যে ব্যক্তি জ্ঞানের তপস্যা বা সাধনা করেন তাকেই জ্ঞানতাপস বলে। আর এ ধরনের কোনো ব্যক্তির কথা বলতে গেলে সর্বপ্রথম মাথায় আসে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের কথা। সক্রেটিসের নাম শোনেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি সারা জীবন অতিবাহিত করেছেন জ্ঞানার্জন আর জ্ঞান বিলিয়ে। কিন্তু সক্রেটিস তার জ্ঞান, দর্শন বা মতবাদসমূহ কিছুই লিপিবদ্ধ করে রেখে যাননি। তাতে কি তার নাম ম্লান হয়ে গিয়েছে? না, যায়নি। কেননা তিনি কয়েকজন যোগ্য শিষ্য রেখে গিয়েছিলেন, যারা পরবর্তীতে তার জ্ঞানের মহিমা, দর্শন এবং মতবাদসমূহ বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছেন।
আমাদের এই ছোট আয়তনের দেশটার মানুষগুলো নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থা এবং প্রথাগত ভূয়োদর্শন বেশি উঁচুতে না ওঠার কিংবা বেশি না বাড়ার উপদেশ দেয় আমাদের জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যু অবধি। তাই, মনের গহীন কোনে সর্বক্ষণ এক আতঙ্ক বাসা বুনেই চলে, আর তা হচ্ছে, বেশি বৃদ্ধি পেলে ক্রুদ্ধ ঝড়ে ভেঙে পড়ার ভয়। এমনকি প্রকৃতিও সর্বদা এ ভয়ে আতঙ্কিত থাকে। তাই আকাশছোঁয়া বৃক্ষের দেখা মেলা যেমন ভার, ঠিক তেমনই এখানে রয়েছে মহৎ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের অভাব। আতঙ্কিত প্রকৃতিও তাই গড়ে তুলেছে মধ্য, নিম্ন-মধ্য আর একদমই নিম্ন পর্যায়ের অরণ্য আর লোকালয়। তাই নিঃসন্দেহে এই পঞ্চান্ন হাজারের বর্গ মাইলের লোকালয় বা অরণ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি মহৎ, যিনি ত্যাগে হয়ে উঠেছেন মহিমাময় অথবা একজন বিস্ময়কর কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন।
সত্যিই কি কঠিন? না, এমন একজন ছিলেন। যিনি সক্রেটিসের ন্যায় সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছেন জ্ঞানার্জনে। জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে ছিলেন চিরকাল। যার কাছে জগত-সংসার ছিল গৌণ আর জ্ঞানার্জনটা ছিল মুখ্য। যিনি ছিলেন শিক্ষকদেরও শিক্ষক। এমনই ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। যাকে পরবর্তীতে জ্ঞানতাপস বলে আখ্যায়িত করা হয়।
যারা অভ্যাসের বশে বইপত্র পড়েন কিংবা সাহিত্যাঙ্গনে বিচরণ করেন, তাদের কমবেশি সবাই-ই প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যারের নাম শোনার কথা। এছাড়াও, তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশের ‘জাতীয় অধ্যাপক‘ ছিলেন। কিন্তু প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বেশিরভাগ মানুষের কাছেই দুর্ভেদ্য এবং রহস্যময়, কেননা জীবদ্দশায় যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছেন, তার সিকিভাগও তিনি লিখে রেখে যাননি, যার জন্য তার দর্শন, মতবাদ, চিন্তাচেতনা কিংবা পান্ডিত্যের রেশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কেবলমাত্র তার শিক্ষকতা এবং শিক্ষকতা পরবর্তী সময়ে যারা তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন তারাই জানেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক কতটা মহান ব্যক্তি এবং জ্ঞানী দার্শনিক ছিলেন।
মতান্তরে, ১৯১২ সালের পহেলা জানুয়ারি ঢাকা জেলার কেরানিগঞ্জের কলাতিয়া গ্রামে জন্ম হয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের। মতান্তরে বলার কারণ হচ্ছে, জন্মের বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, ১৯১২ কিংবা এর আশেপাশেই ১/২ বছর এদিক-ওদিক হতে পারে। আর তিনি নিজেই নিজের জন্মের তারিখ জানতেন না, তাই একাডেমিকভাবে পহেলা জানুয়ারিকে নিজের জন্মের তারিখ বলে গণ্য করতেন। আইএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য পিতা মৌলভী আব্দুল আলী ব্রিটিশ ভারতের পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর ছিলেন। তার মায়ের নাম নান্নু বিবি।
পুলিশের চাকরি বদলীর চাকরি। তাই পিতার বদলীর চাকরির কারণে ছেলেবেলায় নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে পড়াশোনা করেছেন আবদুর রাজ্জাক। তার জন্মের বছর পিতার কর্মস্থল ছিল রংপুর। তাই শৈশবের কিছুটা রংপুরেও কেটেছে। তার পরপরই তারা হুগলি চলে যান। হুগলি জেলার পান্ডুয়ার এক মাদ্রাসায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী এবং সেখানকারই এক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীও পড়েন।
মায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে আব্দুর রাজ্জাককে আবার কলাতিয়ায় চলে আসতে হয়। কলাতিয়া গ্রামের মাইনর স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত সেই স্কুলেই অধ্যয়ন করেন তিনি। সেই স্কুলের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং বৃত্তিলাভ করেন। এর মাঝেই প্রফেসর রাজ্জাকের অসুস্থ মায়ের মৃত্যু হয়। বাবা আবার হুগলি চলে গেলে এক চাচার তত্ত্বাবধানে ঢাকার মুসলিম হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। স্কুলের নির্ধারিত ছাত্রাবাস ‘ডাফরিন’ হোস্টেল উঠেন। এখান থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
১৯৩১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তরও একই বিষয়ে করেন। কিন্তু নিজেকে যোগ্য মনে না করায় ১৯৩৫ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও তিনি সেবছর অংশগ্রহণ করেননি। পরে ১৯৩৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঐ বছরই অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। পরে অবশ্য অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগ হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান।
হাসিমাখা মুখে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলা ছোটখাট এই মানুষটির জ্ঞান ছিল পর্বততুল্য। তিনি তার নিজস্ব ঢঙ এবং বুলিতেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, যেটা পুরোপুরি ঢাকাইয়াও না, আবার গ্রাম্যও না। তিনি ইংরেজিটা বেশ ভালো এবং বিশুদ্ধভাবে বলতে পারতেন, কিন্তু মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিতেন সবচাইতে বেশি। আর তার ছাত্রদেরও তিনি মাতৃভাষার উপর লেখালেখি করার উৎসাহ দিতেন। তিনি বলতেন,
মাতৃভাষা ছাড়া কোনো জাতি বা কারো উন্নতি করা সম্ভব নয়।
পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও তার বাঙালিয়ানা প্রকাশ পেতো। কেননা খদ্দরের পাঞ্জাবী-পায়জামা আর মাঝে মাঝে কাঁধে একটি চাদর কিংবা লুঙি আর কুর্তাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কেবলমাত্র অতীব জরুরি প্রয়োজন, যেমন- বিলেত গমন বাদে কোট-টাই পরতে তার প্রচুর অনীহা ছিল।
ফুলার রোডের লাল ইটের দোতলা এক বাসায় থাকতেন, যেখানে সবসময় তার ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াত ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে জ্ঞানের আড্ডা ছিল তার কাছে অত্যন্ত পছন্দের ব্যাপার। জ্ঞানের ভারে ন্যুজ্ব এই ব্যক্তি জ্ঞান বিলাতেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসতেন। বই পড়া এবং সংগ্রহ করা বাদে তার আরো দুটি নেশা ছিল, আর তা হচ্ছে বাজার করা এবং রান্না করা। তার বাসায় প্রতিনিয়ত যেসব ছাত্র-ছাত্রীর যাতায়াত ছিল, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই তার হাতের রান্না খেয়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন। তিনি শুধুমাত্র জ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন না, অনেক ছাত্রী, এমনকি অনেক ছাত্রের বউয়ের রান্নার শিক্ষকও ছিলেন। রান্না করার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল তার। বাজার করতেন বেশ সময় নিয়ে। প্রায়ই তিনি বলতেন,
আমি যেকোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি। এক কাঁচাবাজার, অন্যটা হলো বইয়ের দোকান। আমার মনে হয়, কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে দেশে বইয়ের দোকান নাই সে দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায়, দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়। একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বইয়ের দোকানে শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই কম্যুনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে। সুতরাং সেই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বোঝার জন্য হাফেজ হওয়ার দরকার নাই।
১৯৪০ সালের দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অবস্থা এবং উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময়ে অনেক মুসলমান বুদ্ধিজীবীর ন্যায় তিনিও পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। নাজীর আহমেদ সহ আরো অন্যান্যদের সাথে মিলে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি স্বল্পায়ু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ৫ বছর পর নিজের মেধার স্বীকৃতি এবং যোগ্যতার বলেই আন্তর্জাতিকভাবে নামকরা লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে অধ্যয়নের সুযোগ পান। তারই সুপারিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিনা বেতনের ছুটি মঞ্জুর করেন এবং পাঁচ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন।
তার চেয়েও বড় কথা, বিশিষ্ট এবং প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড জে লাস্কি আব্দুর রাজ্জাককে তার গবেষণাকাজের তত্ত্বাবধানে নিতে আগ্রহী হন। লাস্কির মতো প্রখ্যাত এবং পন্ডিতজনের পক্ষে আব্দুর রাজ্জাককে তার শিক্ষার্থী হিসেবে গ্রহণের বিষয়টি ছিল নৈর্ব্যক্তিক। এটি ছিল আব্দুর রাজ্জাকের মেধার স্বীকৃতি। আর তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহ।
লাস্কির সাথে আব্দুর রাজ্জাকের বেশ শিক্ষক-ছাত্রের সখ্যতাপূর্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার মূলে ছিল স্যারের মেধা, সৌজন্যতাবোধ এবং আন্তরিকতা। এ সময় নাকি পন্ডিত নেহেরু এবং কৃষ্ণ মেনন প্রায় প্রায়ই স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। বই পড়ার নেশা থেকেই গবেষণা চলাকালে তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে Diploma in Librarianship সমাপ্ত করেন।
অবসরের বিনোদন হিসেবে দাবা খেলা ছিল তার বেশ পছন্দের। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়টুকু তিনি বই পড়েই কাটাতেন। সন্ধ্যায় দুই ঘন্টা দাবা নিয়ে মেতে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেন জীবিত থাকাকালীন তিনিই ছিলেন তার দাবা খেলার একমাত্র সঙ্গী। দাবা খেলার বসলে এই দুজনের দুনিয়ার আর কোনো বিষয়ই খেয়াল থাকতো না। এরকম খেলায় মশগুল হয়ে মোতাহার হোসেনের ড্রয়িং রুমের সোফায় বেশ কয়েক রাত কাটিয়েছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। মোতাহার হোসেন গত হওয়ার পরও তিনি দাবা খেলতেন কখনো একা একা অথবা ছাত্র বা শিক্ষকদের সাথে।
দাবার গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক স্যারের স্নেহতুল্য। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে বসে খোশ মেজাজে গল্পগুজব করাই ছিল আব্দুর রাজ্জাকের অন্যতম বিনোদনের অংশ। একদিন এক ছেলেকে ডেকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে, এই ছেলে অর্থনীতি খুব ভালো বোঝে। ছেলেটি ছিল নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন!
১৯৫০ সালে আব্দুর রাজ্জাক গবেষণা সন্দর্ভ জমা দেবার আগেই প্রফেসর লাস্কির মৃত্যু হয়। লাস্কির মতো শিক্ষকের মৃত্যুতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রচন্ড মর্মাহত হন এবং গবেষণাকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। লাস্কির মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ নবীন অধ্যাপক মরিস জোন্সকে তার সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত করে। থিসিসের কাঠামোর সাথে মরিস জোন্সের মতানৈক্য দেখা যাচ্ছিল। আর তাছাড়া অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের নিজের পান্ডিত্য এবং মেধার ওপর ছিলেন আস্থাশীল এবং আত্মবিশ্বাসী। এর সাথে প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যু মিলিয়ে থিসিসের কাজ শেষ পর্যায়ে এনেও তিনি সিদ্ধান্ত নেন থিসিস জমা না দেয়ার।
তারপরও বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে তিনি থিসিস জমা দেন, কিন্তু পরীক্ষকগণ থিসিসের ফুটনোট সুসংবদ্ধ নয় বলে অভিযোগ তোলেন এবং তা পুনরায় ঠিক করে জমা দেয়ার আহবান জানান। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দেয়ার আহবান জানায়।
এছাড়া ১৯৬৮ সালে অক্সফোর্ডের আমন্ত্রণে তিনি ব্যালিওল কলেজে যান এবং ১৮ ও ১৯ শতকের ইন্দো-ব্রিটিশ সম্পর্কের (Indo British Relations during 18th and 19th Centuries) উপর ডকুমেন্টেশন এডিটিংয়ের কাজ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার অনুপস্থিতির কারণে তাকে ১৫ বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত করা হয়। এ সময় তিনি ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যান। পরের বছর তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের খন্ডকালীন সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তারপরের বছরই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট প্রদান করে। এর দুই বছর ১৯৭৫ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের প্রতি রাজ্জাক স্যারের বরাবর একটা লোভ ছিল। শুধুই দেশের নীলক্ষেতই না, পিএইচডি করার সময়ও তিনি বিদেশের পুরনো বইয়ের দোকানে যাওয়াটা নিজের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন। একদিন বিকেলের দিকে গেলেন একটি দোকানে। একটি বই পছন্দ করে সেখানেই পড়া শুরু করেন। দোকান বন্ধের সময় হয়ে এলে দোকানী দোকান বন্ধ করে চলে যায়। সেই রাতটা তার সেই দোকানেই কেটেছিল।
আব্দুর রাজ্জাক লন্ডনে থাকার শেষের দিনগুলোতে বেশ অর্থকষ্টে ছিলেন। কিন্তু তাই বলে তার বই পড়া এবং দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করার লোভ সামলাতে পারেননি। সকালে উঠেই চলে যেতেন সেসব পুরানো বইয়ের দোকানে। সারা দিন বিভিন্ন বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে সন্ধায় ফিরে আসতেন কিছুই না খেয়ে। বই বিক্রেতাদের প্রায় সবাইই একসময় খেয়াল করলো যে হালকা-পাতলা একহারা চেহারার এই মানুষটা সারাদিন কিছু না খেয়ে শুধুমাত্র বইয়ের মাঝেই ডুবে থাকেন। প্রতিদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে এক বিক্রেতার মায়া হলো। একদিন তিনি সসংকোচে আব্দুর রাজ্জাককে খেতে ডাকলেন। তারপর থেকে যতদিন লন্ডন ছিলেন সেটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ঘটনার এক থেকে দেড় যুগ পর আব্দুর রাজ্জাক স্যার আবার বিলেত যান।
পুরনো সেই বইয়ের দোকান খুঁজে পেতে তার বেশি কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু কাউন্টারে বসা লোকটিকে দেখে তিনি যারপরনাই কষ্ট পেয়েছিলেন, কেননা লোকটি আর আগের সেই লোক না। তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে উত্তর দিয়েছিল,
আগে বসতেন আমার বাবা। ১২ বছর হবে তিনি গত হয়েছেন। আমাদের ভাইদের কাছে তিনি আপনার চেহারার আর বই পড়ার নেশার গল্প করতেন প্রায়ই। সাথে এটাও বলে গেছেন, আপনি এলেই যেন আপনাকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাই।
বই আর বই, ঘরের মেঝেতে যত্রতত্র ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায়; গাঁয়ে গাঁয়ে লেগে থাকা সারি সারি শেলফের আড়ালে হারিয়ে গেছে ঘরের দেয়াল, উঁচুতে ঘরের ছাদ ছুঁয়ে থরে থরে সাজানো কেবল বই। নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের নেই সেখানে। একদিকে যেমন মূলধারার অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য ঠিক তেমনি দাবা, রন্ধনশৈলীর বইও তার সংগ্রহে ছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার বেশ পুরনো কিছু সংস্করণে তার সংগ্রহে ছিল। সারাটাক্ষণ ডুবে থাকতেন বইয়ের পাতায়। কখনো মেঝেতে উবু হয়ে, কখনো পিঠখাড়া চেয়ারে এক পা তুলে দিয়ে, কখনো বা দিনে-দুপুরে মশার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মশারি টাঙিয়ে তার ভেতরে হেলান দিয়ে কিংবা শুয়ে বই পড়তে দেখা যেত তাকে। জীবনের শেষের দিনগুলোতে যখন চোখের জ্যোতি প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল, তখনও থেমে থাকেনি তার বই পড়ার কিংবা জ্ঞানার্জনের তেষ্টা; সহায়ক ছিল ম্যাগনিফাইং গ্লাস। আর একেবারে শেষ নিঃশ্বাস অবধি তার যে স্মৃতিশক্তির বর্ণনা শোনা যায় তা সত্যিই বিস্ময়কর এবং স্বয়ং বিধাতা প্রদত্ত।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক চল্লিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞান আর নিজেকে সকলের তরে। তাকে বলা হতো শিক্ষকদের শিক্ষক। তবুও তার শিক্ষকতাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘আব্দুর রাজ্জাকের কল্লা চাই’ স্লোগান উঠেছিল। আর যে বিশ্ববিদ্যালয় তার মতো ছাত্র আর শিক্ষক পেয়ে ধন্য হয়েছে সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিল। অবশ্য দুটো মামলাতেই স্যারের জয় হয়েছিল। এ জয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শাসন-শোষণ আর স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে। তবে শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে তার প্রচন্ড অনীহা ছিল। তিনি অকপটে স্বীকার করতেন, ক্লাস নেয়াটা তার ধর্তব্যের মধ্যে নেই। তিনি সবচাইতে বেশি আনন্দ পেতেন যদি ছাত্ররা কোনো বিষয়ে জানার অভিপ্রায়ে হোক আর এমনিতেই হোক তার কাছে এসে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলাপ করে।
সত্যিকার শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না। ছাত্রদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবেন। সস্নেহে চেয়ে থাকেন তার ছাত্রটি কবে মানুষের মতো মানুষ হবে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন তেমনই একজন। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য করেছেন তিনি। কেউ যদি বলেন, স্যার এ সাহায্যটুকু করতে হবে। তখনই কাঁধে চাদরটা দিয়ে তাকে নিয়ে হাঁটা ধরতেন। কখনো কাউকে ‘তুমি’ করে বলেননি। সকল ছাত্রকে তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন।
শোনা যায়, তিনি নাকি তার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া কিংবা তার লেখার সমালোচনা করা ছাত্রদেরও সাহায্য করেছিলেন। এসব শুনে হামিদা হোসেন জিজ্ঞাসা করায় উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
সমালোচনা করেছে তাতে কী? তাই বলে ছেলেটাকে আমি সাহায্য করবো না, সেটা কেমন কথা?
ফলবতী গাছ যেমন ফলের ভারে নুয়ে থাকে আর অহমিকাকে বর্জন করে ন্যুজ্বতাকেই আঁকড়ে ধরে, ঠিক তেমনি এত জ্ঞানের ভারে ন্যুজ্ব হওয়া সত্ত্বেও প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক তেমন কিছুই লিখে রেখে যাননি। একটা অসমাপ্ত বই, দশ-বারোটা চিঠি, অল্প কয়েকটা ছুটির দরখাস্ত, কিছু সুপারিশনামা আর কিছু আর্জি, একটা বক্তৃতা আর আনুমানিক ছয়-সাতটা ইন্টারভিউ ছাড়া পি.এইচ.ডি ডিগ্রির জন্যে লেখা থিসিস Political Parties in India, আর প্রবন্ধ পাকিস্তান মিলিটারি (The Military in Pakistan) এবং বাংলাদেশ: একটা জাতির অবস্থা (Bangladesh: State of a Nation) উল্লেখ করার মতো এই হচ্ছে তার লেখালেখির জীবন। তার নিজের লিখিত কোনো বই নেই যদিও, তবে তারই ছাত্র পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী স্মরণে তিনি এক বক্তৃতা দেন যা পরবর্তীতে Bangladesh : State of the Nation নামে একটি বইতে রুপান্তর করা হয়।
লেখালেখির প্রতি তার প্রচুর অনাগ্রহ ছিলো সেটা নিজেই স্বীকার করতেন। তার অনেক ছাত্রছাত্রী তাকে উৎসর্গ করেছেন তাদের নিজেদের বই। এমনকি বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ডিক উইলসন তার এশিয়া অ্যাওয়েকস (Asia Awakes) বইটি আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গপত্রে লেখা হয়েছে,
To Abdur Razzak of Dacca, who first made Asia come alive in my mind.
অর্থাৎ, ঢাকার আব্দুর রাজ্জাককে উৎসর্গ করছি, যার কারণে এশিয়াকে আমার মনে ধারণ করতে পেরেছি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক খুশবন্ত সিং ১৯৭৪ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (The New York Times) এ প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের উপর একটি ফিচার লিখেছিলেন। পরে অবশ্য তা ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া (Illustrated Weekly of India) এ পুনঃমুদ্রিত হয়। যেহেতু প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক কিছুই লিখে রেখে যাননি, তাই তার সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তা হচ্ছে লোকমুখে এবং তার কিছু কৃতী সন্তানের উৎসর্গপত্র কিংবা স্মৃতিকথামূলক বইতে। তারই ছাত্র বাংলাদেশের সাহিত্যের আরেক উজ্জ্বল তারা আহমদ ছফা রচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ এই বইটি থেকেই মূলত তার জীবনযাপনের বেশ খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়।
এছাড়াও, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ ব্যবস্থা: অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’ এই নামে সরদার ফজলুল করিমের একটি বই আছে। আর ‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ’ নামেও একটি গ্রন্থ আছে। তার সকল স্নেহভাজন ছাত্রছাত্রীরা তার স্মরণে এই গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। বইটি সম্পাদনা করেছেন আনিসুজ্জামান। সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন সরদার ফজলুল করিম, রেহমান সোবহান, হামিদা হোসেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত, রওনক জাহান, মফিদুল হক। সহযোগী সম্পাদক হিসেবে ছিলেন লুভা নাহিদ চৌধুরী, আবুল হাসনাত এবং মোহাম্মদ আবদুর রশীদ।
‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক’ নামে একটি ফাউন্ডেশন আছে, যেখান থেকে গবেষণারত শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ সাহায্য দেয়া হয়ে থাকে।ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে স্যারের সংগ্রহে থাকা সকল দুর্লভ আর দুষ্প্রাপ্য বইসমূহ নিয়ে ‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ’ নামে একটি পাঠাগার চালু আছে। যেখানে শুধুমাত্র গবেষণালব্ধ জ্ঞান বাদেও ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞানী হওয়ার জন্য সকলের আমন্ত্রণ।
বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী স্যারের সম্পর্কে বলেছেন,
সবকিছু ছাপিয়ে তার প্রকৃত পরিচয় হলো জ্ঞানের অন্বেষণ ও জ্ঞানের বিকাশে, জ্ঞানাহরণ ও গবেষণায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে তিনি সারাটা জীবন কাটান। বস্তুতই তিনি ছিলেন জ্ঞানের পূজারী ও শিক্ষক। তার জ্ঞানের পরিধি ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। শিক্ষকের সরলতা ও আড়ম্বরহীন জীবন ছিল তার ট্রেডমার্ক। পরোপকার যেন ছিল তার ধর্ম। শুধু তার পছন্দের মানুষের উপকারে তিনি সচেষ্ট ছিলেন না, অন্যরাও একইরকম সাহায্য, সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা তার কাছ থেকে পেতো। স্যার বোধহয় মনে করতেন যে, সারা দুনিয়ার সমস্যা সমাধানের দায় আমার স্কন্ধে ন্যস্ত নয়, কিন্তু পৃথিবীর গোলকধাঁধা সমাধানের একটি সূত্র আমি। -আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
স্যার শুধুমাত্রই স্যার ছিলেন না তিনি ছিলেন আমার দ্বিতীয় পিতা। -সরদার ফজলুল করিম।
তিনি ছিলেন জ্ঞানসমৃদ্ধ চিন্তাশীলতার জীবন্ত রূপায়ণ। -মীজানুর রহমান শেলী।
আমরা তাকে বলতাম ‘Running Dictionary’। -কামাল লোহানী।
আব্দুর রাজ্জাক জ্ঞানচর্চার জগতে যেমন ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন, ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি গৃহী ছিলেন, কিন্তু গৃহনির্মাণ করেননি। সংসারে বসবাস করেছেন, কিন্তু নিজে সংসারী হননি। -মনসুর মুসা।
Why do so many of us, spanning several generations, genuinely feel a deep sense of affection and respect for Professor Abdur Razzaq. He became a member of so many of our families. (অর্থাৎ, কেন আমাদের মধ্যে অনেকেই, এমনকি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মসমূহও, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের জন্যে এক গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ অনুভব করে? কেননা, তিনি আমাদের অনেকেরই পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন) – ড. কামাল হোসেন।
Razzaq Sir is huge mansion, with many rooms, closed but unlocked doors, and many treasures in each of them. (রাজ্জাক স্যার হচ্ছেন অসংখ্য রুম বিশিষ্ট এক বিশালাকার প্রাসাদ, আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো বন্ধ, কিন্তু দরজায় কোনো তালা নেই, এবং সেগুলোর প্রত্যেকটি জ্ঞানের ধনদৌলতে পরিপূর্ণ) -আহমদ ছফা।
Abdur Razzak was an intellectual in the European tradition of the men of ideas; a scholar with a true passion for knowledge. He loved knowledge for the beauty of knowledge. (আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন ইউরোপীয় ধ্যানধারণায় সিক্ত একজন বুদ্ধিজীবী; এমন একজন পণ্ডিত যার একমাত্র আসক্তি ছিল জ্ঞানার্জন করা। জ্ঞানের অন্তর্গত সৌন্দর্যকে তিনি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই জ্ঞানার্জন তার এতটা প্রিয় হয়ে উঠেছিল) -হাবিবুল হক খন্দকার।
প্লেটোর আদর্শে অনুপ্রাণিত জ্ঞানতাপস প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বলতেন,
শিক্ষা একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। শুধু তত্ত্ব-উপাত্ত দিয়ে শিক্ষার্থীর মনের ভার বাড়ানোকে শিক্ষা বলা যায় না। শিক্ষার কাজ হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়ার সূচনা করা যার মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের মনে যে চোখ আছে তাকে জ্ঞানের অনির্বাণ আলোর দিকে ফেরানো যায়। আর মাতৃভাষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি করা সম্ভব নয়।
আশির দশকের দিকে তার পুরাতন সকল ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় স্যার অনেকটা একা হয়ে যান। পুরাতন এক ছাত্রের সাথে দেখা হলে তিনি বলেন,
এতক্ষণ বইসা থাইক্যা আমারে নিয়া অনেক ভালো ভালো কথা হুনলাম। মানুষ মইরা গেলে তার সম্পর্কে সাধারণত এমন কথা কওয়া হয়। কী জানি, হয়তো মইরাই গেছি। কিন্তু টের পাইতাছি না।
তার প্রয়াণের আগে সর্বশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। মৃত্যু প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে স্যার বলেছিলেন,
আমি যেকোনো মুহূর্তে বিদায়ের জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কোনো দুঃখ নাই। কত বছর বাঁচবো, তা ভাবি না। জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশি ভাবি না। আমি অনেক বেঁচেছি, সত্তর বছর। নিজের হাতে জীবন নেব, এই কথা কখনো ভাবি নাই, যেকোনো মুহূর্তে মারা গেলে দুঃখ নাই। অনেক তো বেঁচেছি।
১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর জ্ঞানতাপস প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এমন একজন শিক্ষককে হারানোর শোক রাতারাতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি তার ছাত্ররা। একজন অসাধারণ মানুষ, একজন শিক্ষক, একজন জ্ঞানতাপসের অভাব থেকেই গেল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তাই হয়তো হুমায়ুন আজাদ বলেছেন,
এ সাধারণত্বকেই তো অসাধারণ করে তুলেছেন নিজের জীবনে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক; একালের জ্ঞানতাপস শুধু জ্ঞানের জন্যে জীবনকে অবহেলা করে গেলেন। জ্ঞানের কাছে জীবন পরাভূত হলে জন্ম নেন একজন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক।