ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সংক্ষেপে ঢামেক বা ডিএমসি। মেডিকেলে পড়তে চাওয়া বাংলাদেশের হাজারো ছাত্রছাত্রীর স্বপ্নের ঠিকানা। প্রতি বছর হাজারো প্রতিযোগীর মাঝে অল্পসংখ্যক কিছু ভাগ্যবান শিক্ষার্থীই এখানে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে তাদের আজন্ম লালিত ‘ডাক্তার’ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার সুযোগ লাভ করে। কেমন কাটে তাদের এই কলেজ জীবন? কেমন তাদের পড়াশোনা? দেরি না করে চলুন জেনে আসা যাক।
প্রতিষ্ঠা
১৯৩৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম একটি পরিকল্পনা গ্রহন করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরিকল্পনাটি থমকে যায়। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৫ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশক্রমে ১৯৪৬ সাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে বছরেরই ১০ জুলাই ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করে। উল্লেখ্য যে, প্রতিটি ব্যাচের সংখ্যাকে ইংরেজী K দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যেমন- K-৫, K-৬…।
শুরুর দিকে কলেজের কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না। বর্তমানে যে ভবনটি হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেটি ১৯০৫ সালের দিকে নবগঠিত ‘বাংলা’ প্রদেশের সেক্রেটারিয়েট হিসেবে ব্যবহৃত হত। তারপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ও ছাত্রদের আবাসিক হল (কিছু অংশ) হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভবনটির কিছু অংশ ‘আমেরিকান আর্মড ফোর্সেস হাসপাতাল’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সবশেষে, ১৯৪৬ সাল থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
অবস্থান
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মহানগরীর বকশীবাজার এলাকায় অবস্থিত। এর পশ্চিমপাশে রয়েছে বুয়েট, পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হাসপাতাল বহির্বিভাগের পাশেই রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
MBBS কোর্স সম্পর্কে ধারণা
ডাক্তারি জীবনে এই কোর্সটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তাই এ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া যাক। প্রথমেই বলি, কোর্সটি পাঁচ বছর মেয়াদী। কারিকুলাম ২০১২ অনুযায়ী, এই সময়কে চারটি ফেজে ভাগ করা হয়েছে- ফেজ-১ , ফেজ-২, ফেজ-৩ এবং ফেজ-৪। ফেজ-১ এবং ফেজ-৪ প্রতিটি ১.৫ বছর মেয়াদী। ফেজ-২ এবং ফেজ-৩ প্রতিটি এক বছর করে। প্রতিটি ফেজ এর শেষে একটি প্রফেশনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া, ফেজভেদে ‘আইটেম’, ‘কার্ড ফাইনাল’, ‘টার্ম ফাইনাল’, ‘ওয়ার্ড ফাইনাল’ পরীক্ষাগুলোও অনুষ্ঠিত হয়। ফেজ-৪ এর শেষে অনুষ্ঠিত ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তারপর ১ বছরের জন্য ইন্টার্ন ডাক্তার হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রশিক্ষণ শেষ হলে, Bangladesh Medical & Dental Council (BMDC) থেকে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হতে হয় এবং এর মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশে মেডিকেল প্র্যাক্টিস করার অনুমতি লাভ করেন।
বিভাগ ও বিষয় সমূহ
MBBS কোর্সে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সর্বমোট ১১টি বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়।
বিষয়সমূহ হলো:
- Anatomy
- Physiology
- Biochemistry
- Forensic Medicine & Toxicology
- Community Medicine
- Pathology & Hematology
- Pharmacology & Therapeutics
- Microbiology & Immunology
- Medicine
- Surgery
- Gynae & Obstetrics
ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রত্যেক বিষয়ে স্বনামধন্য শিক্ষকগন পাঠদান করে আসছেন। এছাড়া, ঢাকা মেডিকেল কলেজ সর্বমোট ৪২টি বিষয়ে পোস্টগ্রাজুয়েশন ডিগ্রি দিয়ে থাকে।
ক্যাম্পাস পরিচিতি
কলেজ সংলগ্ন গেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে ‘পরমাণু বিল্ডিং’ নামক সুউচ্চ ভবনটি। হাতের বাঁয়ে পড়বে মনোরম পরিবেশ সমৃদ্ধ কলেজ অডিটোরিয়াম ভবন।
তারপরেই আপনি এসে পড়বেন বিখ্যাত মিলন চত্বরে। এখানেই শুয়ে আছেন শহীদ ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন। তার নামানুসারেই এই চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে।
প্রতিদিন হাজারো গল্পের সাক্ষী হয় এই মিলন চত্বর। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, জন্মদিন উদযাপন থেকে শুরু করে প্রেমিক যুগলের সময় কাটানো- সবই একে ঘিরে। তাই এই চত্বরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এর এক পাশে রয়েছে একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স এবং অপরপাশে মেয়েদের ডাঃ আলীম চৌধুরী হল। একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে আরেকটি চত্বর নাম ‘ঘাস চত্বর’।
বর্গাকৃতির এই কমপ্লেক্সে রয়েছে দু’টি সুবিশাল লেকচার গ্যালারী, বিষয়ভিত্তিক ডিপার্টমেন্ট সমূহ, একটি ক্যাফেটেরিয়া, একটি রিডিং রুম, একটি লাইব্রেরী, পাঁচটি পরীক্ষার হল, দু’টি কনফারেন্স রুম, নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি করে কমনরুম, একটি টিচার্স লাউঞ্জ এবং একটি ডিসেকশন হল। এছাড়া অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের রুম ছাড়াও রয়েছে কলেজ অফিস।
হল পরিচিতি
ঢাকা মেডিকেল কলেজের দু’টি হল রয়েছে। ছেলেদের জন্য শহীদ ডা: ফজলে রাব্বী হল এবং মেয়েদের জন্য শহীদ ডা: আলীম চৌধুরী হল।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভবনের পাশাপাশি ইন্টার্ন ডাক্তারদের জন্য প্রতিটি হলে শহীদ ডা: মিলন এর নামে একটি করে ভবন রয়েছে।
ক্যাম্পাস জীবন
প্রতিদিন সকাল ৭টায় লেকচার গ্যালারীতে লেকচার ক্লাসের মাধ্যমে শুরু হয় নিত্যকার একাডেমিক লাইফ। রুটিনভেদে দৈনিক ২ থেকে ৩টি লেকচার ক্লাস করতে হয়। প্রতিটির ব্যাপ্তি ১ ঘণ্টা। সামনের সারিতে বসে স্যারের প্রতিটি কথা মনোযোগ সহকারে শোনা, পেছনের সারিতে বসে ঘুমানো, গল্প করা এ রকম হাজারো গল্পের সাক্ষী হয় এই লেকচার গ্যালারীগুলো।
টিউটোরিয়াল ক্লাস,আইটেম, ওয়ার্ড, ওটি, রিডিং রুমে পড়াশোনা, ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা, কমনরুমে টেবিলটেনিস, ক্যারাম খেলা এসব নিয়েই একজন শিক্ষার্থীর নিত্যকার ক্যাম্পাস লাইফ। এসব হতে নিস্তার সপ্তাহে শুধু একদিনই মেলে- সেটি শুক্রবার। তাই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ছাত্রছাত্রীদের কাছে চাঁদরাত নামে পরিচিত।
আইটেম (Item) নামক বিষয়টির কথা না বললেই নয়। এটি হলো ১০ মার্কের একটি নিত্যকার ক্লাস টেস্ট, যেখানে ন্যূনতম ৬ নম্বর পেয়ে পাশ করতে হয়। না পেলে ‘পেন্ডিং’ নামক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে হয়। একটি কার্ড বা টার্ম পরীক্ষার সিলেবাসের অন্তর্গত সবগুলো আইটেম ক্লিয়ার করার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী কার্ড বা টার্ম পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। অংশগ্রহন করতে না পারলে বা উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলে পুনরায় পরীক্ষা দিতে হয়। একে ‘সাপ্লি’ পরীক্ষা বলে।
এবার আসি প্রফেশনাল পরীক্ষা, সংক্ষেপে ‘প্রফ’ নামক আরেক যুদ্ধের কথায়। প্রতিটি প্রফ ছাত্রছাত্রীদের কাছে এক একটি কেয়ামত স্বরূপ। প্রফের দিনগুলোর পরিশ্রম, মানসিক চাপ আর নির্ঘুম রাতগুলোর কষ্ট মেডিকেল শিক্ষার্থী ব্যতীত অন্য কারো বোঝা সম্ভব নয়।
পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা অন্যান্য সেবামূলক এবং সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। ‘সন্ধানী’ এবং ‘মেডিসিন ক্লাব’ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এছাড়া ডিবেটিং ক্লাবের মাধ্যমে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজনও হয়ে থাকে। প্রতি বছর ১০ জুলাই পালিত হয় ডিএমসি ডে। নতুন-পুরাতন ডিএমসিয়ানদের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই দিন। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাচ তাদের ব্যাচ ডে পালন করে থাকে, যেখানে শিক্ষার্থীরাসহ দেশের বিভিন্ন নামকরা ব্যান্ডদল, সংগীত শিল্পীরা পারফর্ম করে থাকে।
ইতিহাস, আন্দোলনে ঢামেক
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান, ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ‘৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন; প্রতিটি আন্দোলনেই ঢামেক এর শিক্ষার্থীরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই কলেজের ঐতিহাসিক আমতলা থেকেই ১৪৪ ধারা ভেঙে ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক মিছিল বের হয়েছিল, যেখানে শহীদ হয় অনেক শিক্ষার্থী। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তে দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করে ঢামেকের শিক্ষার্থীরাই। ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হারিয়েছে ডা: ফজলে রাব্বি, ডা: আলীম চৌধুরী সহ প্রায় ২২ জন সূর্যসন্তানকে। ‘৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন ডা: শামসুল আলম খান মিলন, যিনি এই প্রতিষ্ঠানের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তার মৃত্যুতে আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে এবং অবশেষে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়।
কৃতিসন্তানেরা
দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছেন হাজারো ডিএমসিয়ান, যাদের চিকিৎসাসেবায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। ডা: এবিএম আব্দুল্লাহ, ডা: কাজী দ্বীন মোহাম্মাদ, ডা: আবিদ হোসেন মোল্লাহ, ডা: আজিজুল কাহ্হার, ডা: খান আবুল কালাম আজাদ এর মতো অনেক দেশসেরা ডাক্তার এই মেডিকেল কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। শুধু চিকিৎসাক্ষেত্র নয়, আরো অন্যান্য ক্ষেত্রেও রয়েছেন অনেক ডিএমসিয়ান। ডা: সিতারা বেগম (বীরপ্রতীক), সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: আ ফ ম রুহুল হক, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপুমনি, সাবেক সাংসদ ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার প্রমুখ এই প্রতিষ্ঠনেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। সম্প্রতি, ঢামেকের অধ্যক্ষ মহোদয় ডা: খান আবুল কালাম আজাদ ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এর অধ্যাপক হওয়ার বিরল গৌরব অর্জন করেছেন। এছাড়াও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউটের প্রজেক্ট ডিরেক্টর ছিলেন ডা: আবুল কালাম, যিনি একজন ডিএমসিয়ান। আগামী দিনগুলোতে এই প্রতিষ্ঠানেরর শিক্ষার্থীরা যে দেশের চিকিৎসাক্ষেত্র সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
মানবতার মহান ব্রত নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আগামীর পথচলা আরো সুন্দর হোক, শুভ হোক- এই কামনায় ইতি টানছি।