দেশের প্রধান প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট টুর্নামেন্ট জাতীয় ক্রিকেট লিগের (এনসিএল) ২০তম আসর শেষ হয়েছে গত ৮ নভেম্বর। ছয় মৌসুম পর এনসিএলের শিরোপা জিতেছে রাজশাহী বিভাগ, প্রথম স্তর থেকে অবনমন হয়েছে বরিশাল বিভাগের। দ্বিতীয় স্তর থেকে প্রথম স্তরে উন্নীত হচ্ছে ঢাকা বিভাগ।
এবার শুরুতেই রানের ফল্গুধারা বইলেও টুর্নামেন্টের বয়স যত বেড়েছে, ততই রানের জোয়ার কমেছে। আর রান কমে যাওয়ার কারণ ছিল মূলত বল। ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে কোকাবুরা বলে খেলা হয়েছিল। দুই রাউন্ডে রান বেশি হওয়ায় পর বল পরিবর্তন করে দিয়েছে বিসিবি। তৃতীয় রাউন্ড থেকেই এসজি বলে খেলা হয়। আর তাতেই রানের চাকা শ্লথ হয়ে এসেছিল। তারপরও ২৯টি সেঞ্চুরি হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরিও রয়েছে। ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন আরিফুল হক, লিটন কুমার দাস ও রনি তালুকদার।
এই আসর দিয়েই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট, তথা সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন রাজিন সালেহ। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক ১৮ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন এই আসরের মধ্য দিয়ে। এনসিএলে ছয় ম্যাচে ৬৪.৮০ গড়ে দুটি সেঞ্চুরি ও তিনটি হাফ সেঞ্চুরিতে ৬৪৮ রান করে সেরা ব্যাটসম্যান সাদমান ইসলাম অনিক। বাঁহাতি এই ওপেনার খেলেছেন ঢাকা মেট্রোর হয়ে। বোলারদের মধ্যে সেরা ছিলেন অফ স্পিনার নাঈম হাসান, সদ্য জাতীয় দলে অভিষিক্ত চট্টগ্রামের এই ক্রিকেটার ছয় ম্যাচে ২৮ উইকেট নিয়েছেন। ইনিংসে দুবার পাঁচ উইকেট ও ম্যাচে একবার ১০ উইকেটও (দুই ইনিংস মিলে) পেয়েছেন।
নানা কারণেই সদ্যসমাপ্ত এনসিএল গত দুই মাসে দেশের ক্রিকেটে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল। সেই আলোচনার মূল হেতু অবশ্যই তুষার ইমরান। ৩৪ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান এবারও তিন সেঞ্চুরি ও এক হাফ সেঞ্চুরিতে পাঁচ ম্যাচে ৫১৮ রান করে দ্বিতীয় সেরা ব্যাটসম্যান। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১১ হাজার রান, ৩১টি সেঞ্চুরির মালিক তুষার ঈর্ষণীয় ফর্মে আছেন। তামিম ইকবাল-সাকিব আল হাসানবিহীন জিম্বাবুয়ে সিরিজের বাংলাদেশ দলে এই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানকে দেখার আশা করেছিলেন অনেকেই, কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি।
নির্বাচকরা তুষারকে সুযোগ দেননি। ফর্ম বিবেচনায় তুষারকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ ছিল না। তাই বয়সের সঙ্গে এনসিএলে খেলার ‘মান’ নিয়ে কথা উঠে এসেছে। এই বয়সের পর তুষার জাতীয় দলকে দীর্ঘদিন সার্ভিস যে দিতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত। তবে সার্বিকভাবে দেশের ক্রিকেটের জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার প্রসঙ্গ হচ্ছে এনসিএলের খেলার মান বিষয়ক আলোচনা, যেখানে উইকেট তথা পিচের ধরন নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে। অবশ্য প্রতি বছরই উইকেট নিয়ে বিস্তর কথা হয়, বোর্ডকর্তারা স্পোর্টিং উইকেট বানানোর বুলি আওড়ে যান। যদিও সেটার প্রয়োগ দেখা যায় না।
তবে উইকেটের উন্নয়নে বিসিবির কিছুটা সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি বিদেশি কিউরেটর নিয়োগ। চলতি বছর দুজন ভারতীয় কিউরেটর নিয়োগ দিয়েছে বিসিবি, গত এপ্রিলে প্রাভীন হিনগানিকর ও জুনে সঞ্জীব আগারওয়ালকে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রাভীন চট্টগ্রাম বিভাগে ও সঞ্জীব আগারওয়াল সিলেটে কাজ করছেন।
বিদেশি দুই কিউরেটর হয়তো রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারবেন না সবকিছু। তারপরও এবার এনসিএলে ঠিক কী ধরনের উইকেট ছিল তা জানতে কথা বলা হয়েছিল কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে, যারা পুরো লিগই খেলেছেন। তবে তাদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কেউ বলেছেন, উইকেট ঠিক আগের মতোই নিষ্প্রাণ, ফ্ল্যাট ছিল। আবার কেউ বলেছেন, স্পোর্টিং উইকেট ছিল কোথাও কোথাও, আগের তুলনায় ভালো উইকেট দেয়া হয়েছে এবার।
সাকুল্যে আট ভেন্যুতে খেলা হয়েছে এনসিএল। ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম, কক্সবাজার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কমপ্লেক্সের দুটি মাঠ, বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, রাজশাহীর শহীদ কামরুজ্জামান স্টেডিয়াম, খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম, রংপুর ক্রিকেট গার্ডেন ও বরিশাল বিভাগীয় স্টেডিয়ামে হয়েছে এবারের এনসিএলের ম্যাচ।
লিগের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক সাদমান ইসলাম অনিক ঢাকা মেট্রোর হয়ে এই আসরে সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া ও ফতুল্লায় ম্যাচ খেলেছেন। তিনি বলছেন, এবার উইকেট ভালোই ছিল। তার মতে, ‘উইকেট ভালো ছিল সব জায়গায়। স্পোর্টিং উইকেট ছিল। বোলারদের অনেক হেল্প ছিল এ বছর।’
গত বছরের সঙ্গে তুলনা করতে বললে সাদমান বলেছেন,
‘এবার অনেক স্পোর্টিং উইকেট ছিল। গত বছর অনেক ফ্ল্যাট উইকেট ছিল। এবার এমন উইকেট ছিল যে, পেস বোলাররা চাইলেই পাঁচ উইকেট মেরে দিতে পারছে।’
সেরা বোলার নাঈম হাসান ম্যাচ খেলেছেন বগুড়া, কক্সবাজার ও ফতুল্লায়। চট্টগ্রামের এই অফ স্পিনার অবশ্য নির্ভেজাল ব্যাটিং উইকেটই দেখতে পেয়েছেন এনসিএলে। উইকেট নিয়ে জানতে চাইলে নাঈম হাসান বলেছেন,
‘সবগুলোতে ফ্ল্যাট উইকেট ছিল, ব্যাটিং উইকেট ছিল। ফতুল্লায় খেলেছি, ওখানে প্রথমদিন একটু পেসারদের হেল্প ছিল। এরপর পুরো ব্যাটিং উইকেট। বগুড়াতেও শুরুতে এমন ছিল, পরে যখন উইকেট শুকিয়ে গেছে তখন আবার ব্যাটিং উইকেট হয়ে গেছে। কক্সবাজার তো শুরু থেকেই ব্যাটিং উইকেট।’
এমন উইকেটেও নাঈম হাসান ১০৬ রানে আট উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সেই সাফল্যের রহস্য সম্পর্কে এই তরুণ বলেছেন,
‘স্পিন করাতে পারলে সব উইকেটেই ধরানো যায়। আপনি যদি বল ঘুরান, তাহলে তো বল ঘুরবেই। আমি চেষ্টা করেছি শুধু বল ঘোরানোর।’
দ্বিতীয় মৌসুম এনসিএল খেলছেন নাঈম হাসান। গত মৌসুমে খেলেছেন একটি ম্যাচ। তার এনসিএলের উইকেটের অভিজ্ঞতা এমন,
‘ফ্ল্যাট উইকেটই বানায়। এবার একটু সকালবেলার দিকে পেস বোলারদের হেল্প ছিল, তারপর সব আবার ব্যাটিং উইকেট।’
পাঁচ ম্যাচে ১৪ উইকেট নেয়া খুলনার পেসার আল আমিন হোসেন এবার খেলেছেন খুলনা ও রাজশাহী ভেন্যুতে। এনসিএলের উইকেট নিয়ে বলেছেন,
‘স্বাভাবিক, যেমনটা থাকে। সকালে একটু বাউন্স থাকে, পরে ব্যাটিং। বোলিং উইকেট হলে ১-২ দিন বোলারদের হেল্প থাকবেই। সাধারণভাবে পৃথিবীর যে ধরনের উইকেটই হোক, সকাল বেলা আধঘন্টা ময়শ্চারের জন্য হেল্প থাকে। তারপর আস্তে আস্তে সাধারণ হয়ে যায়।’
দুই ভেন্যুতেই প্রায় একই ধরনের উইকেট পেয়েছেন তিনি। ডানহাতি এই পেসার বলেছেন,
‘দুটোই প্রায় একই ধরনের। ব্যাড বাউন্স হয় অনেক সময়, বল নিচে দিয়েও চলে যায়।’
টানা সাত বছর এনসিএল খেলা আল আমিন উইকেটের খুব পরিবর্তন দেখতে পাননি। তার মতে, এ কারণেই টেস্ট ক্রিকেটে গিয়ে সংগ্রাম করেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। তিনি বলেন,
‘এসব উইকেটের লেন্থ আর ঘাসের উইকেটের লেন্থ, আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে যাবে।’
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৪৫৮ উইকেটের মালিক এখন এনামুল হক জুনিয়র। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক এই বাঁহাতি স্পিনার সিলেটের হয়ে খেলেছেন এনসিএল। এবারের আসরকে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলেই রায় দিলেন তিনি। অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার বলেছেন,
‘রাজশাহীতে খুব ভালো উইকেট ছিল। আমরা ওখানে তিন রানে একটা ম্যাচ জিতেছি। আর এবার জাতীয় লিগটা অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। শুধু আবহাওয়া একটু সমস্যা করেছে, সেটা আমাদের হাতে নাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জাতীয় লিগ খেললাম এ বছর। কারণ স্পোর্টিং উইকেট। বোলাররাও হেল্প পেয়েছে, ব্যাটসম্যানরা যাদের টেকনিক ভালো তারা রান করেছে রাজশাহীতে। তারপর সিলেটে আমরা একটা ম্যাচ হেরেছিলাম, ঐটাও ভালো ফাইট হয়েছে।’
আগের আসরগুলোর তুলনায় উইকেটেও পরিবর্তন দেখেছেন এনামুল হক জুনিয়র। তিনি বলেছেন,
‘অবশ্যই এবার উইকেটের পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি। কারণ হলো, ঘাস ছিল অনেক উইকেটে। ফাস্ট বোলাররা বোলিং করে মজা পেয়েছে। যারা ভালো স্পিনার, তারাও ভালো বোলিং করেছে।’
এনসিএলকে উপেক্ষা করে অন্তত টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতি সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়ে টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিং দুর্গতিই বলে দেয়, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট নিয়ে আরও যত্নবান হতে হবে বিসিবিকে। আগামীর ক্রিকেটারদের টেস্ট ক্রিকেটের দীক্ষা দিতে এনসিএলের উইকেটের উন্নতি, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হওয়ার বিকল্প নেই।