ধরুন, আপনি কোনো পারিবারিক নৈশভোজে রয়েছেন। হঠাৎ এক আত্মীয় কোনো তুচ্ছ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তার নিজস্ব মতবাদ এত দৃঢ়তার সাথে বলে যেতে লাগলো যে তাকে থামানোই মুশকিল হয়ে গেল। একটা সুখকর পারিবারিক জমায়েত কয়েক মুহূর্তেই বিরক্তিকর সময়ে পরিণত হলো। অথবা ধরুন, আপনি বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় ব্যস্ত। আড্ডায় যোগ হয়েছে কোনো নতুন ব্যক্তি- আপনারা যে প্রসঙ্গেই গল্প শুরু করতে চান, প্রতিটি প্রসঙ্গেই সেই নতুন ব্যক্তি এমনভাবে নিজেকে জাহির করতে শুরু করলো যে সবাই পড়ে গেলেন বিড়ম্বনায়। সব বিষয়েই তার অগাধ জ্ঞান! তার জ্ঞানের স্বল্পতা তার কথাবার্তায় প্রতীয়মান, কিন্তু সে নিজে এ ব্যাপারে বেখবর। এখন ভদ্রতার খাতিরে আপনারা না পারছেন তাকে থামাতে, না পারছেন তাকে সহ্য করতে। মানব সমাজে, বিশেষ করে বাঙালি সমাজে তো এই দৃশ্য রোজকার।
মানব সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশ মনে করে তারা জ্ঞান ও দক্ষতার দিক দিয়ে সাধারণ মানুষদের তুলনায় উচ্চ অবস্থানে রয়েছে। মনস্তত্ত্বে এই ব্যাপারকে বলা হয় অলীক উচ্চতরবোধ বা ‘Illusory Superiority’। একটি বিশেষ ধরনের অলীক উচ্চতরবোধ হলো ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট (Dunning-Kruger Effect)। এই তত্ত্ব বলে, মানুষ নিজের বাস্তব ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে তাদের যোগ্যতাগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যায়ন করে থাকে। যার পারদর্শিতা যত কম, তার নিজেকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করার হার বা নিজেকে অধিকতর দক্ষ ও যোগ্য মনে করার হার তত বেশি। উল্টোদিকে, যারা প্রকৃতই যোগ্য, তারা বরং নিজেদের খানিকটা অবমূল্যায়ন করে থাকেন। এই তত্ত্বের আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হলো, অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য মানুষরা বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে নিজের প্রকৃত যোগ্যতা উপলব্ধি করার পরেও নিজেদের সম্পর্কে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেন না।
এবার এ বিষয়য়ে কিছু বিখ্যাত উক্তি শোনা যাক। সক্রেটিস মানতেন, “আমি জানি যে আমি কিছু জানি না।” জানার ব্যাপারে যে বিভ্রম বা জ্ঞানের যে ছলনা, তার প্রতি সংশয় রাখাই এই বাক্যের মূলভাব। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, “সত্যিকারের জ্ঞান হলো নিজের অজ্ঞানতার পরিধি জানা।” ব্রিটিশ লেখক ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, “পৃথিবীর সমস্যা হলো নির্বোধরা অতি নিশ্চিত আর বুদ্ধিমানেরা সংশয়ে ভরা।” আর বিবর্তনবাদের জনক ডারউইন বলেছেন, “অজ্ঞানতা বেশিরভাগ সময় জ্ঞানের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস যোগায়।” শেক্সপিয়ার ‘As You Like It’-এ লিখেছিলেন, “একজন বোকা নিজেকে জ্ঞানী ভেবে থাকে, কিন্তু একজন জ্ঞানী ব্যক্তি জানে যে সে বোকা।” যুগে যুগে বরাবর সাহিত্যিক ও দার্শনিকগণ এই অলীক উচ্চতরবোধ, নির্বুদ্ধিতা, অজ্ঞতা ও যেকোনো মতবাদ সম্পর্কিত সুদৃঢ় বিশ্বাসকে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছেন। এত বড় একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা নিয়ে কোনো না কোনো সময় মনস্তত্ত্ববিদদের মাথা ঘামানো শুরু করা অতি স্বাভাবিক ছিল।
যেভাবে এলো ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট
১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ শহরে ম্যাকআর্থার হুইলার নামে এক লোক দিনে-দুপুরে, পুরোপুরি নিরস্ত্র ও মুখোশহীন অবস্থায় পরপর দু’টি ব্যাংক ডাকাতি করে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর সে বিস্মিত হয়ে বলে, “আমি তো লেবুর রস মেখেছিলাম!” হুইলার মনে করতো যে চেহারায় লেবুর রস মেখে নিলে গোপন ক্যামেরায় তার ছবি ধরা পড়বে না, সে হয়ে যাবে অদৃশ্য! এমনকি নিজের চোখে নিজের ফুটেজ দেখার পরেও সে দাবি করে যে সেটি মিথ্যা। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, সে যা বিশ্বাস করে, তার বাইরে কিছু ঘটতেই পারে না। কর্নেল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর ডেভিড ডানিং সংবাদপত্রে এই ঘটনাটি পড়ে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একই ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর গবেষণার কাজ করছিলেন জাস্টিন ক্রুগার। ক্রুগারকে নিয়ে ডানিং এ বিষয়ে বিশদ গবেষণার কাজে নেমে পড়েন। প্রথম দিকে তারা এই সমস্যার নাম দেন ‘অদক্ষ ও অসচেতন সমস্যা’ (Unskilled and Unaware Problem)। ডানিং পরে এর নাম দেন ‘Anosognosia of everyday life’। দু’জনের মিলিত সমীক্ষা ও গবেষণালব্ধ ফলাফল একটি প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়, যার শিরোনামটি আজকাল সর্বজনবিদিত ও বহুল ব্যবহৃত। তারা এর নাম দিয়েছিলেন ‘Unskilled and Unaware of It’, অর্থাৎ ‘অদক্ষ ও এ বিষয়ে অসচেতন’। এই গবেষণার জন্য ২০০০ সালে ডানিং ও ক্রুগার ইগ-নোবেল প্রাইজ (Ig Nobel Prize) পান।
১৯৯৯ সালে ডানিং ও ক্রুগার কর্নেল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উপর একটি পরীক্ষা চালান। চারটি অংশে অভীক্ষণের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে রসবোধ, ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা ও আত্মোপলব্ধিকরণের পরীক্ষা নেন। পরীক্ষা শেষে তাদের নিজ নিজ ফলাফলের ধারণা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে দেখা যায় যারা অপেক্ষাকৃত খারাপ ফলাফল করেছে, তারা নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে আরও উচ্চতর ধারণা পোষণ করে। যেমন, যারা ব্যাকরণে ১০% নাম্বার পেয়েছিল, তারা নিজেদের স্থান ৬৭% এর উপরে ধারণা করে। এই প্রভাব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নধ্যেই নয়, যেকোনো ক্ষেত্রে বিদ্যমান। একটি হাই-টেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চালানো জরিপে দেখা যায় ৩২-৪২% সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নিজেদের দক্ষতাকে তাদের কোম্পানির সেরা ৫% এর মধ্যে নির্ধারণ (Rating) করেন। নেব্রাস্কা ইউনিভার্সিটিতে চালানো আরেকটি জরিপ বলে তাতে ৬৮% মানুষ নিজেদের শিক্ষাদান করার যোগ্যতাকে ২৫% এর মধ্যে নির্ধারণ করেন এবং ৯০% এর উপরে মানুষ নিজেদের দক্ষতাকে সাধারণের চেয়ে উচ্চমানের মনে করেন (যা গাণিতিকভাবেই অসম্ভব)।
এই যে একেবারে ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষরা নিজেদের দক্ষতাকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করে থাকে, এর কারণ হলো নিছক জ্ঞানের অভাব। যার জ্ঞানের পরিধি যত কম, তার পৃথিবী তত ছোট। এরা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না, যে বিষয় নিয়ে এদের প্রশ্ন করা হচ্ছে, সেই বিষয়টির সীমারেখা সত্যিকার অর্থে কত বৃহৎ। অপরদিকে, যাদের নির্দিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে, তারা অন্তত সে বিষয়ের বিশালত্ব সম্পর্কে সচেতন। তাই তারা নিজেদের অতিরিক্ত মূল্যায়ন বা জাহির করা থেকে বিরত থাকেন। কিছু গবেষকের মতে নিজেকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করা ভুল আত্মোপলব্ধির কারণে নয়, বরং অযৌক্তিক আশাবাদ (irrational optimism) এর কারনে হয়ে থাকে। এককথায়, অদক্ষ মানুষরা একসাথে দু’টি সমস্যায় ভুগে থাকেন- একে জ্ঞানের অভাব, আর তার ফলস্বরূপ নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ।
উত্তরণের উপায়
যেহেতু জ্ঞানের অভাবেই এই সমস্যা, তাই এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সুষ্ঠু জ্ঞান অর্জন। যেকোনো বিষয়ে সম্পর্কে জানলে যতটা বেশি সম্ভব পরিচ্ছন্নভাবে জানার চেষ্টা করতে হবে। দক্ষতার ক্ষেত্রেও তা-ই, নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পরিহার করে বরং উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। যথাযথ জ্ঞান দিয়ে নিজেকে যথেষ্ট সুদক্ষ করে গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে হবে। আরেকটি উপায় হলো- পুনঃযাচাই। গবেষণার সময় যখন একটি দলকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার জন্য ১০ মিনিট সময় দেয়া হয়, দেখা যায় তাদের অলীক আশাবাদ খানিকটা হলেও কমে এসেছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনার সময় জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে তারা নিজেদের কমতিগুলো ও আলোচ্য বিষয়ের গভীরতা সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রাপ্ত হন। আর তাই তাদের বেশি জানা স্বভাবটিও ক্রমে পরিবর্তিত হয়।
এবার জানলেন নিশ্চয়ই, কেন কিছু মানুষ বাকবিতণ্ডায় অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েন? হোক বাস্তব জীবন বা ভার্চুয়াল, ডানিং-ক্রুগার ইফেক্টের উপস্থিতি সর্বত্র বিরাজমান। আর তাই কোনো ফেসবুক পোস্টের কমেন্ট বক্সে কাউকে অহেতুক গলা উঁচু করলে হম্বিতম্বি করতে দেখলে সহসা ক্ষেপে উঠবেন না, বেচারা হয়তো এ সমস্যায় জর্জরিত। আর সংযমের শুরুটা তো নিজেরই করা উচিত। পৃথিবীতে জ্ঞানের সুষ্ঠু আদান প্রদান নিশ্চিত হোক।
ফিচার ইমেজ: thriveglobal.com