বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রসারিত শিল্পমাধ্যমের নাম ‘চলচ্চিত্র’। এই শিল্পমাধ্যমের অগ্রযাত্রার শুরুটা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিবিশেষ দ্বারা হয়নি, বরং এর সাথে মিশে আছে বেশকিছু মানুষের চিন্তাভাবনা-পরিশ্রম-সাধনা। সেসব স্বপ্নবাজের কথা বলতে গেলে সবচেয়ে আগে উচ্চারিত হয়ে থাকে অগুস্ত লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) আর লুই লুমিয়েরের (১৮৬৪-১৯৪৮) নাম। ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে জন্ম নেয়া এই সহোদরকে সারাবিশ্ব ‘লুমিয়ের ব্রাদার্স’ নামে চিনে থাকে। তারা চলমান (মুভিং) আলোকচিত্র গ্রহণের উপযোগী ক্যামেরা এবং এতে ধারণকৃত দৃশ্য পর্দায় প্রদর্শনের জন্য যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন।
সিনেমাটোগ্রাফের মূল কারিগর অগুস্তু ও লুইয়ের এই সফলতার পেছনে তাদের চিত্রশিল্পী বাবা আঁতোয়া লুমিয়েরের অবদান সবচেয়ে বেশি। ছবি আঁকায় রোজগারপাতি বেশি না হওয়ায় আঁতোয়া তার দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে ফটোগ্রাফিক মালমসলা তৈরি এবং সেগুলো সরবরাহ করার ব্যবসা খুলে বসেন। বড় ছেলে অগুস্ত ম্যানেজার হিসেবে কারখানা দেখাশোনার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিলেন, আর লুই লুমিয়েরের সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিলো পদার্থবিদ্যায়।
কয়েকবছর গভীরভাবে এই ব্যবসাপাতি সামলানোর ফলে ফটোগ্রাফার হিসেবে আঁতোয়া বেশ নাম কামিয়েছিলেন। তাদের ফটোগ্রাফিক জিনিসপত্রের ব্যবসা একসময় ফুলেফেঁপে উঠলো, অক্লান্ত পরিশ্রমে ধীরে ধীরে সেটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফটোগ্রাফিক কারখানায় উন্নীত হলো। তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় ফটোগ্রাফিক কোম্পানির নামের সাথে আপনারা সবাই কম-বেশি পরিচিত আছেন। কোডাকের কথা ভাবছেন তো? যদি ভেবে থাকেন, তাহলে আপনার ধারণা একদম সঠিক। আমেরিকার জর্জ ইস্টম্যানের কোডাক কোম্পানি ছিলো তখনকার সবচেয়ে বড় ফটোগ্রাফিক সরঞ্জামাদি তৈরি ও বিপণন কোম্পানি।
একটু পেছন ফিরে দেখা যাক, ১৮৮৮ সালে টমাস আলভা এডিসন ও ডব্লিউ কে এল ডিক্সন ‘কাইনোটোস্কোপ’ আবিষ্কার করলেন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে একসাথে কেবলমাত্র একজনই ছবি দেখতে পারতেন, চলমান ছবির দৈর্ঘ্য হতে পারতো সর্বোচ্চ ৫০ ফুট। তারা বিভিন্ন শহরে কাইনোটোস্কোপ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেন। যারা একবার এই আশ্চর্য যন্তরমন্তর মেশিনে চোখ রাখতেন, তারাই বিস্মিত হতে বাধ্য হতেন। ১৮৯৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিসের কোনো এক প্রদর্শনীতে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আঁতোয়া লুমিয়েরকে, স্বাভাবিকভাবেই চিত্রশিল্পী-ফটোগ্রাফার আঁতোয়া মুগ্ধ হয়েছিলেন কাইনোটোস্কোপ দর্শনে।
তিনি লিঁয়তে ফিরে এসে ছেলেদের কাছে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন, চলমান ছবিকে পর্দায় প্রদর্শন করার মতো কোনো একটা উপায় যেভাবেই হোক তাদেরকে বের করতেই হবে। তখন গ্রীষ্মকাল চলছিলো, আঁতোয়ার মনের উত্তাপ তার ছেলেরা হয়তো স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। পিতার অনুপ্রেরণায় তারা তখনই কাজে নেমে পড়লেন, বিশেষত পদার্থবিদ্যায় হাবুডুবু খাওয়া লুই লুমিয়েরের মনে তার বাবার স্বপ্ন আর নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা জেঁকে বসলো।
কিছুদিন কাজ চালিয়ে যাবার পর অগুস্ত কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। ছোট ভাই লুই লেগেই রইলেন, তিনি মূলত প্রাথমিকভাবে কয়েকটি সহায়ক পদ্ধতির উপর ভর করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে চাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে অত্যাধিক পরিশ্রম সত্ত্বেও সফল না হতে পেরে লুই লুমিয়েরও হতাশ হয়ে গেলেন। একটানা কাজের ফলে অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পুরোপুরি বিশ্রামেও থাকতে হলো তাকে। সেই অবস্থাতেই এক মাঝরাতে লুইয়ের মাথায় হঠাতই এক আইডিয়া আসলো।
প্রাথমিকভাবে সেলাই মেশিনের প্রেসার পিনের (যেটা দিয়ে সেলাইয়ের সময় কাপড়কে চাপ দিয়ে আটকে রাখা হয়) মতো একটা যন্ত্র বানিয়ে ক্যামেরার সাথে স্থাপন করলেন। এরপর লুইয়ের দেওয়া মূল তত্ত্বগুলোর ভিত্তিতে তাদের কারখানার প্রধান প্রকৌশলী মইসন পরীক্ষামূলকভাবে যন্ত্রটি তৈরি করেন। সেক্ষেত্রে লুইকেই সিনেমাটোগ্রাফের মূল স্বত্ত্বাধিকারী বলা যায়। যদিও সিনেমাটোগ্রাফের স্বত্ত্ব তাদের দুজনের নামেই হয়েছিলো। কারণ তারা কারখানা সংক্রান্ত যেসব দাপ্তরিক কাজে স্বাক্ষর করতেন, সেগুলোতে সবসময় তারা দুজন একসঙ্গেই স্বাক্ষর করতেন। স্বত্ত্ব আবেদনের যে ফরম ছিল, তাতেও যথারীতি তারা দুজনই স্বাক্ষর করেন। এখানে অগুস্তের ভূমিকাকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। তিনিও লুইয়ের বানানো চলমান চিত্র ধারণ ও প্রদর্শনযন্ত্রের ব্যবহার উপযোগী করার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখেন, সেগুলোর স্বত্ত্বও তাদের দুজনের নামেই রয়েছে।
লুমিয়েররা তাদের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওয়ার্কার্স লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি’ নির্মাণ করেছিলেন ১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে। ৩৫ এমএম ফরম্যাটে নির্মিত ১৭ মিটার দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রটির ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র ৪৬ সেকেন্ড। তাদের ক্যামেরার লেন্স ছিলো বেশ দুর্বল, যার কারণে দৃশ্য ধারণের জন্য দরকার ছিলো উজ্জ্বল আলোর, সেজন্যই তারা গ্রীষ্মকালকেই বেছে নিয়েছিলেন। এক মিনিটেরও কম সময়ের এই সিনেমাতে দেখা যায়, লুমিয়েরের কারখানা থেকে শ্রমিকরা বের হচ্ছেন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী। গেট দিয়ে বের হবার সময় তাদের কেউই ক্যামেরার দিকে তাকাননি, খুব সম্ভবত শ্রমিকেরা শ্যুটিংয়ের ব্যাপারে জানতেন। এছাড়াও ছবিটিতে দেখা যায় একটি কুকুর এবং কয়েকটি বাইসাইকেল।
তাদের তৈরি এই চলচ্চিত্রটি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিলো ১৮৯৫ সালের ২২ মার্চ প্যারিসের এক বিখ্যাত কারখানায়, যেটি ছিলো জনসম্মুখে কোনো চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী। প্রদর্শনী শেষে আমন্ত্রিত কয়েকজন অতিথি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন, শেষবক্তা হিসেবে লুই লুমিয়ের সেখানে ফটোগ্রাফিক ইমেজের গঠন প্রক্রিয়া সবার সামনে তুলে ধরেন। লুইয়ের বক্তৃতা উপস্থিত দর্শকদের মনে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো। সেই বক্তৃতার জের ধরে জুলস কার্পেন্টিয়ার নামের এক প্রকৌশলীর সাথে তাদের পরিচয় ঘটে, যিনি তার নিজের কারখানায় লুমিয়েরদের আবিষ্কৃত যন্ত্রটি উৎপাদনের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সেসময় লুমিয়েরদের কারখানায় সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রের কোনো অংশই নতুন করে উৎপাদন করা সম্ভব ছিলো না। তাই তারা কার্পেন্টিয়ারের প্রস্তাবে রাজি হলেন।
১৮৯৫ সালে লুমিয়েররা প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যার সবগুলোই ছিলো ১৭ মিটার দৈর্ঘ্যের আর গড়ে ১ মিনিট ব্যাপ্তির। ১৭ মিটার দৈর্ঘ্যে নির্মাণ করা ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায় ছিলো না, কারণ দৃশ্যের নেগেটিভ রাখার জন্য যে বক্সটি ছিলো সেটাতে ১৭ মিটারের বেশি ফিল্ম পেঁচিয়ে রাখা যেতো না। একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফেতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবার তাদের নির্মিত দশটি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তার কয়েকমাস পরেই প্যারিসের একটা প্রেক্ষাগৃহে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে তাদের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিলো।
প্রথম কয়েকদিন দর্শকদের কোনো ভিড় না হলেও ধীরে ধীরে এটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ততদিনে তারা কার্পেন্টিয়ারের কারখানা থেকে ১০টি যন্ত্র হাতে পেয়ে গেলেন, যার ফলে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে যাবার প্রস্তুতিও পুরোদমে সম্পন্ন হলো। লুমিয়েররা যে কত দ্রুততার সাথে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তার প্রমাণ মেলে ভারতবর্ষের মুম্বাইতে (তৎকালীন বোম্বাই) ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাইয়ের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর কথা ভাবলে। মুম্বাইয়ে প্রদর্শনীর পরের বছরেই লুমিয়েরদের প্রশিক্ষিত দলবল কলকাতাতেও হাজির হয়েছিলেন। এরপর ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বেডফোর্ড সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম কমেডি ‘ওয়াটারিং দ্য গার্ডেন’ এবং প্রথম কমার্শিয়ালও (বিজ্ঞাপন) লুমিয়ের ব্রাদার্সের সৃষ্টি। তাদের হাতে তৈরি ‘অ্যারাইভাল অফ অ্যা ট্রেন’ চলচ্চিত্রটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে দেখা যায় ফ্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসার মুহূর্ত, ট্রেন থেমে যাবার পর যাত্রীদের ওঠানামা, যাত্রীদের দলবদ্ধভাবে হাঁটাচলা। লুমিয়েররা একক শটের প্রায় ১,৪২৫টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যার সবগুলোর দৈর্ঘ্যই ছিলো এক মিনিটের কম। কয়েকবছরের মধ্যেই এত বিপুল সংখ্যক দৃশ্য ধারণ করার ফলে সিনেমাটোগ্রাফির প্রতি লুই লুমিয়েরের আকর্ষণ কমে যেতে থাকলো, তিনি অন্য বিষয়ে গবেষণার কাজে মন দিলেন। এই শূন্যস্থান পূরণ করতে দ্বিতীয় যে ব্যক্তি এগিয়ে এলেন তিনি ছিলেন ফ্রান্সেরই বাসিন্দা, নাম জর্জ মেলিয়েস। ১৯০০ সালে লুমিয়েররা সিনেমাটোগ্রাফের কপিরাইট চার্লস প্যাথে নামের একজনের কাছে বিক্রি করে দেন।
লুমিয়েররা একেবারে বাস্তব জীবন থেকেই ফুটেজ তুলতেন, কোনোরকম সাজানো-গোছানোর ব্যাপার তাতে ছিলো না। ফ্রান্সের জীবনযাত্রা পাশাপাশি তাদের ক্যামেরায় উঠে এসেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের চিত্র। লুমিয়ের দুই ভাই ক্যামেরা নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন আমেরিকা থেকে এশিয়া। তাদের বানানো এক মিনিটের চলচ্চিত্র বিনোদনের চেয়েও অনেকাংশে ইতিহাস হয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। গোড়ার দিকে মাত্র এক মিনিট দৈর্ঘ্য দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে শত গুণ, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চলচ্চিত্রের বিষয় ও আঙ্গিক। বিজ্ঞান নির্ভর শিল্পমাধ্যম হওয়ায় অন্যান্য শিল্পমাধ্যম, যেমন- চিত্রকলা, সঙ্গীত, নাট্যকলা, কাব্যকলা ইত্যাদির সাথে চলচ্চিত্রের এক নিবিড় আত্মসম্পর্ক রয়েছে। সমস্ত শিল্পমাধ্যমের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্র আছে বলেই চলচ্চিত্র শুধুমাত্র একটি বিনোদন মাধ্যম নয়, হয়ে উঠেছে সমাজের দর্পণ।
লুমিয়েরদের হাতে নির্মিত প্রধান কয়েকটি চলচ্চিত্র
- ওয়ার্কাস লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি
- জাম্পিং অন টু দ্য ব্লাংকেট
- কার্ডিয়ার্স স্কোয়ার ইন লিয়ঁ
- বাথিং ইন দ্য সি
- হর্স ট্রিক রাইডার
- ফিশিং ফর গোল্ডফিশ
- দ্য ডিজএমবার্কমেন্ট অফ দ্য কংগ্রেস অফ ফটোগ্রাফার্স ইন লিয়ঁ
- ব্লাকস্মিথস্
- দ্য গার্ডেনার
- বেবি’স ব্রেকফাস্ট
- কার্ড গেম
- অ্যারাইভাল অফ অ্যা ট্রেন