দাঁতের চিকিৎসা নিয়ে লেখার এর আগের পর্বে আমরা প্রাচীন মিশর, মায়া সভ্যতা এবং গ্রিক সভ্যতায় প্রচলিত দন্তচিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে জেনেছি। আজকের পর্বে জানবো আরও কিছু অঞ্চলের দন্তচিকিৎসার প্রাচীন পদ্ধতির কথা।
ইট্রুসকান সভ্যতায় দন্তচিকিৎসা
রোগ নিরাময় ছাড়াও, কেবল সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যে দাঁতের চিকিৎসার প্রচলন দেখা যায় ইট্রুসকান (ইতালিতে গড়ে ওঠা রোমান-পূর্ববর্তী) সভ্যতার লোকদের মধ্যে। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সাহসী এবং পরিশ্রমী এই জাতির বিলাসী জীবনযাত্রার প্রতি ছিল অগাধ আগ্রহ। সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এবং অন্যান্য সভ্যতার লোকদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুবাদে তারা দন্তচিকিৎসাসহ নানাবিধ বিষয়ে নতুন সব জ্ঞান অর্জন করেছিল। পরবর্তীতে সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তারা দাঁতের চিকিৎসায় স্বর্ণের ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ শতাব্দীর দিকে তারাই প্রথমবারের মতো মানুষ ও পশুর দাঁত ব্যবহার করে দাঁত প্রতিস্থাপন বা দাঁত বাঁধানোর চিকিৎসা শুরু করে। সোনার পাতের মধ্যে এসব দাঁতকে তারা ধাতব পিনের সাহায্যে যুক্ত করতো। এরপর পাশের সুস্থ দাঁতগুলোর সঙ্গে সোনার পাতটিকে জুড়ে দেওয়া হতো। তৎকালীন প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের সামনের দিকের দাঁতগুলোকে ফেলে দিয়ে সেখানে এমন নকল দাঁত স্থাপন করতো বলে জানা যায়।
এদিকে ইট্রুসকানদের উত্তরসূরি রোমান সভ্যতার অধিবাসীরা দাঁত ঝকঝকে সাদা করতে ব্যবহার করতো মানুষ ও পশুর মূত্র! দাঁতের ব্যথা উপশমে আফিমের পাশাপাশি পোকা, কাকের বিষ্ঠা, ব্যাঙের মগজের মতো অদ্ভুত উপাদানের ব্যবহারে লোকজ চিকিৎসাও চলতো সমান তালে।
মধ্যযুগে দন্তচিকিৎসা
মধ্যযুগে অধিবাসীরা দাঁত সাদা রাখা এবং মুখ দুর্গন্ধমুক্ত রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিল। মোটা দানার লবণ আর কাঠকয়লার মিহি গুঁড়োকে তারা ব্যবহার করতো টুথ পাউডার হিসেবে। স্বাদ ও সুগন্ধের জন্যে এর মধ্যে মেশানো হতো পুদিনা, ভূঁই-তুলসী, মৌরি, রোজমেরি ইত্যাদি। খসখসে কাপড়ের টুকরোর মধ্যে এই মিশ্রণ নিয়ে তা দিয়ে ঘষে দাঁত ও মাড়ি পরিস্কার করা হতো। মদ বা সিরকার মধ্যে দারুচিনি, লবঙ্গ, পুদিনা বা মৌরি ভিজিয়ে রেখে তৈরি করা হতো মাউথওয়াশ।
এ তো গেলো রোগ প্রতিরোধের কথা, রোগের উপসর্গ দেখা দিলে সেগুলো উপশমের জন্যে অদ্ভূত সব চিকিৎসাও তখন প্রচলিত ছিল। যেমন- দাঁতে ব্যথা হলে পিঁপড়া ও তার ডিম গুঁড়ো করে নিয়ে আক্রান্ত দাঁতে তা ব্যবহার করা।
আরেকটি পদ্ধতি ছিল- গুইসাপ এবং গ্রীষ্মকালে জলাশয়ের কাছে যেসব গুবরেপোকা ঘুরে বেড়ায়, সেগুলোকে নিয়ে একটি লোহার পাত্রে ততক্ষণ সেদ্ধ করা, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলোকে গুঁড়ো করা যায়। এরপর ডান হাতের তর্জনীতে করে সেই গুঁড়ো নিয়ে যন্ত্রণাদায়ক দাঁতটিতে মাখিয়ে রাখা হতো।
মধ্যযুগে পাদ্রীগণ ছিলেন সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি এবং তারাই তখন দাঁত তোলাসহ সবধরনের অস্ত্রোপচারের কাজ সম্পন্ন করতেন। পরবর্তীতে গির্জা থেকে তাদের জন্যে এসব কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে এই গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয় স্থানীয় নাপিতদের ঘাড়ে, যেহেতু ধারালো যন্ত্রপাতি নিয়েই তাদের দৈনন্দিন কাজ। তবে দাঁতের অবস্থা নিতান্তই খারাপ এবং সংরক্ষণের অযোগ্য না হলে তারা দাঁত তুলতো না।
চৈনিক সভ্যতায় দন্তচিকিৎসা
চীনারা আদিকাল থেকেই চিকিৎসাবিদ্যায় বেশ অগ্রগামী ছিল। তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত সবচেয়ে পুরনো বইয়ের নাম হচ্ছে ‘Nei Ching’, যাতে দাঁতে ব্যথা ও মাড়ির রোগের ওপরে দুটি অধ্যায় রয়েছে। এতে নয় ধরনের দাঁতব্যথার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। দাঁতের ব্যথা থামাতে রসুনের বড়ি এবং দাঁত সাদা করতে বাদুড়ের বিষ্ঠা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে এখানে। এই বইয়ের তথ্যানুসারে, দাঁতের ব্যথার কারণে শরীরের তাপমাত্রার তারতম্য (অর্থাৎ জ্বর) দেখা দেয় এবং প্রদাহের কারণে দাঁত নড়বড়ে হয়ে যায়। চীনা চিকিৎসাপদ্ধতিতে দাঁতের ব্যথা নিরাময়ের জন্যে ২৬টি এবং মাড়ির রোগ নিরাময়ের জন্যে ৬টি আকুপাংচার পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। দাঁত সাদা করতে তারা কস্তুরী এবং আদা গুঁড়োর মিশ্রণে তৈরি একপ্রকারের পেস্ট ব্যবহার করতো। দাঁতের ক্যারিজ বা ক্ষয়রোগ প্রতিরোধের জন্যে তারা কুলি করার মাধ্যমে দাঁত থেকে খাদ্যকণা দূর করে ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল।
চীনারাই সর্বপ্রথম পুরনো ব্যবহৃত কাঠ থেকে ব্রিসলযুক্ত টুথব্রাশ তৈরি করে বলে জানা যায়। স্যালাইন দ্রবণ দিয়ে মুখ কুলকুচি করার চর্চাও তাদের মধ্যে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আজ থেকে ৪,০০০ বছরেরও বেশি সময় পূর্বে বাঁশের তৈরি কীলক দিয়ে দাঁত ইমপ্ল্যান্ট করার চেষ্টা করারও নজির রয়েছে তাদের ইতিহাসে।
তবে দাঁত ও মুখগহ্বরের চিকিৎসায় মানুষ যুগে যুগে এত যত্নবান হলেও, সাধারণ চিকিৎসকদের (general physician) কাছে দীর্ঘকাল এ বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিতই ছিল। ১৫৩০ সালে দন্তচিকিৎসার ওপরে লেখা প্রথম বই ‘দ্য লিটল মেডিসিনাল বুক ফর অল কাইন্ডস অব ডিজিজেস অ্যান্ড ইনফার্মিটিস অব দ্য টিথ’ প্রকাশের পর দন্তচিকিৎসা পেশাটি বিশেষভাবে চিকিৎসক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ১৬৮৫ সালে চার্লস অ্যালেন সর্বপ্রথম ইংরেজিতে দন্তচিকিৎসাবিদ্যার একটি পাঠ্যবই প্রকাশ করেন। ‘দ্য অপারেটর ফর দ্য টুথ’ নামক এই বইটিতে তিনি দন্তচিকিৎসার বিবিধ বিষয়ে আলোকপাত করেন।
দন্তচিকিৎসাকে একটি স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন আধুনিক দন্তচিকিৎসার জনক, ফরাসি শল্যচিকিৎসক পিয়ের ফৌচার। ১৭২৩ সালে প্রকাশ পায় তার বই ‘দ্য সার্জন ডেন্টিস্ট, আ ট্রিটিজ অন টিথ’। এ বইটিতে তিনি দাঁতে ক্ষয় সৃষ্টিতে চিনিজাতীয় খাদ্যদ্রব্যের ভূমিকা তুলে ধরেন এবং ‘দাঁতের পোকা ও অশুভ আত্মার প্রভাবে দাঁতের রোগ দেখা দেয়’- এমন সেকেলে, ভ্রান্ত ধারণাকে নাকচ করে দেন। আজও তার বইয়ে বর্ণিত অনেক চিকিৎসাপদ্ধতি দন্তচিকিৎসকগণ প্রয়োগ করে থাকেন। কালের পরিক্রমায় দন্তচিকিৎসাবিদ্যা আরও উন্নত ও বিকশিত হতে থাকে।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, প্রাচীন দন্তচিকিৎসার সঙ্গে আজকের দন্তচিকিৎসার অন্যতম উল্লেখযোগ্য যে পার্থক্য, সেটি হচ্ছে কার্যকর অনুভূতিনাশকের ব্যবহার এবং ব্যথামুক্ত চিকিৎসা। শুরুর দিকে চিকিৎসায় ব্যথার অনুভূতি কমানোর জন্যে ভেষজ উপাদানের সাহায্যে চেতনাহীন করা, স্নায়ু ও রক্তনালী চেপে ধরে অবশ করা, মাথায় আঘাত করে রোগীকে অচেতন করা- এসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগে অনুভূতিনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হতো অ্যালকোহল, ভাং, আফিম প্রভৃতি।
এরপর ১৮৪২ সালে উইলিয়াম থমাস গ্রিন মরটনের ইথার আবিষ্কার, ১৮৪৪ সালে দাঁত তোলার কাজে হরেস ওয়েলস কর্তৃক নাইট্রাস অক্সাইডের ব্যবহার, ১৮৮৪-তে কার্ল কোলার কর্তৃক কোকেইনের ব্যথানাশক গুণাবলী আবিষ্কার, ১৯০৫ সালে আইনহর্ন এবং ওহফেল্ডারের প্রোকেইন আবিষ্কারের পথ পেরিয়ে ১৯৫০ সালের মধ্যে দন্তচিকিৎসায় প্রাকৃতিক অনুভূতিনাশক প্রোকেইন ও কৃত্রিম অনুভূতিনাশক লিডোকেইনের ব্যবহার পুরোদমে শুরু হয়। সূচনা ঘটে ব্যথামুক্ত দন্তচিকিৎসার।
এভাবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে ক্রমাগত উৎকর্ষের সাথে সাথে দন্তচিকিৎসাপদ্ধতিরও উত্তরোত্তর উন্নতি সাধিত হয়েছে। চিকিৎসা হয়ে উঠছে নিরাপদ, নিখুঁত এবং তুলনামূলক সহজসাধ্য।
প্রথম পর্ব: কেমন ছিল প্রাচীনকালের দাঁতের চিকিৎসা?
ফিচার ইমেজ: John Collier “A sadistic tooth-drawer”, courtesy of Wellcome Images