন আর্ট একাডেমি তার আবেদনপত্র প্রত্যাখ্যান করতো। হিটলার যখন ফাইন আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করলেন, তখন তাকে সেখান থেকে প্রত্যাখ্যান করা হলো। একবার নয়, দু দু’বার।

তার এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন একাডেমির একজন ইহুদি অধ্যাপক। যদি হিটলারকে দ্বিতীয়বারেও একাডেমি গ্রহণ করতো, তাহলেও আজ হিটলার সবার কাছে একজন স্বৈরাচারী হিটলার হিসেবে পরিচিত না হয়ে একজন শিল্পী হিসেবে পরিচিত হতে পারতেন। ইহুদীদের প্রতি তার পরবর্তীকালের অত্যাচার সকলেরই জানা আছে। এখানেও আছে এই বাটারফ্লাই ইফেক্ট। সামান্য প্রত্যাখ্যান হিটলারের জীবনের গতিপথই পাল্টে দিলো।

চেরনোবিল বিপর্যয়

চেরনোবিলের নিউক্লিয় চুল্লী বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেও বাটারফ্লাই ইফেক্টের নমুনা পাওয়া যায়। কারণ অপারেটরদের সামান্য বেখেয়াল আর ভুলের কারণে চেরনোবিল এখন জনমানবহীন এক ভৌতিক শহর। চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রে ৪ নং চুল্লীতে অপারেটররা একটি খেয়ালী পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তারা মেইন পাওয়ার অফ করে মাত্র ৭ শতাংশ শক্তিতে চুল্লী চালাতে চেষ্টা করেছিলেন। সামান্য এই ভুলের কারণে এর পরিণাম হলো ভয়াবহ।

প্রায় তিন দশক আগে ঘটে যাওয়া এই বিস্ফোরণের পর এখনো সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠার মতো কোনো সম্ভাবনা নেই। আগামী এক শতক বা সহস্রাব্দেও সেটা বসবাসের উপযোগী হবে বলেও গবেষকরা মনে করছেন না।

জনমানবহীন চেরনোবিল; Image Source: geohistory.today

বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন এই বাটারফ্লাই ইফেক্টকে একটু কবিত্ব দিয়ে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে,

“একটি পেরেকের অভাবে জুতা ব্যবহার হলো না

জুতার অভাবে ঘোড়াও চলতে পারলো না

ঘোড়ার অভাবে ঘোড়ার সহিসও থাকলো না

ঘোড়ার সহিসের অভাবে যুদ্ধে জেতা গেলো না

যুদ্ধে হারার কারণে রাজত্ব হারিয়ে গেলো

শুধুমাত্র ঘোড়ার জুতার একটি পেরেকের অভাবেই এতকিছু হলো”

ফিচার ইমেজ: genestrother.com

Related Articles