২২ জুন অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় অ্যাপলের বার্ষিক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ডেভেলপার কনফারেন্স (WWDC)। মহামারীর কারণে এই প্রথম অ্যাপল কনফারেন্সটি অনলাইনে নেয়। ২২-২৬ জুন পর্যন্ত চলে কনফারেন্সটি। মূলত এই কনফারেন্সে অ্যাপল তাদের প্রোডাক্ট লাইন-আপের বিভিন্ন ফিচার প্রকাশ করে। এবারের WWDC-তে অ্যাপলের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল তাদের ইন্টেল থেকে নিজস্ব প্রসেসরে শিফট হওয়া। অর্থাৎ অ্যাপল তাদের নতুন ডিভাইসগুলোতে আর ইন্টেলের প্রসেসর ব্যবহার করবে না।
অ্যাপল শুধু প্রসেসরই পরিবর্তন করেনি, করেছে পুরো আর্কিটেকচারের পরিবর্তন। তারা ঘোষণা দিয়েছে ২০২২ সালের মাঝে সকল প্রকার ডিভাইস, অ্যাপস তাদের বর্তমান থেকে নতুন আর্কিটেকচারে শিফট করবে। এখন প্রশ্ন হলো- এর অর্থ ভোক্তাদের জন্য কী দাঁড়াবে? এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিতে এর প্রভাব কতটুকু? আর কেনই বা ইন্টেলের জন্য এটা দুঃসংবাদ?
প্রসেসর আর্কিটেকচার
মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে মৌলিক ধারণাগুলো পরিষ্কার করে নেয়া যাক। একটি প্রসেসর কীভাবে কাজ করবে, কতটা দ্রুতগতির হবে এসব নির্ভর করে প্রসেসর ডিজাইন বা আর্কিটেকচারের উপর। প্রতিটি প্রসেসর কিছু ইন্সট্রাকশন সেট নিয়ে কাজ করে। ইন্সট্রাকশন সেট প্রসেসরকে বলে দেয় তাকে কী নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যখন কোনো সফটওয়্যার বা প্রোগ্রাম চালু করি তখন তা মেশিনের ভাষায় (০ এবং ১) রুপান্তরিত হয় এবং ইন্সট্রাকশন সেট তাদের পথ দেখিয়ে দেয় যে কী করলে, কোন ঠিকানায় গেলে প্রোগ্রামটি তার কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত দুটি প্রসেসর আর্কিটেকচার, যার দ্বারা পৃথিবীর প্রায় সকল কম্পিউটার পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো হলো x86 এবং -x86-64। x86 কে ৩২ বিট এবং x64 কে ৬৪ বিট বলে ধরে নেয়া হলেও এর মাঝে আরও কিছু টেকনিক্যাল বিষয় রয়েছে যা বৃহৎ এবং এখানে অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় আলোচনা করা হলো না।
এর বাইরে আমাদের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সকল ছোটখাট ডিভাইস চলছে ভিন্ন এক আর্কিটেকচারে। সেটির নাম ARM। ARM প্রসেসরগুলো ভিন্ন আর্কিটেকচারে চলে কারণ ইন্টেলের তৈরি করা X86 আর্কিটেকচার শুধু ইন্টেলের বাইরে এএমডিসহ হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির ব্যবহারের বৈধতা রয়েছে। X86 একটি অসাধারণ আর্কিটেকচার, যার ফলে আমরা এত দ্রুতগতির কম্পিউটার প্রসেসর পাচ্ছি এবং বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান সহজেই করা যাচ্ছে। ARM ব্যবহার করা হয় সোজাসাপ্টা সমস্যা সমাধানের জন্য, যার ফলে এটি অনেক কম এনার্জি খরচ করেই কাজ সমাধা করতে পারে। এজন্য সকল প্রকার ডিভাইস, যেগুলো বিশেষ করে ব্যাটারির উপর নির্ভরশীল, সেগুলোতে ARM ব্যবহার করা হয়। এবং যত কম এনার্জি তত কম হিট উৎপন্ন হবে, এটিও ARM প্রসেসরের একটি সুবিধা। সহজ কথায় X86 আর্কিটেকচার ভারী কাজের জন্য এবং ARM আর্কিটেকচার হালকা কাজের জন্য।
তো আর্কিটেকচার নিয়ে এত বক বক করার কারণ হচ্ছে কোনো প্রোগ্রাম তৈরির আগে সেটি কোন আর্কিটেকচারে চলবে তা নির্ধারণ করে তৈরি করতে হয়। অর্থাৎ X86 আর্কিটেকচারকে লক্ষ্য করে তৈরি কোনো প্রোগ্রাম ARM-এ চলবে না। একই কথা X86 এর ক্ষেত্রেও। এখন আরেকটি বিষয় মাথায় আসতে পারে যে, স্মার্টফোনগুলোতে তো স্নাপড্রাগন, মিডিয়াটেক, বায়োনিক এসব ব্যবহারের কথা শুনেছিলাম, তাহলে ARM আসলো কোথা থেকে! আসলে ARM Holdings (ARM আর্কিটেকচার নির্মাতা) শুধু প্রসেসর ডিজাইন তৈরি করে, তারা কোনো প্রসেসর তৈরি করে না। এই ডিজাইনগুলো স্যামসাং, অ্যাপল, কোয়ালকম কিনে মডিফাই করে তাদের নিজস্ব চিপ তৈরি করে।
অ্যাপল সিলিকন কী?
মূলত অ্যাপল সিলিকন হচ্ছে একটি SoC (System on a Chip)। এখন SoC আবার কী জিনিস? সাধারণত একটি প্রসেসরে শুধু প্রসেসর কম্পোনেন্টই থেকে থাকে, কিন্তু একটি SoC-তে একটি ডিভাইস পরিচালনার জন্য প্রধান জিনিসসমূহ, যেমন- প্রসেসর, গ্রাফিক্স, মেমোরি, সিকিউরিটি ফিচার সব একসাথে থাকে।
অ্যাপল সিলিকন যে নতুন তা কিন্তু নয়! তারা তাদের আইফোন, আইপ্যাডে এর ব্যবহার করে আসছে অনেকদিন হলো। বর্তমান অ্যাপলের এ১৩ বায়োনিক বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির স্মার্টফোন প্রসেসর। অ্যাপল তাদের Arm প্রসেসর ডিজাইনে এত এগিয়ে গিয়েছে যে কম্পিউটার জগতে তারা অ্যাপল সিলিকন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
অ্যাপল এমন পরিবর্তন আগেও করেছিল। ১৯৯৪ সালে তারা 68K থেকে PowerPC পিসি প্রসেসরে শিফট করে এবং ২০০১ সালে ম্যাক ওএস নতুন করে তৈরি করে প্রকাশ করে তারা। এরপর ২০০৬ সালে PowerPC থেকে ইন্টেলে শিফট করে এবং ইন্টেলভিত্তিক ম্যাকবুক প্রো ও আই ম্যাক রিলিজ করে। PowerPC থেকে ইন্টেলে শিফট হওয়ার কারণ ছিল ইন্টেল প্রসেসরগুলোর সক্ষমতা। এখন পুনরায় এই পরিবর্তনের কারণ শুধু Arm প্রসেসরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিই নয়, আনুষাঙ্গিক আরও দিক রয়েছে। এখন আলোচনা করা যাক সেসব নিয়ে।
এই পরিবর্তনের সুবিধা-অসুবিধা
অ্যাপল তাদের ইকোসিস্টেমের জন্য বিখ্যাত। অ্যাপলের প্রতিটি ডিভাইসের অন্তর্বর্তী কার্যক্রম অত্যন্ত সুগঠিত এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ার কারণেই তাদের একটি নির্দিষ্ট ফ্যানবেজ তৈরি হয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত মানুষ অ্যাপলের ইকোসিস্টেমে শিফট হচ্ছে। তবে স্মার্টফোনের তুলনায় ম্যাকবুক কিংবা আইম্যাকে এই রূপান্তরের হার অনেক কম। ম্যাকবুক-আইম্যাক ছাড়া অ্যাপল তাদের প্রতিটি ডিভাইসে অ্যাপল সিলিকন ব্যবহার করেছে। ফলে অ্যাপল পেয়েছে তাদের প্রোডাক্টের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তি সাশ্রয়
Arm-ভিত্তিক প্রসেসরের অগ্রগতি সত্যিই প্রশংসনীয়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রতগতির সুপার কম্পিউটার Arm-ভিত্তিক প্রযুক্তিতে চালিত হচ্ছে। এছাড়া অ্যাপলের বর্তমান A13 Bionic তাদের প্রথম Arm-ভিত্তিক প্রসেসর A4 এর থেকে প্রায় শতগুণ শক্তিশালী। এ থেকে বোঝা যায় যে অ্যাপল তাদের প্রযুক্তিতে কতটা এগিয়েছে এবং উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে।
প্রসেসর জগতে একটি টার্ম রয়েছে যাকে বলে Performance per watt, অর্থাৎ প্রতি ওয়াট ক্ষমতায় একটি প্রসেসর কতটুকু পারফরমেন্স দিতে পারে। এই পারফরমান্স পার ওয়াটের কারণেই অ্যাপল PowerPC থেকে ইন্টেলে শিফট করে। যেহেতু Arm প্রসেসর অনেক কম শক্তি খরচ করে অর্থাৎ একটি ৫ ওয়াটের Arm প্রসেসর যদি ১৫ ওয়াটের ইন্টেল প্রসেসরের সমান পারফরমান্স দিতে পারে তাহলে আরও একটি ১৫ ওয়াটের Arm প্রসেসর আরও বেশি পারফরমান্স দিতে সক্ষম হবে।
আর যেহেতু অ্যাপল নিজেই তাদের প্রসেসর তৈরি করবে সেজন্য তারা তাদের অপারেটিং সিস্টেমও সুন্দরভাবে অপ্টিমাইজ করার সুযোগ পাবে। যার ফলে ব্যবহার অভিজ্ঞতা আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে উঠবে, যেমনটি হয়েছে তাদের আইফোন, আইপ্যাডগুলোতে।
নতুন ফিচার ও নিউরাল ইঞ্জিন
অ্যাপলের নিউরাল ইঞ্জিনের সুনাম কম নেই। মূলত এটি SOC-এ আলাদাভাবে বসানো থাকে। এটি সিপিউ বা জিপিউ-এর মতোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করার ক্ষমতা রাখে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংয়ের সহায়তায় এটি ভারি কাজসমূহ আরও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে পারে। ম্যাকবুকে এর সংযোজন হলে ভিডিও রেন্ডারিংয়ের মতো কাজগুলো আরও দ্রুতগতিতে করা যাবে বলে ধারণা করছেন প্রযুক্তিবিদরা। আর নিজস্ব চিপের বদৌলতে অ্যাপল যে নতুন এবং আকর্ষণীয় ফিচার আনবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
অধিক নিরাপত্তা
ইন্টেলের প্রসেসরের নিরাপত্তা ত্রুটির কথা নতুন নয়। এখনও কিছু ত্রুটি রয়েছে যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। আর অ্যাপল তাদের পণ্যের নিরাপত্তায় কোনো অংশেই ছাড় দেয় না। আইফোনের সিকিউরিটি সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। অ্যাপল সিলিকনের মাধ্যমে এমন উচ্চতর নিরাপত্তা এখন ম্যাকবুকেও পাওয়া যাবে যা নিঃসন্দেহে ভোক্তাদের জন্য সুখবর। এবং নতুন ত্রুটির সৃষ্টি হলেও তার সমাধান করার জন্য ইন্টেলের অপেক্ষা করতে হবে না আর তাদের।
পণ্যের দাম কমার সম্ভবনা
প্রসেসর জগতে ইন্টেলের প্রসেসরগুলোর দাম সবচেয়ে বেশি। এজন্য কোম্পানিগুলোকে বিশাল পরিমাণ অর্থ ইন্টেলকে প্রদান করতে হয়, যার ফলে পণ্যের দাম বাড়ে এবং প্রভাব পড়ে ভোক্তাদের উপর। অ্যাপল যেহেতু এখন তাদের নিজেদের প্রসেসর তৈরি করবে এবং Arm প্রসেসরের উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় পণ্যের দাম কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ইন্টেলের প্রসেসর বাজারে ছাড়ার জন্য অ্যাপলকে আর অপেক্ষাও করতে হবে না। তাদের সময় অনুযায়ী তারা প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়তে পারবে।
ম্যাকে চলবে আইফোন-আইপ্যাডের অ্যাপ
Arm-ভিত্তিক হওয়ায় ঝামেলা ছাড়াই ম্যাকে চলবে আইফোন এবং আইপ্যাডের অ্যাপসমূহ। ফলে বিশাল আইওএস এর বিশাল অ্যাপ ডেটাবেজ ব্যবহারের সুযোগ পাবে ম্যাক ব্যবহারকারীরা। তবে এর সাথে আরও একটি প্রশ্ন তৈরি হয়। Arm প্রসেসরে তো x86-based অ্যাপ্লিকেশনগুলো চলবে না, কিন্তু বর্তমান সব ম্যাক আপ্লিকেশন তো x86 আর্কিটেকচারের জন্য তৈরি, সেগুলোর কী হবে?
এই সমস্যা সমাধানের জন্য অ্যাপল নিয়ে এসেছে Rosseta 2 এবং Universal 2। বর্তমান x86-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন চালাবে Rosseta 2। Rosseta 2 একটি ইমুলেটর, অর্থাৎ যখন কোনো এপ্লিকেশন চালু করা হবে এটি x86 ইন্সট্রাকশন সেটকে Arm এর ইন্সট্রাকশন সেটে রূপান্তর করবে এবং এরপর প্রসেসরে সেটি চালাবে। তারা দেখিয়েছে এর মাধ্যমে গেমও চালানো সম্ভব। Universal 2 দিয়ে তৈরি করা অ্যাপ্লিকেশন ইন্টেল এবং অ্যাপল সিলিকন দুটোতেই চলবে। এজন্যই ২ বছরের সময় বলে দিয়েছে অ্যাপল। এই সময়ে ডেভেলপাররা তাদের সকল আপ্লিকেশন অ্যাপল সিলিকনের জন্য তৈরি করার সুযোগ পাবে। এরই সুবাদে অ্যাপল ডেভেলপারদের ভাড়া দিচ্ছে ডেভেলপার কিট। মাত্র ৫০০ ডলারের এই কীটে থাকছে Apple A12Z প্রসেসর, ১৬ জিবি র্যাম ও ৫১২ জিবি এস এসডি। ডেভেলপারদের জন্য এটি আদর্শ বলছেন প্রযুক্তিবিদরা।
এত সুবিধার মাঝে একটি প্রশ্ন উঠে আসে যে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব কি পড়বে?
আসলে না। বরং ভোক্তাদের জন্যও এটি বেশ ইতিবাচক একটি পরিকল্পনা। তবে যারা বুটক্যাম্প (ম্যাক-এ উইন্ডোজ চালানো) ব্যবহার করেন তাদের জন্য আপাতত অ্যাপল কোনো নির্দেশনা দেয়নি। তবে আশা করা যায় তারা কোনো পদ্ধতি ভবিষ্যতে উন্মুক্ত করবে।
তবে ইন্টেলের জন্য এটি একটি দুঃসংবাদই বটে, এএমডির কারণে তাদের মার্কেট শেয়ার অনেক কমে গিয়েছে এবং অ্যাপলের সাথে তাদের এত বছরের সম্পর্কের ইতি নিশ্চয়ই তাদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ হতে পারে না। অ্যাপলের এই পরিবর্তনকে সাধুবাদ দিচ্ছেন অনেকেই। গত কয়েকবছর ধরে ইন্টেলের প্রসেসরের কার্যক্ষমতার ধীরগতির উন্নয়নকে একটু হলেও নাড়া দেবে এটি। অন্যদিকে এএমডিও মোবাইল প্রসেসর আনার আভাস দিয়েছে। অ্যাপল সিলিকনের ঘোষণার মাধ্যমে Arm-ভিত্তিক প্রসেসরের নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ভোক্তাদের জন্য খুশির সংবাদ।