২০১৩ সালে চাইরেত রেতচাপাকসি নামের এক যুবক থাইল্যান্ডের একটি মৎস্য শিকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন। আর দশজনের মতো তারও উদ্দেশ্য ছিল এই চাকরির মাধ্যমে পরিবারের ভরণপোষণ চালানো। রেতচাপাকসি এখন চল্লিশে পা দিয়েছেন, বাড়ি থাইল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলীয় ফেটচাবুরি প্রদেশে। একদিন পার্শ্ববর্তী প্রদেশ সামট সং ক্রমে কাজের সন্ধানে যান তিনি। সেখানে একটি নৌকায় জেলে হিসেবে চাকরি পান।
সেই থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা দুই বছর তিনি সেই নৌকা মালিকের সাথে সাগরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত। কিন্তু তাকে নিয়মিত ২৪ ঘন্টা হিসেবে কাজ করতে হতো, অর্থাৎ কাজের ফাঁকে কোনো ছুটি বা বিরতি ছিল না। শুধু তা-ই নয়, এজন্য তাকে কোনো বেতনও দেয়া হতো না। যখন তিনি এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেন, তখন তার উপরে উল্টো অকথ্য নির্যাতন নেমে আসতো। তাকে নৌকা থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেয়া হতো। অবশেষে তার শেষ রক্ষা হলো না; রেতচাপাকসি বলেন-
তারপর তারা আমাকে একটি দ্বীপে বন্দী করে রাখে।
এটি শুধুমাত্র রেতচাপাকসির একার জীবনের গল্প নয়। থাইল্যান্ডের অসংখ্য দাস জেলের জীবনের গল্প এটা। চাকরির সন্ধানে বের হয়ে তারা জড়িয়ে পড়েন এমন দাসত্বের জীবনে। রেতচাপাকসিকে যে দ্বীপে বন্দী করে রাখা হয় সেই দ্বীপের নাম বেনজিনা। ইন্দোনেশিয়ার দূরবর্তী একটি জেলে দ্বীপ। মৎস্য শিকার করতে করতে যখন একজন জেলে দুর্বল হয়ে পড়েন, তার কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, তখন তাকে মৎস্য শিকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে ফেলে রেখে আসে। ধীরে ধীরে সেখানেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রেতচাপাকসিকেও এই দ্বীপে ফেলে রেখে আসা হয়েছিল।
রেতচাপাকসি বর্তমানে ‘থাই অ্যান্ড মাইগ্রেন্ট ফিশার্স ইউনিয়ন গ্রুপ (টিএমএফজি)’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জেলে জীবনের সেই দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন,
আমরা সেখান থেকে পালানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবাই মিলে ইন্দোনেশিয়ার থাই রাষ্ট্রদূতের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো জবাব পাইনি। আমাদের মুক্তির ব্যাপারে কারো কোনো তৎপরতাও লক্ষ্য করিনি। একপর্যায়ে আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন ভাবতাম, কে আমাদের মুক্ত করবে? ধীরে ধীরে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
থাইল্যান্ড বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সি-ফুড বা সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। পাশাপাশি তারা সর্ববৃহৎ টিনড টুনা (টুনা মাছ দিয়ে তৈরি বিশেষ খাদ্য) উৎপাদনকারী দেশ। জাতিংঘের তথ্যানুসারে, থাইল্যান্ডের মৎস্য শিকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ৬ লাখ জেলে কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ যেমন মায়ানমার, কম্বোডিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে সরবরাহ করা হয়। থাইল্যান্ডের স্থানীয় জেলেদের পাশাপাশি এসব দেশ থেকে আগত জেলেরাও নির্মমভাবে পাচার ও জোরপূর্বক কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য হন। আর তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে উৎপাদিত সি-ফুড থাইল্যান্ড সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে রপ্তানি করে।
২০১৭ সালে থাইল্যান্ড সরকার এই খাত থেকে প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদাশিক মুদ্রা অর্জন করেছে, যা দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র। দেশটির মোট জাতীয় রপ্তানির ১০ শতাংশ পণ্যই এই সি-ফুড খাত থেকে আসে।
গত আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) থাইল্যান্ড সরকারকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর ফিশিং কনভেনশনে গৃহীত নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দাবী জানায়। স্থানীয় এনজিও লেবার রাইটস প্রোটেকশন নেটওয়ার্ক (এলপিএন) এর তথ্যানুসারে, এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক মৎস্য শিকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত জেলেদের প্রতি দশজনের মধ্যে একজন দাস শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সংস্থাটি আরো জানায়, রেতচাপাকসির এই অভিজ্ঞতা অত্র অঞ্চলে বিরল কোনো ঘটনা নয়, মাঝেমধ্যেই তাদের কাছে এ ধরনের সংবাদ আসে।
রেতচাপাকসির মতো অত্র অঞ্চলের অনেক জেলে গভীর সমুদ্রে বছরের পর বছর জোরপূর্বকভাবে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ সময় পরিবারের সাথে তাদের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। কার্যত তারা পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। গত দুই বছর আগে থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলীয় দ্বীপ অ্যাাম্বনের কাঞ্চুনাবুরি শহর থেকে লেক নামের এক জেলেকে উদ্ধার করা হয়। এই দ্বীপটিও জেলেদের অবৈধভাবে বন্দী রাখার জন্য বিখ্যাত। লেক এই দ্বীপে প্রায় এক দশক যাবত বন্দী ছিলেন। তিনি যখন সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন, তখনকার একটি ছবি এখনো তার মোবাইলে সংরক্ষিত আছে। এর কিছুদিন পরেই নেতৃস্থানীয়দের দ্বারা তিনি জোরপূর্বক দাস হন এবং সারাদিন খাটেন। অতঃপর বন্দী জীবনযাপনে বাধ্য হন।
তখনকার সেই ছবিতে দেখা যায়, তার চেহারা তারুণ্যদীপ্ত এবং মাথায় দীঘল চুল। কিন্তু এখন তার মাথার প্রায় সব চুল পড়ে গিয়েছে, তারুণ্য হারিয়ে দেহে ক্লান্তি চলে এসেছে, দুই চোখের গভীরে না বলা শত যন্ত্রণা। লেক বলেন,
এখন আমি বাকি জীবন আমার সহযোদ্ধা জেলেদের মুক্তির জন্য কাজ করে যেতে চাই।
অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ৬৪৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বেনজিনার মতো আরও অনেক দ্বীপ রয়েছে যেখানে জেলেদের এভাবে আটকে রাখা হয় এবং জোরপূর্বক দাস শ্রমিকে পরিণত করা হয়। এক সাবেক জেলে ২০১৪ সালে রেডিও ফ্রি এশিয়ার এক অনুষ্ঠানে জানান,
অনেক জেলেকে সেখানে হত্যা করা হয় এবং গণকবর দেয়া হয়।
তবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম চুক্তির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশ, বিশেষত ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই অবৈধ শ্রমের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলে থাই সরকার সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি সেখানে মানবাধিকার রক্ষা বিষয়ক প্রচারণা অব্যাহত আছে। সরকার স্থানীয় ও বহিরাগত জেলেদের দাস জীবন ও পাচার থেকে রক্ষার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
২০১৭ সালে পাশ হওয়া এক আইন অনুসারে, নৌকার মালিকদের যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা এবং প্রত্যেক জেলেকে তার পরিবারের সাথে কোনো প্রকার শর্ত ছাড়াই যোগাযোগ করতে দেয়ার সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এই দাস বিরোধী কর্মতৎপরতার অংশ হিসেবে দেশটির সরকার জেলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করেছে। জেলেদের বেতন পরিশোধের জন্য ইলেকট্রিক ব্যাংক ট্রান্সফার সিস্টেম চালু করার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তারা যেকোনো স্থান থেকে বেতন উত্তোলন করতে পারে।
আশা করা যাচ্ছে, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে মৎস্য বাণিজ্যের সাথে যুক্ত জেলেদের পাচার ও অধিকার হরণ তুলনামূলক কমে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানব সম্পদ পাচার প্রতিরোধ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়,
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের মানব পাচার পূর্বের তুলনায় প্রায় তিনগুণ কমে এসেছে, যা এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন।
স্থানীয় এনজিও এলপিএন ২০১৫ সালে জেলেদের সুরক্ষায় একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সেসময় তারা টিএমএফজি প্রকল্পের আওতায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজ ও ট্রলারগুলো মনিটরিং করতো এবং সন্দেহভাজন জাহাজ ও নৌকাগুলোকে চিহ্নিত করে রাখতো। কিন্তু সংস্থাটির মতে, নিয়মিত মনিটরিং করা, সেই অনুযায়ী অভিযান চালানো এবং জেলেদের নিরাপত্তা প্রদান বেশ ব্যয়বহুল ও জটিলতাপূর্ণ কাজ, যা তাদের পক্ষে পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব।
এদিকে গত জানুয়ারি মাসে মানিবাধিকার সংস্থা এইচআরডাব্লিউ বলেছে,
থাইল্যান্ড সরকার জেলেদের নিরাপত্তা প্রদানে এখনো যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। মৎস্য শিকারী নৌকাগুলোতে জেলেদের এখনো ব্যাপক হারে জোরপূর্বক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদের উপর নানাভাবে অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
যদিও থাইল্যান্ড সরকার এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এক বিবৃতিতে তারা তাদের পদক্ষেপের একটি দীর্ঘ তালিকা তুলে ধরেছেন। সেখানে দেশটির সরকার বলেন,
জেলেদের অধিকার রক্ষায় আমরা সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। কিন্তু আমরা বহিরাগত শ্রমিকদের ব্যাপারে একটি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে আসতে চাই। এজন্য আমরা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে কাজ করতে চাই। থাইল্যান্ড সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুসারে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সবসময় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা এ বিষয়ে থাইল্যান্ড সরকারের সাথে কথা বলতে চাইলে সরকার পক্ষের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। এলপিএন এর পরিচালক পাতিমা তুংপুচাইয়াকুলের মতে, এই সমস্যা সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো জটিল সাপ্লাই চেইন। তিনি বলেন,
এর মধ্যে অনেকগুলো স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গ্রুপ রয়েছে। এদের কেউ শুধু মাছ ধরে, কেউ তা প্রসেসিং করে, আবার কেউ তা রপ্তানি করে। ফলে এতগুলো ক্ষেত্র মনিটরিং করা ও নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জটিলতাপূর্ণ কাজ।
থাইল্যান্ডের মৎস্য বিভাগ একাই ৮২ প্রকারের সি-ফুড বিদেশে রপ্তানি করে। এলপিএন এর অনুমান, ১০,০০০-২০,০০০ ফিশিং বোট এই সি-ফুড সংগ্রহ ও প্রসেসিংয়ের সাথে যুক্ত রয়েছে। রেতচাপাকসিকে তিন বছর আগে বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করা হয়।এলপিএন সংস্থা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হলে সংস্থাটির পরিচালক পাতিমা ও টিএমএফজি প্রকল্পের একদল সদস্যদের যৌথ অভিযানে রেতচাপাকসিসহ আরও অনেক জেলেকে মুক্ত করেন। পাতিমা সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
আমাদের ধারণা ছিল সেখানে ১০০ জনের মতো দাস জেলে বন্দী আছে, কিন্তু সেখানে অভিযান চালিয়ে আমরা দেখতে পাই প্রায় ১,০০০ দাস জেলে সেখানে বন্দী রয়েছে।
রেতচাপাকসি মনে করেন, তার ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন ছিল বলে তিনি এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন। এলপিএন সংস্থাটি এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪,০০০ জেলেকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান সংস্থাটির সাথে সংশ্লিষ্টরা। এখনো থাইল্যান্ডে এমন হাজার হাজার জেলে দাসত্বের কিংবা বন্দী জীবন অতিবাহিত করছেন। আধুনিক কিংবা উন্নত দেশ থাইল্যান্ডের পর্দার অন্তরালে এ যেন এক অন্ধকার জগৎ!
আমাদের আশঙ্কা আরও একটি জায়গায়। আর তা হলো বাংলাদেশের শ্রমিক ও জেলেদের নিয়ে। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে থাইল্যান্ডে জেলে প্রেরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, তাহলে তারাও কি এমন দাসত্বের জীবনযাপন করছেন? তাছাড়া থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে যেসব বাংলাদেশীর গণকবর পাওয়া গেছে, তাদের ব্যাপারে সরকারের মতামত কী?